Begum Jahan Ara

শাখামৃগ বৃন্দ ও নালায়েক যুবকটা
বেগম জাহান আরা

হাঁসফাঁস করে উঠে বিছানায় বসে তমাল। শালা স্বপ্নের বাচ্চা। গুষ্টি বেচি তোর। আর কোনো টপিক পেলিনা দেখানোর! গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সাইড টেবিলে রাখা বোতল মুখে ধরে পানি খেলো। তাড়াতাড়ি করার জন্যেই বোধ হয় নাক মুখ দিয়ে গড়িয়ে পড়লো কিছু পানি। গায়ে এসব জবরজং কি? টিসুর জন্যে হাত বাড়ালো। পেলো না। তাই তো, পড়ার টেবিলে রেখেছে। মানে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে আনতে হবে। ধুর! তার চেয়ে ভালো লুঙ্গির খুঁট।

নাক চোখ মুছে তমাল আবার শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম পালিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ঘরের ভেতর ওরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কি আপদ! অবাক হয় তমাল। ভাবে, তার ঘরটাই এতো পছন্দ হতে হবে কেনো ওদের? তিন লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে, থুককু, উপহার দিয়ে ঢাকায় জয়েন করার ব্যাবস্থা করেছে। উপহারের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে গ্রামের সামান্য যা কিছু ছিলো, তা বিক্রি করতে হয়েছে সব। পুকুর , ভিঁটে, আম কাঁঠালের গাছ, মায় দুধেল গাইটা পর্যন্ত। ভিঁটের ওপর শোয়ার কুঁড়ে ঘরটা শুধু আছে। বাবা থাকেন। বড়ো দুই ভাই পাশের গ্রামে অবস্থাপন্ন গৃহস্থ ঘরের মেয়ে বিয়ে করে সেখানেই ঘর বসত করে। তার এই ছোট্ট ঘরে সে তাদের চেয়ে ভালো আছে। কারন, তার স্বপ্ন আছে। স্বপ্ন ছাড়া জীবনের মূল্য কি? ভাইদের স্বপ্ন নেই। সে সংগ্রাম করে উন্নত জীবনের জন্যে। ভাইয়েরা বলদের মতো খাটে, গ্রামের মাতব্বর হওয়ার জন্য। ওরা কৃষি খামারের মালিক হওয়ার কথা পর্যন্ত ভাবে না।

বৃত্তি পেয়ে পেয়ে পড়েছে তমাল। অংকের পন্ডিত স্যার আর বাঙলা ম্যাডামের
উৎসাহ না পেলে তাকেও জমি জিরেত দেখে খেতে হতো। করপোরেট অফিসে চাকরিটাও স্যার এবং ম্যাডামের জন্যেই হয়েছে। তারপরেও ইপহার দিতে হয়েছে। মনের ইচ্ছে, বছর দুয়েকের মধ্যে গ্রামের পাট চুকিয়ে দিয়ে গাজীপুরে নিয়ে আসবে বাবাকে। তারপর বিয়ে, সংসার, ছেলেপুলে। বড়ো বাড়ি হবে। বাবার জন্যে কাজের লোক রেখে দেবে। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া। বিদেশ পাঠানো। সময় তো পাখির মতো উড়ে যাচ্ছে। এক বছর কোথা দিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি।

আউ! আঁতকে ওঠে তমাল। আবার ওদের চলা ফেরার শব্দ। মনে হলো, লাফিয়ে পড়লো কেউ বিছানায়। একটা পাকা বাড়ির একটা রুমে সাবলেট থাকে। ঘর লাগোয়া ছোট্ট বারান্দার কোনায় চাল ডাল ফুটিয়ে নেয়। ভালোর মধ্যে একটা এটাচড বাথরুম আছে। যদিও চিপা, তবু স্বাধীনতা আছে। ঘুম তো গেছেই, বাথরুমে যেতেও ভয় করছে। রীতিমতো ঘামছে তমাল।

