Barid Baran Gupta

অতীত ও ঐতিহ্য

বারিদ বরন গুপ্ত

পৃথিবীতে কোন জাতি বেঁচে থাকে তার অতীত এবং ঐতিহ্যকে সঙ্গে করে! অতীত এবং ঐতিহ্য কোন জাতির কাছে গর্বের বিষয়বস্তু! এগুলো আমাদের সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠে, বংশ পরায় প্রজন্মের পর প্রজন্মে এগুলো সঞ্চারিত হয়! ফলে একটি জাতি যেমন তার অতীত গৌরব কে জানতে পারে তেমনি বর্তমানের প্রেক্ষাপটে সেগুলো রক্ষা করে পরিশিলীত করে, এই ভাবেই ঐতিহ্য বংশপরম্পরায় ভাবে এগিয়ে চলে !

আমরা বিভিন্নভাবে অতীত ঐতিহ্যকে জানতে পারি, বুঝতে পারি বা তাকে নিয়ে গর্ব করতে পারি। কিন্তু সেই জানার পথ গুলো যদি রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন অতীত বা ঐতিহ্য আর বর্তমানে ফিরে আসে না, ফলে একটা বাঁধের সৃষ্টি হয়, যাকে আমরা অবরুদ্ধ বলি, এই অবস্থা সৃষ্টি হলে সংস্কৃতি আর প্রজন্মের পর প্রজন্ময় প্রবাহিত হতে পারে না, তখন জাতি তারা আপন গৌরব আপন ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে, একটা ধার করা ঐতিহ্য বা সংস্কৃতি এসে তার জায়গা ভরাট করে, বর্তমানে হয়তো সেটাই হতে চলেছে !

বর্তমানে অতীত ঐতিহ্য প্রবাহিত হওয়ার পথ গুলো কিন্তু ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে আসছে। এখনকার ছেলেমেয়েরা বই পড়ার নেশা প্রায় হারিয়ে ফেলেছে, হলে অতীতের গৌরব কাহিনী থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু তাদের ওপর ই দোষ দিলে চলবে না, বর্তমানে পাঠ্যপুস্তকে অতীতে গৌরব কাহিনী পড়ার ওপর খুব কমই গুরুত্ব দেওয়া হয়! তাছাড়া এসব কাহিনী অনেকের কাছে অসার বলেও মনে হয়! মোদ্দাকথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে অতীতের ঐতিহ্য বা গৌরব কাহিনী খুব একটা মূল্যবান বলে মনে হয় না, তাছাড়া তারা এসব নিয়ে খুব একটা ভাবেও না। বর্তমান বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি তাদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হয়!

আমার মনে হয় বর্তমানে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিকাশ অতীত সংস্কৃতির গতিপথকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে, বর্তমান প্রজন্ম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দৌলতে নেট ইন্টারনেট মুঠোফোনে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে, ফলে বই পড়ার যে নেশা তা কেড়ে নিচ্ছে তথ্য এবং প্রযুক্তি, যার কারণে অতীত সংস্কৃতির বিষয়গুলো আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে উঠে আসছে না!

আমাদের ছোটবেলায় দূরদর্শন, মুঠোফোন ছিল না, শুধু দূরদর্শন কেন বলব তখন বেতারও গ্রামগঞ্জে সহজলভ্য ছিল না, ফলে ছোটবেলায় আমাদের বিনোদনের মাধ্যম ছিল বিভিন্ন গল্পের বই, পাঠ্যপুস্তক তো ছিলই, তার চেয়ে উপরি পাওনা ছিল ঠাকুরমা ঠাকুরদার এর কাছে শোনা বিভিন্ন রূপকথার গল্প!বিভিন্ন গৌরব কাহিনী, কিংবদন্তি গল্পগুলো এখনো মনের মনিকোঠায় সঞ্চিত হয়ে আছে! প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন একবার এক সভায় বলেছিলেন-“যদি তোমাদের বাচ্চাকে আরও বেশি বুদ্ধিমান করতে চাও, তাহলে আরও বেশি করে রূপকথার গল্প পড়তে দাও, ওরা রূপকথার মাধ্যমে ভবিষ্যতে জানার পথকে আরও প্রসারিত করবে!” এই বিশ্ব বরেণ্য বৈজ্ঞানিকের চিন্তাভাবনা কতদূর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল তা কিন্তু এর মাধ্যমেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সত্যিই তাই বিভিন্ন ঐতিহ্য গৌরব কাহিনী রূপকথার গল্প শিশুদের একটা কল্পনার জগতে নিয়ে যায়, যা তাদের জ্ঞানের পরিধিকে যেমন বাড়ায় তেমনি জানার জগতটাকেও প্রসারিত করতে পারে।

আমার সমাজতাত্ত্বিক ক্ষেত্র সমীক্ষায় আমি যেসব তথ্যদাতার সাহায্য পাই, তাদের সকলের বয়স সত্তরের ওপরে, এই সদস্যরা এখন খুবই কম বেঁচে আছে, যে কয়জন বেঁচে আছে তারাই আমাদের সম্পদ! অতীতকে জানার একমাত্র তারাই সবের ধন নীলমণি, পরিষ্কার বুঝতে পারছি যে একটা জেনারেশন গ্যাপ হয়ে যাচ্ছে! নদীর স্রোত হারিয়ে গেলে নদী যেমন আস্তে আস্তে মজে যায়, জঙ্গলপূর্ণ হয়ে যায়, তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে যায়! আমাদেরও বর্তমানে ঠিক সেরূপ হতে চলেছে! হয়তো আগামী দশ বছরের মধ্যে একটা প্রজন্ম চলে যাচ্ছে! অতীত ঐতিহ্যের মোটামুটি ৭৫ শতাংশ হারিয়ে যেতে বসেছে, ২৫ শতাংশ হয়তো থাকবে আরো ২০ বছরের জন্য! তারপর হয়তো পুরো ১০০% ই চলে যাবে!

পরিশেষে আমরা বলতে পারি বর্তমানে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বাড়বাড়ন্ত অতীত ঐতিহ্যকে যথেষ্ট আঘাত হানবে, এবং সচেতন না হলে তা চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে !!

বারিদ বরন গুপ্ত

Leave a Reply