Arup Chandra

অরূপ চন্দ্র

নারীজাগরণের কাব্য

তৈমুর খান

কাগজের বইয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবছি, কাগজে একদিন ছিঁড়ে যায়, পুরনো হয়ে নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু হৃদয় ছিঁড়ে না। হৃদয় আর অন্য সব জীবন্ত হৃদয়ে আশ্রয় পায়। কোনো না কোনো সময় সেই হৃদয় একইভাবে জেগে ওঠে। আবেগে ভেসে যায়। মানব চৈতন্যের পথে তার পতাকা ওড়ায়। টি এস এলিয়ট এই কারণেই বলেছিলেন:

. “It is obvious that we can no more explain a passion to a person who has never experienced it than we can explain light to the blind.”

অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে আমরা এমন একজন ব্যক্তির কাছে আবেগ ব্যাখ্যা করতে পারি না যে এটি কখনও অনুভব করেনি, আমরা অন্ধকে আলো ব্যাখ্যা করতে পারি।

মানুষ মাত্রেই এই আবেগের দ্বারা চালিত। অন্ধ মাত্রেই শুধু অন্ধকার নয়, তার হৃদয়েও আলো জ্বলতে পারে। এই আবেগকেই মূলধন করে কবি অরূপ চন্দ্রের ‘প্রেমে ও অপ্রেমে নারী'(প্রথম প্রকাশ ২০২২) কাব্যখানি রচিত হয়েছে।

কবি অরূপ চন্দ্রের কাছে প্রেম কী?

এ প্রশ্নের উত্তর তিনি তাঁর কাব্যের কবিতাতেই দিয়েছেন। যে সৌন্দর্য মুগ্ধ করে, চিরন্তন আবেদনময়ীর অবয়বে সম্মুখে দাঁড়ায়। নারী যখন সেই জীবন্ত চিত্রকলা। তখনই অন্তরের ক্ষরণ শুরু হয়। সেই আবেগের কাছে আত্মসমর্পণই সৌন্দর্য বহন করে। প্রকৃতির ভেতর নারীকে আবিষ্কার করা। তিনি কবিতায় লিখেছেন:

“স্নানঘর থেকে বেরিয়ে এলে চাঁদের জোছনা ছড়িয়ে

বিন্দু বিন্দু জলকণা মুখে ঘাড়ে পৌষের শিশির

সালংকারা শঙ্খের মতো হাত

আদুর গা নিটোল পিঠ আয়নার সামনে তুমি–“

এই নারীমূর্তি তখন প্রেমিকের কাছে হেমেন মজুমদারের জীবন্ত ছবি। প্রকৃতির মতো চিরন্তনী। এই সৌন্দর্য শুধু উপলব্ধি করা যায়, কিন্তু একে প্রকাশ করা যায় না। হৃদয়ে মরুতৃষা নিয়েই কৌতূহলে ছুটে চলেন এক ভোর থেকে আরেক ভোরের দিকে। রূপশালি ধান এর ঘ্রাণে মন আকুল হয়। এভাবেই প্রিয়া রূপে, প্রেমিকা রূপে, বিস্ময়রূপে, প্রকৃতির রূপে, নক্ষত্রকন্যারূপে সৌন্দর্য ফিরে আসে। বনলতিকা, সমুদ্র, পর্বত, মরুভূমি, জলপ্লাবন, ঘূর্ণিঝড়, অরণ্য, মহাকাশ, পুরুষ তার মধ্যে হারিয়ে যায়। কবি দেখেন:

“এ বসুধায় শুধু শক্তির ধ্বজা ওড়ে”