কিন্তু এ কি! এটা তো তার ঘর মনে হচ্ছে না। তার পাড়াতুতো চাচার সাথে একদিন পুরান ঢাকার দৈনিক এক পত্রিকার অফিসে গিয়েছিলো। মনে হচ্ছে সেই রকম মিটিং ঘর। ভালো করে তাকিয়ে দেখে, দেয়াল সরে সরে বড়ো হচ্ছে ঘরটা। শাখা মৃগরা তো প্রথম থেকেই ছিলো। এখন মানুষেরাও এসে বসছে। ডেকোরেটদের সস্তা প্লাস্টিকের ছাই রঙা চেয়ার পাতা সারা ঘরে।

তমাল চিনতে চেষ্টা করে মানুষদেরকে। বিশাল ঢাকা নগরে এক বছরে কাউকেই চেনা হয়নি। বন্ধুত্ব হয়নি কারও সাথে। শুধু মুখ চেনা চিনি। দেখা হলে, ‘হাই হ্যালো’। একটু হাসি। ব্যাস। তবু কিছু কিছু মানুষকে চিনতে পারলো। প্রায় রোজই পত্রিকায় ছবি আসে ওদের। ওঁরা কেউ কেউ পত্রিকার মালিক। কেউ মন্ত্রি। কেউ ব্যাবসায়ী, কেউ সাংবাদিক, কেউ নেতা। বাকিরা কিছু নাতি নেতা, ছাতি নেতা, জুতো নেতা, ঝাঁটা নেতা, চাটা নেতাকেও দেখা গেলো। ওরে বাবা, তার ধনী বসকেও দেখা যাচ্ছে। অফিসের ফোন অপারেটর মিনুকেও দেখা যাচ্ছে বেশ সেজেগুজে এসেছে। বস আজকাল মিনুকে বেশ পছন্দ করছেন। ফিস ফাস হয় এই নিয়ে অফিসে।

টেবিল চাপড়ে কিছু ঘোষনা দিচ্ছে এক মস্ত স্বাস্থবান শাখা মৃগ। আরেব্বাহ! সে তো দিব্যি মানুষের ভাষায় কথা বলছে। স্বরটা একটু নেকো। সাজ পোশাক বনেদি মানুষের মতো। হাফ হাতা রাজশাহি সিল্কের সার্ট আর পায়জামার সাথে ঘাড়ে ঝোলানো একটা চাদর। পায়ে জরির হালকা কাজ করা চপ্পল। ডান হাতে পান্না বসানো রুপোর আংটি। ঢল ঢল করছে। খুলে না গেলে হয়! বেশ অভিজাত লাগছে।

  • আমার প্রিয়জনেরা, আজ মিটিং ডেকেছি বিশেষ বিপদে পড়ে। আপনারা এসেছেন, ধন্যবাদ জানাই। কিছুদিন ধরে আমরা খেয়াল করছি, মানুষ অকারনে আমাদেরকে নির্যাতন করছে। কদিন আগে একটা এলাকায় বিষ প্রয়োগে আমাদের প্রায় পঞ্চাশজন সদস্যকে হত্যা করেছে তারা নির্মম ভাবে। সেটা আবার পত্রিকায় ফলাও করে ছাপানো হয়েছে। কি ধৃষ্টতা! তাদের মধ্যে আমার মেয়েটার নিরপরাধ জামাইও ছিলো। আহা বাছা! কতোই আর বয়স হবে! হঠাত দুই হাতে মুখ ঢেকে শব্দ করে কাঁদতে শুরু করে সর্দার শাখামৃগ।

দেখা দেখি অন্য অনেক শাখামৃগ দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো। কি অবাক, মানুষেরাও কাঁদছে। তাদের কাঁদার কারন কি? তমালের চোখে পানি নেই। কান্নাও আসছেনা।

পাশে থেকে এক শাখামৃগ গায়ে ধাক্কা দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, আপনি কাঁদছেন না কেনো?
-আমার কান্না আসছে না।
-না আসলেও দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নার ভান করেন।
-চোখে তো পানি আসবে না।
-নিকুচি করি সৎ মানুষের। চোখে অনেকেরই পানি নেই। তবু নেতাকে সঙ্গ দিচ্ছে। দেখছেন না?
-কান্নার আবার সঙ্গ দিতে হবে কেনো?
-এই চুপ, চুপ। কে যেনো হিস হিস করে বললো।

