আরশি নগরের পড়শি- ০১
আনোয়ার হোসেন বাদল
“বাড়ির কাছে আরশি নগর,
সেথা এক পড়শী বসত করে
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।”
উপমহাদেশের প্রখ্যাত বাউল সাধক লালনের তিরোধান দিবস ছিলো ১লা কার্তিক। এ বছর ছিলো ১৩১তম মৃতু দিবস। প্রতি বছর তার মৃত্যু বার্ষিকীতে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন আয়োজন করেন বর্নাঢ্য মেলার। বিশ্বব্যপী করোনা মহামারির কারনে এ বছর সেই লালন মেলা হয়নি। অবশ্য যে তারিখে মেলা হবার কথা তার আগে গত ২০ শে সেপ্টেম্বর গিয়েছিলাম লালনের সেই আরশী নগরে। আরশী নগরের সেই ভ্রমণ এবং লালন ও তার পড়শীদের নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছেও ছিলো বহুদিনের।
২০ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিলাম কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে। কুষ্টিয়াকে বলা হয় সাংস্কৃতিক রাজধানী তবে আমার মত নগন্য সাহিত্য কর্মীর কাছে কুষ্টিয়ার বিশেষ করে কুমারখালি উপজেলা শিল্প সাহিত্যের এক তীর্থস্থানস্বরুপ। এই কুষ্টিয়ার সামান্য দূরেই লালনের আরশী নগর। লালনের পড়শীরাও তার কাছাকাছি। রবীন্দ্রনাথ, মীর মোশাররফ, কাঙাল হরিনাথ, পর্যটক জলধর সেন, প্যারীচাঁদ মিত্র, গগন হরকরা, বাঘা যতীনের মতো পড়শীদের বসবাস আরশীনগরের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে। মজার বিষয় হচ্ছে বয়স কম-বেশী হলেও এইসব মহান ব্যক্তিবর্গের সবাই প্রায় সমকালীন। সবাই সবাইকে পেয়েছেন বা সকলেই সকলের স্পর্শে গিয়েছেন।
ছেলেকে নিয়ে স্বস্ত্রীক উঠেছিলাম কুমারখালীর কুণ্ডুপাড়ায়। মারুফা আফরিন সপরিবারে সেখানেই থাকেন, স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই পল্লী বিদ্যুতে কর্মরত। একটিমাত্র মেয়ে নাম তানিশা, বয়স এখনো পাঁচ হয়নি। মারুফাও একজন লেখক ও কবি। কুন্ডুপাড়া হচ্ছে কুমারখালীর সবচেয়ে অভিজাত আবাসিক এলাকা। কুণ্ডুপাড়ার পাশ দিয়েই বয়ে গেছে দৃষ্টিনন্দন গড়াই নদী। পদ্মা থেকে কুষ্টিয়া হয়ে যে নদীটি বয়ে গেছে ফরিদপুরের দিকে। লালন, মীর মোশাররফ, সাংবাদিক ও বাউল কবি কাঙাল হরিনাথ, পর্যটক ও লেখক রায়বাহাদুর জলধর সেনের বাড়িও এই গড়াই নদীর পাড়ে, কুমারখালী উপজেলায়। মারুফার রেসিডেন্সের সাথেই বিখ্যাত বুলবুল টেক্সটাইলের মালিকের বাড়ি।
শরৎকাল। পটুয়াখালী থেকে দীর্ঘ বাস জার্নির পর আমরা বিকেল পাঁচটা নাগাদ যখন কুষ্টিয়ার কুমারখালী পৌঁছাই তখন সন্ধ্যা আসন্ন। কুমারখালীতে ঢুকেই দূর হয়ে যায় পথের ক্লান্তি। আমার স্ত্রী সুলতানা এবং ছেলে জায়েদ রীতিমতো অবাক হয়ে যায় কুমারখালি শহরের পরিবেশ দেখে। সুলতানা বলে- এলাকাটিতো বেশ চমৎকার!
বললাম, এটি বাংলাদেশের প্রথম পৌরসভা। ১৮৬৩ সালে এটি পৌরসভা ঘোষিত হয়। তখন জেলার নাম ছিলো নদীয়া।
জায়েদ অবাক হয়ে বলে- নদীয়া আবার কোথায়? এমন জেলার নামতো শুনিনি?
