Baridbaran Gupta

তখন রাত বারোটা
বারিদ বরন গুপ্ত

জীবনে যেমন অনেক ভৌতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, তেমনি অনেক ভৌতিক গল্প ও শুনেছি। সত্যি কথা বলতে কি ভৌতিক গল্পগুলো মনে হয় সভ্যতার বিকাশ পর্বের সময় থেকেই বর্তমান সমাজে একইভাবে চলে আসছে এর গ্রহণযোগ্যতা এতটুকু হারায়নি। ভৌতিক গল্প সম্পর্কে একটু আধটু কৌতুহল সকলেরই আছে।

নয়ের দশকের কথা আমি তখন হাওড়ার পিলখানার একটা মেস বাড়িতে থাকতাম, কলেজ থেকে ফেরার পর সোজা গিয়ে হাজির হতাম রতনদার দোকানে, রতনদার বাড়ি ছিল মেদিনীপুরের ঘাটালের কাছে এক গ্রামে! খুব মিশুকে এবং মজাদার লোক ছিলেন, আমাদের বিকেলের আড্ডা স্থল ছিল আট ফুট বাই দশ ফুটের উঁড়ে পাড়ার ওই রতনদার দোকানটি। ওই দোকানে প্রত্যেকদিন আসতেন ঘোষাল বাবু, অর্থাৎ রামকিঙ্কর ঘোষাল , অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক একসময় মেদিনীপুরের ঘাটালের কাছে এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন ! উনি একদিন আমাদের এক রহস্য রোমাঞ্চকর লোমহর্ষক ভৌতিক গল্প শুনিয়েছিলেন! আমি অনেকেই এই গল্পটি শুনিয়েছি, আজকে আমি আমার পাঠকদের উদ্দেশ্যে এই গল্পটি রাখছি।

বিংশ শতকের প্রথম দিকের কথা, তখন ব্রিটিশ রাজত্ব চলছে, দেশে বইছে স্বদেশী আন্দোলনের হাওয়া, তখন হাওড়ায় হাতে গোনা বিদ্যালয়, তখন দক্ষিণ হাওড়ার উদয় নারায়নপুরের মিডিল ইংলিশ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন অতিশ মুখোপাধ্যায়, বাড়ি ছিল কলকাতার বেহালা অঞ্চলে, কর্মসূত্রে উদয়নারায়ণপুরেই থাকতেন। বলাবাহুল্য ব্রিটিশ রাজত্বে স্কুল পরিদর্শকদের খুব সুনাম ছিল, তারা ঘন ঘন স্কুল পরিদর্শন করতেন, পড়াশুনোর একটু এদিক ওদিক হওয়ার উপায় ছিল না, ব্রিটিশের আইন বলে কথা, কর্তব্যে গাফিলতি ব্রিটিশরা কিছুতেই সহ্য করত না।

যাই হোক বিদ্যালয় পরিদর্শন করতে ইন্সপেক্টর সাহেব আসবেন, তাই অতীশ বাবুর রাতের ঘুম গেছে উড়ে, আজ বাদ কাল বিদ্যালয় পরিদর্শক আসবেন তাই অতীশবাবু খাতা পত্র রেজিস্টার বুক পুরোপুরি সমাপ্ত করার জন্য রাতে স্কুলে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই অতিশ বাবু একনাগাড়ে কাজ করে যাচ্ছেন, রাতে খাওয়া দাওয়ার পর আবার রেজিস্টার বুক খুলে বসেছেন, এখনো অনেক কাজ বাকি, যেভাবেই হোক রাতারাতি সমস্ত কাজ শেষ করতেই হবে! দেয়াল ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর ছুঁই চুই করছে। হঠাৎ দরজার ঢোকা, ভাবলেন বিদ্যালয়ের দারোয়ান হবে হয়তো কিন্তু দরজা খুলে দাখেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা, সমস্ত চুলে পাক ধরলেও এই বয়সে যথেষ্ট সপ্রতিভ! যাহোক ঘরে ঢুকেই অতিশ বাবুকে নমস্কার জানালেন এবং বললেন-” আমার নাম নবীন ভটচাজ, একসময় এই বিদ্যালয় এর প্রধান শিক্ষক ছিলাম, রাত্রে শুনলাম কালকে বিদ্যালয় পরিদর্শক আসবেন তাই চলে এলাম আপনাকে সাহায্য করার জন্য!”