-ভাইসব, নেতার গলা শোনা গেলো আবার, সংক্ষিপ্ত সভায় বেদনাভারাক্রান্ত হৃদয়ে শুধু কয়েকটা কথা বলার জন্যই এসেছি। মনে রাখতে হবে, আমরা মানুষ নই, শাখামৃগ। কর্নাটকে হাম্পির কিষ্কিন্ধার পুন্য ভুমিতে আমাদের পুর্বপুরুষের বাস। পুন্যতোয়া তুঙ্গাভদ্রানদীর লালনে চিরসবুজ দন্ডকারন্যের গল্প এখনও প্রজন্মের মুখে মুখে। বাগদাদি সৈয়দের যেমন আলাদা বংশ মর্যাদা আছে , কিষ্কিন্ধার আদি বাসিন্দা হিসেবে আমাদেরও আছে তেমনি বংশ মর্যাদা। বাপ দাদার কাছে শুনেছি, আমরা চিরবরেন্য সুগ্রীবের বংশধর। আমরা মিছে কথা বলি না। ঘুষ খাই না। পুকুর চুরি করি না। মিছে ডাক্তারি সার্টিফিকেট দিই না। করোনার মতো ঘাতক রোগ নিয়ে ব্যবসা করি না। পরের দেশে টাকা পাচার করি না। আমাদের সমাজে ধর্ষণ নেই। মানুষ আমাদের একটাই দোষ ধরে, আমরা ফ্রি সেক্সে বিশ্বাস করি। কিন্তু মানুষেরাও কম যায় না। ওরা বলে না, আমরা বলি। ওরা ফ্রি সেক্সের অভাবে পরকীয়া নিয়ে খুনোখুনি করে। আমরা করি না। আমরা আপোসে বিশ্বাসী। যাক সে কথা।

বিচিত্র ধ্বনিতে হাসির রোল শোনা গেলো। বয়সি শাখা মৃগিরা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো লজ্জায়। অল্প বয়সি পুরুষ মহিলা শাখামৃগ মৃগিরা তাদের টাইট ছেঁড়া ফাঁটা জিন্সের প্যান্টের দিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে গেলো। সরু সরু লাঠির মতো পা হওয়ার জন্য কারও কারও পা বের হয়ে গেছে ছেঁড়া জায়গা দিয়ে। বেচারারা, মানুষের মতো করে ছেঁড়া ফাঁসা ফুটো কাটা জিন্সের প্যান্ট সামলাতে পারেনা এখনও। তবু নিজেরা নিজেরাই টেনে টুনে ঠিক করে নিলো স্মার্ট যারা। শাখামৃগিরা কেউ ওড়না পরে না। বুকের মাপের চেয়ে ছোটো কাপের ব্রা পরেছে সিনেমার সেক্সি নর্তকিদের মতো। সেগুলো দেখে নিলো একবার।

নেতা বলে যাচ্ছেন, তবে খাওয়া দাওয়াটা জোটাতে হয় এখান ওখান থেকে। বনে জঙ্গলে বিধাতা আমাদের জন্য প্রচুর খাবার দিয়ে রেখেছেন। তবু কিছু দুষ্টু ছেলেমেয়ে মাঝে মাঝে মানুষের ঘরে ঢুকে কিছু খাবার নিয়ে আসে। কি আর এমন সেটা! এই রুটি বিস্কুট বাদাম কলা এই সব। সেই জন্য বিষ দিয়ে আমাদেরকে হত্যা করা হবে? কতো শিশু মা বাবা হারালো। এতিম বাচ্চাগুলোর কি হবে এখন?

আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সর্দার। এবার হেঁচকি উঠে যায়।

হই চই করে কেঁদে ওঠে সভায় উপস্থিত সবাই। এবারেও তমাল কাঁদে না। পাশের শাখামৃগটা বললো, সমস্যা কোথায় আপনার? কাঁদছেন না কেনো এখনও?
-কিছু বুঝতে পারছি না।
-মানুষের বুদ্ধি যে আমাদের চেয়ে কম, সেটা জানি। কিন্তু আপনার মাথায় তো দেখি মুরগির মগজও নেই। শুরু করেন। কাঁদেন। দল করতেও শেখেন নি?
-দল করে কি হবে?
-এখনও বোঝেন নি? আসলে মুরগিও না আপনি। এতো দেখি কেঁচো প্রজাতির। বড়শিতে গেঁথে নেয়ার পরেও বুঝতে পারেন না যে, গেঁথে গেছেন।। আরে ভাই, দল করলে গাছেরটা খেতে পারবেন, তলারটাও পারবেন।
-আমি দল করতে চাই না।

