ভূতের খপ্পড়ে রাম খুড়ো
বারিদ বরন গুপ্ত
আমাদের পাড়ার রাম কাকা বরাবরই বাচ্চাদের খুব ভালবাসে। বাচ্চাদের হাজার আবদার মুখ বুজে সহ্য করে। রাম কাকা রাস্তায় বার হলেই হল, ছেলের দল পিছু পিছু ছুটবে! নানান আবদার ! নানান ফিরিস্তি! কাকা যথাসাধ্য চেষ্টা করে মেটানোর, আর না পারলেও কথার মাধ্যমে বাচ্চাদের আবদার নিরস্ত করার জাদু মন্ত্রটা তার ভালই জানা ছিল। রাম কাকার একটা বিশেষ গুণ আমার কাছে আজও অমলিন হয়ে গেছে তা হল বাচ্চাদের সঙ্গে করে খাওয়া, খেতে বসেই হাক পারতেন -“কয়রে সব?” অমনি পাড়ার ছেলেরা দৌড়াতো রাম কাকার বাড়ির দিকে। আসলে বাচ্চারা ছিল তার প্রাণ! আমি দেখেছি যেদিন রাম কাকা মারা গেল সেদিন অনেক বাচ্চাই কেঁদেছিল।
প্রত্যেকদিন বিকালে গ্রামের বাড়োয়ারীতলায় রাম কাকা গল্প দাদুর আসর বসাতো ! গ্রামের সব বাচ্চার তাকে ঘিরে গোল হয়ে বসতো, রাজা রানী থেকে ভূত-প্রেত কোন গল্পই বাকি থাকতো না। আর বাচ্চারা শুনতোও সব মন দিয়ে! রাম কাকার গল্প বলার ধাঁচ ছিল একটু অন্য ধরনের! মাঝে মাঝে গল্প বলতে বলতে থেমে যেত, হয়তো রামকা মাঝে মাঝে পরীক্ষা করত ছেলেরা কে কতটা মনোযোগ দিয়ে শুনছে! যখনই ছেলেরা তারপর ! তারপর ! বলতো, আবার শুরু করত! তখনকার দিনে আমাদের গ্রামে এমন ছেলে ছিল না যে রাম কাকার কাছে গল্প শোনেনি!
রং কাকার বেজায় শখ ছিল মাছ ধরা। একদিন এক বর্ষার বিকালে কাঁধে পলুই নিয়ে রাম কাকা চলেছেন মাছ ধরতে! পাড়ার ছেলেরা বারোয়ারী তলায় খেলা করছিল, রাম কাকাকে দেখেই তারা ছুটে গিয়ে পথ আটকালো- আজ একটা গল্প তোমাকে শুনাতেই হবে ! এতগুলো বাচ্চার আবদার ফেলতে পারল না রামকা, বারোয়ারী তলার এক পাশে পলুই-টা রেখে ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলল-“আজ তোমাদের একটা ভূতের গল্প শোনাবো, কেউ উঠে পালালে হবে না, সবাইকে ‘হাঁ’ দিতে হবে! ছেলেরা সব আলতো ভাবে ঘাড় নাড়লো!
রাম কাকা বলতে শুরু করলেন-‘আমি একবার মাছ ধরতে গিয়ে ভোটের খপ্পড়ে পড়েছিলাম, ওহ ! জোর বেঁচে গেছিলাম! কি চিৎকার ভূতের! কি তান্ডব ! যেন গা শিউরে দিয়ে ওঠে! যদি আজকে সেই ভূতটা চলে আসে, তাহলে তোমরা থাকবে, না পালাবে ?’ সবাই চুপচাপ! যানো পিন পড়ার শব্দ শোনা যায়! বাচ্চাদের মধ্যে অধীর একটু ডাকা -বুকো ছিল, সে বলল-“হ্যাঁ আমরা থাকবো!”রাম কাকা, আরো বললেন আমি একটা ভূতকে বাড়িতে টেনে এনেছিলাম আজকে সেই গল্পটাই আমি তোমাদের শোনাবো!
