
খিড়কি থেকে সিংহ দুয়ার
বারিদ বরন গুপ্ত
‘খিড়কি থেকে সিংহ দুয়ার এই তোমাদের পৃথিবী’সত্যিই তাই! ‘এক সময় মেয়েদের জগৎ ছিল তাই, বাড়ির গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ! তাদের জীবনের চাওয়া-পাওয়া যা কিছু সব এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো, বাইরে যে একটা জগৎ আছে, সেই জগত সম্পর্কে তাদের কৌতূহল থাকলেও সেই কৌতূহল মেটানোর সাহস বা ক্ষমতা তাদের ছিল না, বলতে গেলে তাদের তা দেওয়া হয়নি। এটা ছিল প্রাক মধ্যযুগ বা মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থা! বলতে গেলে পুরোপুরি পর্দার আড়ালে চলে গেছিল মহিলা সমাজ! পরবর্তীকাল সমাজ বিবর্তনের পথ ধরে বহির্জগতে আলো অন্তপুরে প্রবেশ করতে শুরু করে, সভ্যতার আলো মেখে তারা বহির্জগতে পা রাখার জন্য ছটফট করে, কিন্তু শাস্ত্রীয় বিধান বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সহজে তাদের অধিকার স্বীকার করতে চায়নি। অনেক কাট-খড় পুড়িয়ে, অনেক বিধি-নিষেধের বেড়া টপকিয়ে তাঁরা সিংহ দুয়ারের গণ্ডি ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছে জীবন ও জীবিকার খোঁজে! বর্তমানে তারা পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রগুলিতেও নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করছে।
সাম্প্রতিককালে হুগলির পোলবা দাদপুর ব্লকের উচ্চশিক্ষিতা সুপ্রীতি সিং এর জীবন সংগ্রামকে অনেকেই কুর্নিশ জানাচ্ছেন! সত্যিই সংসারের হাল ফেরানোর জন্য সিংহদুয়ারে বন্দি না থেকে সে বাইক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুয়ারে দুয়ারে ফ্লিপকার্টের প্রতিনিধি হয়ে, আমি কিন্তু তার এই সংগ্রামকে পরিচিতি দুনিয়া ছেড়ে জীবন উত্তরনের ইতিহাস হিসেবে দেখতে চাই! সে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে, তাদের অধিকারের ক্ষেত্রে ভাগ বসিয়েছে! হয়তো তার দেখাদেখি ভবিষ্যতে আরো অনেক মহিলা এই পথে আসবে! হয়তো প্রতিটা ক্ষেত্রে তাদের অধিকার দাবি করবে! আর করছেও তাই, কোভিড সিচুয়েশনের পরবর্তীকালে আমি বেশ কিছু মহিলা ফেরিওয়ালা দেখেছি, তাদের সাথে কথাবার্তা বলে বুঝেছি যে তারা যথেষ্ট শিক্ষিত এবং সংসারে হাল ফেরানোর জন্য ঘরে বসে থাকতে তাদের মন সায় দেয়নি, প্রথম প্রথম তাদের তথাকথিত সমাজের সমালোচনার মুখে পড়তে হলেও তারা কিন্তু গায়ে মাখেনি! উল্লেখ্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বাইরে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতা কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। হয়তো বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতি, পাশ্চাত্য দুনিয়ার প্রভাব, শিল্পায়ন, নগরায়ন, শিক্ষার প্রসার সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল, তারই ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে এগুলি ব্যাখ্যা করে চলে!
আমরা যদি সভ্যতার বিকাশ পর্বের দিকে একটু তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো যে তখন প্রোডাকশন ইউনিটটা কিন্তু মহিলা সমাজের হাতেই ছিল, কৃষি এবং শিল্পের পটভূমিকা তো তাদের হাত দিয়েই উঠে এসেছিল! তখন সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক, বরং পুরুষরা তাদের সহযোগী হিসেবেই কাজ করতো! পরবর্তীকালে সমাজ বিবর্তনের হাত ধরে কৃষি প্রযুক্তির আবিষ্কারের ফলে এই হউনিট তাদের হাতছাড়া হয়, ধীরে ধীরে ক্ষমতা কর্তৃত্ব এবং আধিপত্য হারিয়ে তারা গৃহবন্দী হতে থাকে, সন্তান প্রতিপালন এবং গৃহের কাজকর্মের মতো অবৈতনিক শ্রমের অংশীদার হয়ে ওঠে! আমরা ভারতীয় আর্য সভ্যতায় মহিলাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথা জেনেছি, কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগ থেকেই তাদের ভূমিকা ধীরে কমতে থাকে! হোম যাগ-যজ্ঞ শিক্ষা সাবেতেই তারা পিছু হটতে থাকে!