  • এমন কথা তো আগে শুনিনি কোনও দিন। দলে ভেঁড়ার জন্য নাতিনেতাদের পায়ের জুতো পালিশ করে দেয় মানুষ, আর আপনি বলছেন দল করতে চান না।
  • না, চাই না।
  • কোন ভাগাড় থেকে এসেছেন জনাব?
  • আমি ঢাকায় থাকি।
  • কোন গুরু আপনাকে দল করতে না করেছে?
  • সে জন্যে গুরু লাগে নাকি?
  • বড়োই সেয়ানা দেখি। চটকানা খাননি তো!
  • চটকানা খাব কেনো?
  • খিংটক পালোয়ান থাকলে এতোক্ষন আপনার ভোতা মুখ থোতা করে দিতো।
  • পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছেন আপনি। জানেন আমি কে?
  • কুখ্যাত ভাগাড়ের, অখ্যাত গাঁয়ের, কেঁচো পাড়ার, গুবরে পোকা আপনি।
    এবার রেগে যায় তমাল। সত্যি কথাটা বলি তাহলে। আমার একজন
    রাশিয়া ফেরতা কাকু আছেন। তিনি আমাকে ‘না’ করেছেন দল করতে। বলেছেন, সমাজতন্ত্রের মতো বিশাল দল, বিশাল আদর্শের ভান করেও টেকানো যায়নি দল। ভেঙে গেলো অতো বড়ো দেশ। আর আমাদের দল তো কোনও পদেরই না। কোনো আদর্শই নেই। ভেতরে ভেতরে শুধু কোন্দল। শুধু খাঁই খাঁই। কেনো খাঁই , তাও জানে না।
    -আপনার কাকু একটা আস্ত গাড়ল।
    -কি যা তা বলেন? ঐতো নেতার পাশে বসে আছেন, ঐ যে মস্ত মোটা মতো, কাগজে ছবি দেখেন না রোজ রোজ, ওই মন্ত্রিই আমার সেই কাকু।
    শাখামৃগটা নিজের হাতে দুই কান ধরে জিব কাটলো। বললো, থুককু ভাই। আমার কথাটা আপনার মন্ত্রি কাকুকে বলবেন না প্লিজ।
    -ও কিছুনা। অনেক খারাপ খারাপ গালি ওদের সহ্য করতে হয়। আমার সামনেই কতো লোকে অকথ্য গালি দেয়। মুখে মুখে জুতো পেটা করে। সাধে কি পরিচয় দিই না?

-এই যে, এতো ফিস ফাস কি? কান্না ফেলে কথা বলছেন কেনো? বেজায় ক্যাটকেটে গলায় ধমকে ওঠে এক শাখামৃগি। ভাব সাব ব্যাজ দেখে মনে হয়, নেত্রী। অন্ততপক্ষে চাটা নেত্রীতো বটেই। বলে, এই যে মুখ ঢেকে কাঁদেন শীগগীর। না হলে মরিচ পানির স্প্রে আছে। স্বেচ্ছাসেবকেরা এসে দিয়ে যাবে চোখে। নেতার হুকুম আছে, সবাইকে চোখের পানি ফেলতে হবে।