অতিশ বাবু জানো প্রাণ খুঁজে পেলেন! এই রাত্রে নির্জন কক্ষে তিনি আর একা নন, আরেকজন এসে গেছেন, অতএব বিদ্যালয় পরিদর্শকের কাছে আর তাকে তিরস্কার শুনতে হবে না! অতিশ বাবু বললেন–
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ খুব ভালো হলো আপনি স্বেচ্ছায় এসেছেন!”

“ধন্যবাদ কেন বলছেন? এটা তো আমি করে থাকি, আপনার আগে যিনি ছিলেন, তাকেও ঠিক এই ভাবেই সাহায্য করেছি!”- নবীন বাবু বললেন।

এরপর নবীন বাবু রেজিস্টার টা নিয়ে আপন মনে কাজ করতে শুরু করে দিলেন! কি নিখুঁত কাজ! অতিশ বাবু শুধু দেখে যাচ্ছেন!

অতিস বাবু কখন যে ঘুমিয়ে গেছেন খেয়াল নেই, সকালে ঘুম ভাঙলো বিহারী দারোয়ানের ডাকে! ঘুম ভাঙা চোখ রগরাতে রগরাতে অতিশ বাবু দারোয়ান কে জিজ্ঞেস করলেন–

“নবীন বাবু কখন গেলেন?

‘কই !দেখিনি তো?

“ভদ্রলোক না বলেই চলে গেলেন!” ঠিক আছে তাড়াতাড়ি চা করে নিয়ে এসো, পরিদর্শক আসার আগেই বিদ্যালয় কক্ষ পরিষ্কার করতে হবে?

“হ্যাঁ বাবু! আলবত! ইন্সপেক্টর বলে কথা!

যাই হোক ইন্সপেক্টর এসে খুব সুনাম করলেন অতিশ বাবুর, খাতা পত্র সবকিছুতেই কোন ত্রুটি খুঁজে পাননি, অতিশ বাবুর আনন্দের যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন!

যাইহোক অতীশবাবু অন্যান্য শিক্ষকদের কাছে নিজেকে জাহির করার সুযোগ পেলেন! সেই আনন্দে নবীন বাবুর সাহায্যের প্রসঙ্গটা প্রায় ভুলেই গেলেন, তখন কাউকে কিছু বললেন না!

এই ভাবেই কেটে যায় সময়! হঠাৎ একদিন বিদ্যালয় পরিদর্শকের কাছ থেকে, নতুন করে রেজিস্টার তৈরি করার আদেশ বার্তা পেলেন! তখন নিরুপায় হয়ে অতিশ বাবু বয়স্ক শিক্ষক অমর বাবুর কাছে প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক নবীন বাবুর হদিস পেতে চাইলেন, এবং নবীন বাবুর সাহায্যে প্রসঙ্গটাও তুলে ধরলেন!

“আরে মশাই আপনি বলেন কি? আপনার কি মাথা টাথা খারাপ হয়েছে? এই বিদ্যালয় এর প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক নবীন ভট্টাচার্য তো কবেই মারা গেছেন!

“অতীশ বাবুর গা শিহরণ দিয়ে উঠলো! নিজেকে সামলে নিলেন,! কিন্তু ধীরে ধীরে চিন্তার রাজ্যে হারিয়ে গেলেন! মনে মনে ভাবছেন তাহলে সেদিন রাতে কে এসেছিল তার কাছে! কেইবা ইস্কুলের বুক রেজিস্টার কে রাতারাতি শেষ করল! শুধু চিন্তা করেই সার! কোন উত্তর মিলল না বারে বার! শুধু একটা কথাই মনে ভিড় করে-প্রতিক্ষণে প্রশ্ন করে আপন মনে! শুধু ঘুরেফিরে আসে একটাই কথা-

“তখন রাত বারোটা”

পরিচিত:: বারিদ বরন গুপ্ত, কবি লেখক, সমাজ সংস্কৃতি মূলক লেখালেখির সাথে দীর্ঘদিন যুক্ত আছেন!

This Post Has One Comment

  1. debasish datta

    শ্রদ্বেয় লেখক,
    ধণ্যবাদ, তবে লেখার সাবলীলতা পাওয়ার জন্য নৈসর্গিক বর্ননা আরও প্রয়োজন ছিল—ভাল থাকবেন

Leave a Reply