এই নারীশক্তিকে নিয়েই কবির প্রেম রচনা, পৃথিবী রচনা, সংসার-সমাজ এবং সভ্যতা রচনা। কল্পনা ও রোম্যান্স রচনা। আলো ও অন্ধকার রচনা। জীবন ও স্বপ্ন রচনা। মৃত্যু ও ধ্বংস রচনা। যখনই ভালোবাসার জন্ম হয়েছে, তখনই সুখ ও ঐশ্বর্য, সত্য ও সৌন্দর্যের অবস্থান কবি দেখেছেন। কিন্তু যখনই ভোগের নগ্নরূপ প্রকাশ পেয়েছে, প্রেমহীন দৈহিক কামনার এবং ধর্ষণ ও হত্যার উল্লাস জেগে উঠেছে, তখনই ধ্বংস ও মৃত্যু নেমে এসেছে। পৌরাণিক মিথ থেকে বাস্তব সমাজের ক্ষেত্রেও এই ভাবেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে। তাই নারী হয়েছে দুর্গা। কালো বোরখার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছে। অন্ধকার পৃথিবী থেকে নিজেকে আলোকিত করতে চেয়েছে।

তাহলে অপ্রেম কী?

এই অপ্রেমের উত্তরও কবি কবিতায় দিয়েছেন। পুরুষ-পৃথিবী যখন নারীকে পণ্য করে তুলেছে, তার মাতৃরূপকে অস্বীকার করেছে। তার প্রিয়া সত্তাকে, প্রেমিকা সত্তাকে সম্মান জানায়নি। তার সৌন্দর্য সত্তাকে পদে পদে ক্ষুণ্ন করেছে। তার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। তখনই অপ্রেমের জন্ম হয়েছে। তখনই নারী বিদ্রহিনী:

“অবগুন্ঠন ছিঁড়ে তুলে নাও আয়ুধ

শাস্ত্রীয় পোশাকে দাঁড়াও সম্মুখে

আলো আর রঙের ছটায় বিস্ফারিত আমি

গান গায় পাহাড় সমুদ্র অরণ্য নদী

অপরূপ প্রকৃতির উদ্ভাস

গোঁড়াগুলো উপড়াও ওলটপালট”

যেখানে প্রেম নেই, সেখানেই প্রেমহীনের জন্য। যেখানে হৃদয় নেই, সেখানেই হৃদয়হীন হয়ে ওঠার শপথ। যেখানে আবেগ নেই, সেখানেই নিষ্ঠুর হয়ে ওঠার আয়োজন। এভাবেই কাব্যটি প্রাচীন ইতিহাস ও বর্তমান মানব সভ্যতার নারী-জীবনের অন্তর্কথনে আলোড়িত হয়েছে। আদি জননী হিসেবে নারীকে কবি দেখেছেন, তেমনি আদি তপস্বিনী হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। নারীই যেন সভ্যতার ধারক ও বাহক। তাই কবি সভ্যতাচারী দার্শনিক হয়েই নিরীক্ষণ করেছেন:

“কত যুগ-যুগান্ত আগে তোমাকে দেখেছি যেন

সেই থেকে নিরবচ্ছিন্ন

তাকিয়ে আছি রোমাঞ্চিত শরীরে।”

কবির মধ্যে আদি পিতা আদমের দেখা পাই। তিনি যেন আদি মাতা হবাকে নিরীক্ষণ করছেন। সেই নিরীক্ষণ আমাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়ে আসছে। তবে কেন নারী খুন হবে? কেন ধর্ষিত হবে? কেন যুদ্ধ হবে?

যুদ্ধ হোক নারীমুক্তির জন্য, যুদ্ধ হোক স্বদেশের জন্য, যুদ্ধ হোক প্রেমের জন্য। সেই মহাশক্তির কাছেই আবেগের প্রবহমান উত্তরণ ঘটিয়েছেন। যার জন্য কাব্যটি বিষয়ভিত্তিক নারী জাগরণেরই প্রত্যয়নামা।

🍁

প্রেমে ও অপ্রেমে নারী: অরূপ চন্দ্র, রবি প্রকাশ,৫৭ ভিমাগড়, উৎস,১/৩ডি, বাঘাযতীন, কলকাতা-৭০০০৮৬, চলভাষ:৭৫০১৫৮৩০১০, মূল্য ২০০ টাকা।

ছবিতে অরূপ চন্দ্র

Leave a Reply