-আপনারা জানেন, নেতা আবার বলা শুরু করেছে, সেই রাম রাজত্বের আমল থেকে আমরা মানুষের অনুগতো। আমরা মানুষদেরকে ভালবাসি। রাক্ষস রাজা রাবনের সাথে যুদ্ধের সময় জীবনের মায়া ত্যাগ করে আমাদের পুর্ব পুরুষেরা রামের পাশে পাশে থাকতো।
রাবনের পুত্র ইন্দ্রজিতের সাথে যুদ্ধে রাম লক্ষ্মণ যখন প্রায় মরো মরো, তখন আমাদের পুর্বপুরুষেরাই তাদের বাঁচিয়েছে। আহা, কতো শাখামৃগ শহিদ হয়েছে, তা লেখা আছে আমাদের শাখামৃগ ‘কিঞ্চিত পুরানে’। কিষ্কিন্ধা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে সোনার কাসকেটে রাখা আছে সে গ্রন্থ। যে কেউ গিয়ে পড়তে পারে। একুশ শতকে শহিদ শাখামৃগদের স্মরণে একটা ‘শহিদ মিনার’ গড়া হয়েছে। আহা, কি তার শোভা! পর্যটক ভেঙে পড়ে প্রতি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ তারিখে। ইতিহাস জানে, আমরা বিশ্বাসী। নিরীহ। ন্যায়পর প্রাণী। বিনয়ী। সে যাক। কিন্তু আজ কিছু কথা না বললেই নয়।

একমত প্রকাশের জন্য বিচিত্র প্রকার উল্লাসকর শব্দ শোনা গেলো।

নেতা দম নিয়ে বলেন, অনেক ভেবে দেখেছি, মনুষ্য সমাজের অধিকাংশ যদি অমানুষে ভরে যায়, তাহলে নরক হয়ে যায় পরিবেশ। সৃষ্টির সেরা জীবেরা যদি শেয়াল, কুকুর, বাঘ, সাপ, শকুন এবং কুমীরের মতো আচরন করে, তাহলে আমাদেরও চরম ভুগতে হয়। ওরা শুধু টাকা চুরি করে, তাই নয়। আরও দশ জনকে চুরির ভাগ দিয়ে , কোটি কোটি টাকা পাচার করে নিয়ে যায় পরের দেশে। ছি! ছি! এতোটুকু দেশপ্রেম নেই। আমাদের কেউ এমন কাজ করেছে? কিষ্কিন্ধা আমাদের আপন ভুমি, বাপ দাদার স্পর্শ লেগে আছে ভূমিতে, সেখানেও কেউ টাকা পাচার করে রেখেছে কি? পরের দেশ তো দুরের কথা।

-না ,না, কেউ করেনি। বিকট বিচিত্র উল্লাসে চিৎকার করে শাখামৃগরা সহমত প্রকাশ করে।

-এই করোনাকালেও দেখছেন তো, পিপিই এবং মাস্ক নিয়ে মানুষ কি নির্লজ্জ নচ্ছারপনা করলো! আর ‘প্রপ্রিঞ্চি’ হাসপাতালের “করোনা নেই” সার্টিফিকেট বিক্রির কাহিনি তো বিশ্বলোকে জেনেছে। এতোদিন যে দুর্নীতি হয়েছে, তাতে দেশের মানুষের ক্ষতি হয়েছে। এবারের দুর্নীতি দেশটাকেই অছ্যুত করে দিয়েছে। ছিঃ! চিকিতসা নিয়ে কিছু বেশরম বেদরদী ব্যাবসার কথা আর কি বলবো! তাই বেশি কিছু নয়, কয়েকটা বিষয় মানতে হবে মানুষদের। এগুলো আমার কথা নয়। কিষ্কিন্ধায় তিনদিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক শাখামৃগ সম্মেলনে বিশদ আলোচনা হয়েছে বিষয়টা নিয়ে। মানুষের নিম্নমানে নামার দ্রুত গতি দেখে তাঁরা বিচলিত, বেচায়েন হয়ে পড়েছেন। সেখানেই তৈরি হয় নালায়েক, বেপথু, বেপরোয়া, বেলেহাজ, বেলেল্লা, বেদিল, বৈনাশিক, বৈহাসিক মানুষদের কাজের গাইড লাইনগুলো । আমরাও সবাই প্রকৃতির সন্তান। সম্ভব করতেই হবে মানুষের সাথে আমাদের সহ-অবস্থান। সেজন্য মানুষকেই —-, নেতা দম নেয়ার জন্য একটু থামেন।