পরবর্তীকালে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় বিধান মহিলা সমাজকে আষ্টে পিষ্টে বেঁধে ফেলে! তাদের নড়াচড়ার ক্ষমতা কমে যায়, ফলে তারা ধীরে ধীরে গৃহবন্দী হয়ে পড়ে! মধ্যযুগ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্ধকারময় যুগ! আর এই যুগে মহিলাদের কি হাল হয়েছিল তার বলার হয়তো প্রয়োজন পড়বে না। এই সময় পর্বে মহিলারা পর্দার আড়ালে বন্দী হয়ে যায়! পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আঙুল হেলনে তাদের চলতে বাধ্য হতে হয়! ঠিক এই সময় পর্বে অর্থাৎ আলোক প্রাপ্তির যুগে ইউরোপে মেরি অসেল বেটিফেডান , সিমন দ্য বেভোয়া, প্রমুখের লেখনীতে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে মহিলা সমাজ! ধীরে ধীরে জন্ম নেয় লিবারেল, সমাজতান্ত্রিক এবং র্যাডিকেল নারীবাদ! উল্লেখ্য নারীবাদী আন্দোলন ইউরোপ কাঁপালেও তার ঢেউ এশিয়ার দেশগুলোতে আসতে অনেক সময় লেগেছে!
ভারতীয় সমাজ পরিবর্তনের ইতিহাসের দিকে একটু নজর দিলে বোঝা যাবে যে ভারতীয় সমাজ বহুকাল ধর্মীয় সনাতনী বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল! আর এই সমাজে মহিলাদের অবস্থান কিরূপ ছিল তা সহজে অনুমেয়। প্রাচীন যুগ থেকে সুলতানি এবং মুঘল আমলে ও তাদের ওপর শাস্ত্রীয় বা ধর্মীয় বেড়াজাল আরো কঠোর থেকে কঠোরতা হয়! তবে ব্রিটিশ শাসন পর্বে বিভিন্ন মিশনারি এবং সমাজ সংস্কারকদের আন্দোলনের ফলে মহিলারা ধীরে ধীরে বহির্জগতের আলো মাখতে থাকে! তবে এই সমস্ত আন্দোলনগুলো ছিল বেশিরভাগই শহরকেন্দ্রিক, ফলে আপামর ভারতীয় সমাজে এর প্রভাব খুব একটা বেশি পড়েনি! তবে এই সময়ে রামমোহন, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চেষ্টায় মহিলারা ধীরে ধীরে আলোক প্রাপ্ত হয়। তবে ব্রিটিশ শাসন পর্বে মহিলাদের শিক্ষার দীক্ষার সামান্য হলেও তার পটভূমিকা তৈরি হতে থাকে! এই ভাবেই স্বাধীনতা পর্যন্ত ভারতীয় মহিলা সমাজ ধীরে ধীরে এগুতে থাকে!
স্বাধীনতার পরবর্তী দুই দশক ছিল ভারতীয় মহিলাদের উন্নতির পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্ব! এই সময় পর্বে মহিলাদের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি রূপায়ণ করা হয়! তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আমলে মহিলাদের উন্নতির জন্য আরও জনমুখী কর্মসূচি তৈরি করা হয়। সাতের দশকে পর থেকেই ভারতীয় মহিলাদের শিক্ষা দীক্ষার প্রবণতা অনেক বেড়ে যায়! ধীরে ধীরে মহিলাদের সাক্ষরতা হারও বাড়তে থাকে। তবে বিশ্বায়নের পরবর্তীকালে অর্থাৎ নয়ের দশকের পর থেকেই মহিলাদের শিক্ষার দীক্ষার প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পায়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে থেকেও তারা ধীরে ধীরে নিজের অধিকারগুলো আয়ত্ত করতে থাকে।
বর্তমান শতাব্দীর শুরু থেকেই মহিলারা, শিক্ষা দীক্ষায় নিজেকে আরও খুর ধার করার চেষ্টা করে, বলতে গেলে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নতির ফলেই ভারতীয় সমাজ জীবনের নানান পরিবর্তন সূচিত হয়, সমাজ ব্যবস্থার কঠোরতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়, ফলে ভারতীয় মহিলারা আরো নিজেকে মিলে ধরার চেষ্টা করে! বর্তমান সময়ে তো তারা সরাসরি পুরূষতান্তিক সমাজকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে, বর্তমানে বিভিন্ন বোর্ড কাউন্সিল এবং বিশ্ববিদ্যালয় দিকে নজর দিলেই তা মালুম হয়, সর্বত্র মহিলাদের সংখ্যাধিক্য! বর্তমানে সর্বভারতীয় পরীক্ষায় মহিলাদের সাফল্যের হার অনেক বেশি! তাই সেই হিসেবে আমরা বলতে পারি যে অদূর ভবিষ্যতে সুপ্রীতির মতো মহিলারা শুধু শহরে নয়, গ্রাম গঞ্জে বিভিন্ন কর্ম যঞ্জে ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং সর্ব ক্ষেত্রে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে!!
লেখক পরিচিতি:: বারিদ বরন গুপ্ত,মন্তেশ্বর পূর্ব বর্ধমান, কবি সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক গবেষক সমাজ সংস্কৃতি বিষয়ক লেখালেখিতে যুক্ত আছেন