
” মাতৃ ভাবনায় “
বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল
পিতৃপক্ষ শেষ হলে ও দেবীপক্ষের সূচনা কালের সময়কেই মহালয়া বলা হয়। পৃথিবীর বিনাশের সময় সাগরে পরিণত হলে শ্রীবিষ্ণু সেই সাগরের উপর অনন্তনাগকে শায়িত হয়ে যোগনিদ্রায় মগ্ন হলেন। বিষ্ণুর কর্ণমূল থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুই দৈত্য নির্গত হয়ে বিষ্ণুর নাভিপদ্মে স্থিত ব্রক্ষ্মাকে বধ করতে উদ্যোত হল। ভিত হয়ে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে জাগরিত করবার জন্য নয়নের আশ্রিতা যোগনিদ্রাকে স্তব করতে লাগলেন। সৃষ্টি হয়ে দেবী শ্রীবিষ্ণুকে জাগরিত করলে তিনি পাঁচ হাজার বছর ধরে মধু ও কৈটভের সাথে মহাযুদ্ধে রত হলেন। পিতৃপক্ষ আর দেবী পক্ষের সন্ধিক্ষণ হচ্ছে মহালয়া।
পৃথিবীতে অহরহ কত ঘটনাই না ঘটে চলেছে তার থেকে নেমে আসে দুঃখ। এই দুঃখ – কষ্ট – দুর্গতি থেকে বাঁচার উপায় কি ? মা দুর্গার উপাসনা কর, শাস্ত্রে আছে আসলে মা দুর্গা হলেন শক্তির প্রতীক স্বরূপা। পারমার্থিক অর্থে তিনি নারী পুরুষ কোনটিই নন। মনে রাখতে হবে দেবতাদের তেজ বা জ্যোতি থেকে দুর্গা দেবীর সৃষ্টি যা অনন্ত ও অটল শক্তির প্রতিমূর্তি। শক্তিময়ী সচ্চিদানন্দ স্বরূপ ” মা ” নামে অভিহিতা হন।
দুর্গা পূজোর ভাবগত অর্থ হল অন্তরের অশুভ রিপু গুলোর বিনাশ করা। একটা সহজ সত্য হল – আমাদের মনে যদি কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, পরপীড়নের ইচ্ছা অত্যধিক থাকে – – তাহলে কি আমরা আনন্দে, সুস্বাস্থ্যে বেশিদিন থাকতে পারি ? কখনই পারি না। মন অশুদ্ধ হলে নানা রকম রোগ ব্যাধি হয়। নানা অশুভ চিন্তা আসে, অর্থ লালসা ও কামপরায়ণ হয়ে উঠি। এভাবে আমরা ধীরে ধীরে জীবনের সব কিছু পতন ডেকে আনি। এজন্যই আমরা ফি বৎসর মহা ধুম ধামের সহিত শরতের আগমনে মাতৃ আরাধনায় মেতে উঠি।
বস্তুত মাতৃ ভাবনার মূল কথা হল জগতের সমস্ত কিছুকে মায়ের প্রতিরূপ বলে শ্রদ্ধা ও সম্মান করা। পূজা করা। চণ্ডীর এই সব মাহাত্ম্য চিন্তন করলে, স্তব স্তুতি গুলি ভক্তি সহকারে পাঠ করলে মনে মাতৃ ভক্তি জাগে। ” মা ‘” ই বিশ্বজগতে তথা আমাদের জীবনে সবকিছু করেন এবং করবেন— এই ধারনা বলবতী হই। আর এই ধারণা তো বাস্তবিক সত্য। কারণ আমাদের প্রত্যেকের জন্মের আগে পৃথিবী তৈরি হয়েছে। আকাশ – বাতাস – মাটি জল গাছপালা ফল ফুল মানুষ জন সমাজ স্নেহ ভালো বাসা সকলি হয়েছে। আমরায জন্ম নিয়েই এঁদের সান্নিধ্যে ও সাহচর্যে ধীরে ধীরে বড় হয়েছি, কিন্তু মোহে পড়ে এই সব মাতৃরূপকেই ভুলে গেছি। মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ ও শরণাগত হতে পারি না। আদ্যাশক্তি জগতের সবার মা। সত্য সত্যই মা। এই বিশ্ব মায়ের ক্ষুদ্র সংস্করণ হল আমাদের গর্ভ ধারিনী মা, ঘরের মা বোন, সব নারীই।
দেবী ধর্ম – অর্থ – কাম ও মোক্ষ দায়িনী। তার কৃপা লাভই আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। আর আমরা আজ দিকে দিকে মণ্ডপে মণ্ডপে থিম পূজোর আয়োজনে মেতে উঠেছি। এখনকার মানুষ মাতৃ আরাধনার চাইতে প্যাণ্ডেল সজ্জায়, আলোক সজ্জায়, থিমের দিকে বেশি নজর দিতে গিয়ে ধীরে ধীরে সাবেক নিয়মে মায়ের পূজো থেকে যেন অনেকটা দূরে সরে এসেছি।
গদীবেড়ো, রঘুনাথপুর, পুরুলিয়া