এক নেত্রী শাখামৃগ দাঁড়িয়ে বললো, মানুষ কি আমাদের কথা মানবে নেতা?
-আলবাত মানবে। মাংকি হিলে আমরা তিন বাস ভর্তি মানুষকে কেমন শিক্ষা দিয়েছিলাম, মনে আছে তো? মুলক রাজানন্দের মতো সাহিত্যিক, ওর বউ আর বান্ধবিকে হাত জোড় করে দাঁড়াতে হয়েছিলো। ওদের পুনে যাওয়াটা বাতিল করেই দিয়েছিলাম প্রায়।

জানি, জানি, মনে আছে। বলেই হেসে ফেলে নেত্রী। অমনি বিচিত্রধ্বনির হাসির রোল উঠলো। থামতেই চায় না সে হাসি। এ ওর গায়ে পড়ে হেলে দুলে হাসছে সবাই। মনে হচ্ছে পাহাড়ের ওপর থেকে নুড়ি গড়িয়ে পড়ছে খচর মচর খিচিং মিচিং হিচিং শিচিং ঠুনুক ঠিনিক শব্দ করে।

শাখামৃগ ফিস ফিস করে তমালের কানে কানে বললো, স্বল্পতমো পোশাক পরে মানুষগুলো ঘুমিয়েছিলো রাতে। সবার সমস্ত পোশাক নিয়ে গিয়েছিলো শাখামৃগরা। কারণ, জানালার ওপর থেকে একটা কলা নিয়ে খাচ্ছিলো পিচ্চি ‘চিন্নি’ সোনা। মাত্র কমাস বয়স। ঐটুকু বাচ্চার কান ধরে দুই চড় মেরেছিলো একজন। শিশু প্রহার আমাদের সমাজে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ব্যাস! সকালে কেউ আর বাইরে বেরোতে পারে না। মুলক রাজানন্দের তো শর্টস পরার অভ্যেস। উদোম গায়ে শর্টস পরে সেই বেরিয়ে এসে হাত জোড় করে দাঁড়ালো প্রথমে। সাথে তার বিকিনি পরা বৌ আর বান্ধবিও। সে কি দৃশ্য! হি হি হি—

নেতা আবার কথা বলার জন্য গলা ঝেড়ে প্রস্তুত হচ্ছে, এমন সময় মিষ্টি একটা বাচ্চা শাখামৃগ ‘বাবা বাবা’ বলে লাফিয়ে নেতার কোলে এলো। তার হাতে একগোছা লাল টুকটুকে লিচু। কার গাছ থেকে পেড়েছে, কে জানে!

ধমকে উঠলো নেতা। বললো, এখানে কেনো? মা কোথায়?
-বলেছিলাম মাকে আসতে, এলো না।
-সে জানে, অন্য মানুষদের মতো আমি বউ , বাচ্চা, অনুচর বা চাটার দল নিয়ে অনুষ্ঠানে যাই না। যাও তুমি এখান থেকে। বেশ জোরেই ধমক দেয় বাচ্চাকে আবার।

অভিমানে কেঁদে ফেললো বাচ্চাটা। তার কান্নার মিহি শব্দটা ঠিক ইস্রাফিলের শিঙ্গা ফোঁকার মতো মনে হলো। দাদি যেমন গল্পে বলেছেন, ঠিক তেমনি বাজছে তো বাজছেই। ক্রমশ বাড়ছে আওয়াজ। কি তীক্ষ্ণ আওয়াজ! ফেটেই যাবে কানের পর্দা মনে হচ্ছে। কি আশ্চর্য, আজই কি এই গ্রহটা ভেঙে গুঁড়িয়ে জাররা জাররা হয়ে যাবে? রোজকিয়ামত শুরু হয়ে গেলো? শিমুল তুলোর আঁশে ভরে গেলো ঘর। ঝাপসা হয়ে এলো ঘরের আলো। আতংকে ঘর থেকে পালাতে চাইলো সে।

একটু নড়তেই মনে হলো, কে যেনো প্রচন্ড জোরে আঘাত করলো মাথায়। তড়বড় করে নামতে গিয়ে স্ট্যাণ্ডে প্যাচানো মশারিসহ জবরজং অবস্থায় তমাল মেঝেতে পড়ে গেলো বেশ বেকায়দায়। চিবুকের কাছে কেটে গেলো। রক্তও পড়লো কয়েক ফোঁটা। লুঙ্গির খুঁট দিয়ে রক্ত মুছতে গেলো। টান লেগে গিটঠু খুলে গেলো লুঙ্গির।