রাম কাকা শুরু করলেন-‘আজ থেকে ৫০ বছর আগেকার কথা, খুব সম্ভবত জৈষ্ঠ্য মাস হবে, বিকেল থেকেই আরম্ভ হয়েছে তুমুল বৃষ্টি, আর তখনকার দিনে পাউসে প্রচুর মাছ উঠত! এখন একটা আস্ত পুকুর ছিচে একটা মাগুর মাছের সন্ধান মেলেনা, আর তখন গ্রামের পুকুর গুলো কই মাগুর ল্যাটা প্রভুতি আমাছায় ভর্তি থকতো।
তা যাই হোক সন্ধ্যা বেলায় পালুই আর খাড়ুই নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মাছের সন্ধানে। প্রথমেই এসে পড়লাম শান্তি গোড়ের জোলে! এখানে সামান্য কয়েকটা লাটা মাছ পেলাম! এরপরে সোজা চললাম কোটাল গড়ের পাড়ে। সামান্য একটু বৃষ্টি ধড়েছে! তারপর জল পেরিয়ে সোজা চললাম কোটাল গড়ের দিকে। তখন কোটাল গোড়ে প্রায় জঙ্গলে ভর্তি ছিল, ছিল প্রচুর বড় বড় আম, জাম, বেল, অশ্বথ গাছ। যাই হোক কোটাল গড়ের পূর্ব দিকের মোহনা দিয়ে মাঠের জল পুকুরে ডুকছে, শুধু মাগুর মাছের লাইন লেগেছে, এক এক করে ধরছি আর খাড়ুই এ ভরছি। হঠাৎ শোনা গেল ডাল ভাঙ্গার বিকট আওয়াজ! এ কি হলো? ঝড় জল নেই! তারপরই শুরু হল দাপাদাপির আওয়াজ! যেন গাছের উঁচু ডাল থেকে কেউ ডাঙ্গায় দুদ্ধার করে ঝাঁপ মারছে, এরপরই শুরু হল আর এক কান্ড! পুকুরের জল তোলপাড় করছে ! রাত আটটা নটা হবে, কোটাল গড়ের পুকুর পাড়ে যেন একটা ভয়াল পরিবেশ! মাছের লোভ সব ভয় কে হটিয়ে দিচ্ছে, এই ভয়াল পরিবেশে একাকী দাঁড়িয়ে মাছ ধরছি আর খাড়ুই এ পুড়ছি! হাতে আছে জাল কাঠি, খাড়ুই এও তাই! অতএব ভয়ের কোন কারণ নেই! তবে বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ভূতের খপ্পড়ে পড়েছি!
খারুই এ শুধু মাগুর মাছ এ ভর্তি হয়ে গেছে। আর জায়গা নেই! এবার সন্তর্পনে ফিরতে হবে! দ্বিতীয়ার বিলম্বিত চাঁদ কালো আকাশটাকে হারিয়ে মাঝে মাঝে উঁকি মারছে! বাড়ি ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছি! অমনি পিছনে থেকে কয়েকজন যেন ছুটে এলো! বারে বারে একই আওয়াজ মাছ দে? মাছ দে? আমিও তাদের আশ্বাস দিচ্ছি, বাড়ি আয় রান্না করে দেবো! আমি যত দ্রুত এগোই তারাও তত দ্রুত পিছে পিছু আসে আর একই আওয়াজ তোলে- মাছ দে? মাছ দে?
একেবারে গ্রামের সীমানা এসে পড়েছি! দেখছি গ্রামের একজন দূর থেকে টর্চ মারতে মারতে এগিয়ে আসছে! মনে হল ঝড়ঝঞ্ঝা পথে হাজার সমুদ্র পেরিয়ে তীরে ভিরলাম! তবুও তারা ক্ষ্যান্ত হয়নি! দাপাদাপি একটু কমলো, একই আওয়াজ তুলে চলেছে- এবার মাছ দে? মাছ দে? আমিও হাজার শক্তি জোগাড় করে দৃঢ় প্রত্যয়ে বললাম- আরে বাড়িতে আয়না, পেট ভরে মাছ খাওয়াবো! অমনি দূর থেকে পঞ্চা খুরো আমাকে দেখতে পেয়ে বললো-“খুড়ো মাছ পেলে?” আর পিছন থেকে আওয়াজ এলো যা! মাছ দিলি না ! ভূত প্রাণপণে মারলো দৌড়!
পঞ্চা খুড়ো খাড়ুই এ মাছ দেখে অবাক হয়ে বলল- “খুড়ো তুমি পারো”
“হা ভূত গুলোকে প্রায় বাড়িতে নিয়ে এসে ফেলেছিলাম, তুমি এলে তাই দৌড় মারলো!”
আঁ! বলিস কি?
হাঁ কাকা-‘ ভূতের খপ্পড়ে পড়েছিলাম’
পরিচিত: বারিদ বরন গুপ্ত, মন্তেশ্বর পূর্ব বর্ধমান, কবি সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক, সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক লেখা লিখিতে যুক্ত।