Baridbaran Gupta

মহালয়ার সুরে জেগেছিল বাঙালি

বারিদ বরন গুপ্ত

“জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী
অভয়া শক্তি বলপ্রদায়নী তুমি জাগো
তুমি জাগো –“

এক সময় মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজ মল্লিক, বাণীকুমারদের “মহিষাসুরমর্দিনী”
অনুষ্ঠান বাঙ্গালীকে ঘুম থেকে জাগিয়েছিল! বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সেই ভরাট গলায়-“আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জুরী!” শারদের ভোরের বাতাস কাঁপিয়ে জাগিয়ে তুলেছিল গোটা বাংলাকে! তার সেই ভারাট কণ্ঠে
বাংলার ক্ষেত খামার নদী-নালায় আগমনীর সুর ভেসে বেড়িয়েছিল, কাশফুল হাওয়াতে দোল খেলেছিল, শরতের শেফালী চারিদিকে সুবাস ছড়িয়েছিল! কিন্তু আজ সব অতীত! বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি অর্থাৎ যান্ত্রিক সভ্যতার গ্রাসে তা আজ ক্ষয়িষ্ণু সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে !

সেই ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নিরবিচ্ছিন্ন গতিতে এগিয়ে চলছে বাঙালি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’!১৯৬৫ সাল পর্যন্ত আকাশবাণীতে মহালয় ভোরে পুণ্য তিথিতে নিয়মিত আসর বসত, একে একে হাজির হতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজ মল্লিক, বাণীকুমার, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র ,মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ,শিপ্রা বসু ,সুপ্রীতি ঘোষ, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ,অসীমা ভট্টাচার্য প্রমুখেরা! তখন আকাশ থেকে এই অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রসারিত হতো! শোনা কথা এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে শিল্পীদের নিয়ে বেশ কিছুদিন মহারাও চলত! যাই হোক এসব নামিদামি ব্যক্তিত্ব এবং শিল্পীদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠানটি এক অতি উচ্চতায় উঠেছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই! এখনো পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা এতটুকু কমেনি! কিন্তু দুঃখের কথা সেই অনুষ্ঠানের মাধুর্য আর নেই! সমাজ সংস্কৃতির আঙ্গিনায় যান্ত্রিক সভ্যতার এই ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান যে যথেষ্ট আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই!

আজও আকাশবাণীতে মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান সম্প্রসারিত হয় তবে তা রেকর্ডে! ১৯৬৬ সাল থেকেই রেকর্ডে আকাশবাণী নিরবিচ্ছিন্নভাবে সম্প্রসারিত করছে! কিন্তু অতীব দুঃখের কথা বেতার অর্থাৎ রেডিও শুধু শহর নয় গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে গেছে, তার আজ স্থান হতে চলেছে জাদুঘরে ! তাই পিতৃপক্ষ এবং দেবীপক্ষের সন্ধিক্ষণে যখন আকাশবাণী‌ মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান সম্প্রসারিত করবে তখন তা বাতাসেই শুধু ঘুরে বেড়াবে, বাঙালির কানে আর পৌছাবে না। কারণ বেতারের তার কেটে গেছে, বাঙালির ঘর থেকে- “সুখী গৃহকোণ বাজে গ্রামোফোন” সে তো কবেই চলে গেছে, তার হাত ধরে চলে গেছে রেডিও !

আজও সুপ্রীতি ঘোষের গলায় বাজে-“বাজলো তোমার আলোর বেণু”, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে-” বিমানে বিমানে আলোকের গানে”, শিপ্রা বোসের কন্ঠে _”ওগো আমার আগমনী আলো”,মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় কন্ঠে ভেসে আসে সেই ঐতিহ্যবাহী-“তব অচিন্ত্য রূপচরিত মহিমা!’কিন্তু রেকর্ড বেজেই চলে, হয়তো তা আকাশবাণী চত্বরেই ঘোরাফেরা করে! আজ শুধু শহর নয়, গোটা গ্রাম খুঁজলে একটা রেডিও মেলেনা,‌‌।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বাণীকুমার, পঙ্কজ কুমার মল্লিকরা তিরিশের দশকের প্রথমার্ধে শারদ প্রাতে বাঙ্গালীদের জাগিয়েছিল, গোটা গ্রাম বাংলা সুরের ঝরনায় মেতেছিল! আজ সব অতীত! সব আছে, তবু কিছুই নেই! আজও দেবিপক্ষের অবসানে এবং মাতৃপক্ষের আগমনের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সুর ভেসে আসে কিন্তু ঘুম ভাঙাতে পারে না বাঙালির!

তথ্য: শ্রী শ্রী চন্ডী এবং মহিষাসূরমর্দিনী

লেখক পরিচিতি বারিদ বরন গুপ্ত মন্তেশ্বর পূর্ব বর্ধমান কবি সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক গবেষক সমাজ সংস্কৃতি বিষয়ক লেখালেখিতে যুক্ত আছেন!

Leave a Reply