ওই অবস্থাতেই মশারির ভেতর দিয়ে আতংকিত চোখে খুঁজলো শাখামৃগদের। নাহ, কেউ কোথাও নেই। কি আশ্চর্য! ঘর ভরা শাখামৃগরা গেলো কোথায়? অনেক কষ্টে মশারির প্যাঁচ কিছুটা ছাড়িয়ে উঠে বসে তমাল। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে তখনও। উঠে দাঁড়াতে পারছেনা। মশারির ওপর বসে পড়ে আবার।

ধিরে ধিরে মনে পড়ে, গতো সন্ধ্যার কথা। দিলদারের দেয়া সরবত খেয়েই কেমন যেনো লেগেছিলো। ঢাকায় এসে এই প্রথম তার ইফতারের দাওয়াত। কানা ঘুঁষো শুনেছে আগেই, দিলদার নাকি সস্তা নেশা করে। বিড়ি সিগারেট গাঁজা চরস আফিম এই সব খায়। তা খেতেই পারে। একা মানুষ। দেশে মা বাবা ভাই বোনদের জন্যে টাকা পাঠাতে হয়। ঘর বাঁধতে পারেনি এখনও। হতাশাও থাকতে পারে। কিন্তু বন্ধুবাজ ছেলে। প্রাণ আছে। বিরাট প্রাণ। ভালো লাগে তমালের। তার দাওয়াতে তাই গিয়েছিলো। কিন্তু নেশার সরবত খাওয়ানোটা উচিত হয়নি দিলদারের।
বলেছিলো, দোস্তো সরবতটা এমন কেনো?
-ও কিছু না। আমি রোজ খাই। খেয়ে নে, বায়নাক্কা করিস না।
-শরীরের মধ্যে কেমন যেনো করছে।
-একটা ঘুম দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। মনও ভালো হয়ে যাবে।
-কিন্তু জিনিসটা কি দোস্তো? কখনও খাইনি তো।
-মেয়েমানুষের মতোঘ্যান ঘ্যান করিস না। নালায়েক, নেকু, ঢাকায় থাকবি কি করে? বলছি তো সব ঠিক হয়ে যাবে।

অনেক আয়োজন করেছিলো দিলদার। তেহারি এনেছিলো কলাবাগানের বিখ্যাত দোকান থেকে। সাথে ছিলো জিলেপি, বুন্দিয়া, কলা, খেজুর, তরমুজ, আম এবং আনারস । সত্যি দিল আছে ছেলেটার। কতোদিন খায়নি এইসব!
-এখন আম উঠেছে বাজারে? তমাল অবাক হয়।
-কি বলিস দোস্তো, কবে থেকেই তো বাজারে আসছে আম।
-অনেক দাম না?
-তা দাম তো হবেই। যাদের সখ আছে, তারা খাবে।
-আনারস কি প্রতিবেশি দেশ থেকে আসে?
-এটা দেশের ফল। কয়েক বছর থেকে আমের আগে এই ছোটো ছোটো আনারস উঠছে বাজারে। মন্দ না। বেশ মিষ্টি। আসলে আমাদের দেশটা সত্যি সোনার দেশ রে। আমরাই হলাম খচ্চর।
হেসে বলে, এতো আয়োজন করেছিস দোস্ত।
-চোপ! মেয়েমানুষের মতো প্যানপেনে কথা বললে দেবো এক থাবড়া। এবার মন দিয়ে খা।

বাড়ি ফিরেছিলো প্রায় বারোটায়। প্রচুর ভোজন, নেশা এবং দিলদারের আপ্যায়ন সবই খুব ভালো লেগেছিলো তার। ঘরে ঢুকে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। কোনোমতে মশারীটা টাঙাতে টাঙাতেই গায়ে মশারী জড়িয়েই ধপ করে বসে পড়ে বিছানায়। নিদ্রাদেবি যেনো কোল পেতেই বসেছিলো। জাপটে নিলো কোলের ভেতর। জুতো মোজা জামা কিছুই খোলা হয়েছিলো না।

বেগম জাহান আরা

জুন, ২০২০, হামবুর্গ

Leave a Reply