বললাম, নদীয়া অবিভক্ত বাংলার একটি জেলা। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় নদীয়া ভারতের মধ্যে পড়েছে। তারপর থেকে এটা কুষ্টিয়া জেলা।
আমরা কাটায় কাটায় বিকেল পাঁচটায় কুমারখালী পবিসের যোনাল অফিসে পৌঁছাতেই দেখি মারুফা আফরিন তার অফিস থেকে বেরিয়ে ঠিক আমাদের জন্যেই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার স্ত্রীকে দেখে একেবারে জড়িয়ে ধরে, বলে- দীর্ঘ আট মাস পর বাপের বাড়ির দেশের কেউ খবর নিতে এলেন।
দেখলাম আনন্দে তার চোখের কোন ভিজে গেছে। মনে মনে ভাবলাম সত্যিই এই বিদেশ বিভূইয়ে যতো ভালোই থাক আপনজনদের ছেড়ে থাকাটা কষ্টেরই বটে। সেই ফেব্রুয়ারিতে এসে জয়েন করেছে। বললাম-
তুমিতো অনেক মোটাসোটা হয়ে গেছো!
লজ্জা পেল সে, বললো- ঠিকই ধরেছেন গুরু, ওজন কয়েক কেজি বেড়ে গেছে। সাড়াদিন অফিসের কাজ, বসে বসে খাই, ওজনতো বাড়বেই। তারপর বললো- চলুন বাসায় গিয়ে কথা হবে। দীর্ঘ জার্নি করে এসেছেন, রেস্ট করবেন পরে কথা-বার্তা হবে।
অফিস থেকে বাসা মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। তার সাথে হাঁটছি আর চারিদিকে তাকিয়ে দেখছি। সুদৃশ্য সব দালান কোঠা, প্রত্যেক বাড়িই দৃষ্টিনন্দন। বাড়ির লনে, বারান্দায় মনোহরি সব ফুলের বাগান। কোন কোন বাড়ির ছাদেও বাগান করা হয়েছে, সে বাগান থেকে সবুজ উপচে পড়ছে। বোঝাই যায় শহরবাসীর রুচি আছে।
সোহেল আর তানিশাও আমাদের প্রতীক্ষায় ছিলো। বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো তারা। আট মাস, যদিও খুব বেশি সময় না। তবু লক্ষ্য করে দেখলাম তানিশা যেন অনেকটাই বড় হয়ে গেছে। আগের সংকোচ ভাবটা কাটিয়ে বেশ সহজ এবং সাবলীল হয়ে উঠেছে। বয়সের তুলনায় তার মানসিক বৃদ্ধিটা বেশ লক্ষণীয়। সোহেলের চেহেরায়ও বেশ পরিপাটি ভাব।
তিন রুমের ফ্লাট, বেশ সাজানো আর পরিপাটি। আমাদের জন্যে যে রুম বরাদ্ধ সেখানে বিশাল সাইজের খাট, হাই কমোড আধুনিক বাথরুম আর ঝুল বারান্দা দেখে আমার বেশ ভালো লাগলো। দেখি প্রতিদিন আমি যা ব্যবহার করি, যেমন কাপড়চোপড় পড়ি তা পরিপাটি করে আলনায় সাজানো। এমন কী কিডনী ও হার্টের রোগী হিসেবে ডাক্তার যে সকল রুটিন বা পথ্য নির্দেশ করেছেন তাও ঠিক সেভাবে সাজানো রয়েছে আমার কামরায়। সুলতানাও খুশী হলো। তার এবং তূর্য’র বেশ পছন্দ হয়েছে থাকার জায়গা।
আমি বিস্মিত হয়ে তাকালে সুলতানাকে দেখিয়ে মারুফা বললো- ম্যাডামের কাছে জিজ্ঞেস করে করে সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। তবু কিছু প্রয়োজন হলে বলবেন। খুব খুশী হলাম, মনে মনে ভাবলাম-
‘যো রাধে সে চুলও বাঁধে’ কথাটি সত্যিই তাৎপর্যময়। সত্যিই অসাধারণ করিৎকর্মা মেয়ে এই মারুফা।
কুমারখালী, কুষ্টিয়া
চলবে…….