কঙ্কাল তুই আয় – ড . ময়ূরী মিত্র
সে ছিল আর এক সময় | নাগেরবাজারে আমাদের অঞ্চলটায় তখনো উচ্চতলার খোপপঘরের সংখ্যা তখনো কম | পুরোনো দেয়ালে গাছ গজানো ঘরপাতি তখনো দেখা যায় |
আজ যেথায় আমার ঘর ,তার ঠিক দশ কুড়ি পা দূরে ছিল মস্ত এক পুরানা বাড়ি | রোজ দেখতাম | ঘুরেফিরেই দেখতাম বাড়িটাকে | দিনের মধ্যে দু তিনবার করে দেখতে দেখতেই বাড়িটার প্রতি একটা ঘোর জন্মাচ্ছিল আমার | মেঘের ছায়া পড়া শীতল দুপুরে যেমন জীর্ণ কাঁথা তোষকে মানুষের একটা মায়া জন্মায় —জন্মাতেই থাকে —ঠিক অমনটা |
মায়ায় জড়াতে জড়াতেই আধখানা ছাদ উড়ে যাওয়া বাড়িটাকে মনে করতাম পুজোর শেষের ক্লান্ত কালী — যার বিসর্জন হয়েও হয় নি | খড় বেরিয়ে আসা কালীপুতুলটিকে যেন ফের নড়া ধরে তুলে এনে বসানো হয়েছে গঙ্গাপাড়ে —-নতুন বাহার পাবে বলে অপেক্ষায় সে কালী | ঠিক ঐরকম লাগত রঙিন ফ্ল্যাটের মধ্যে ঝুপুস বসা কেলে বাড়িটাকে |
বাড়িটায় ঢোকার মুখে যে জিনিসটা আমায় প্রথম জ্বালাতন করত তা হলো বাড়িটার গাছে বসা নিশ্চুপ পাখিগুলো | বর্ণহীন এইসব পাখির দল কোথা থেকে এসে জুটত , কেনই বা কথা না বলে অনাদিকাল তারা থম মেরে থাকত কে জানে ! কিন্তু ভারী অবাক হতাম জানেন ? —- দেখতাম সে পাখির দলে নেই একটিও হলুদ সবুজ বদরী | ক্রমশ ঐ সার সার বেমালুম চুপচাপ পাখিগুলোকে বাড়িটিরই একটি রকম বলে ধরে নিয়েছিলাম | সে তবু একরকম হলো |
সবচেয়ে নিরাশ হতাম যখন দেখতাম বাড়িটার খেসটো লাল বারান্দায় বসে আছে এক হাড় জিরজিরে মিশকালো বুড়ো | ফিনফিনে মসলিন সুতোর মতো কাঠি হাতপায়ের পাহারাদারটির নাম দিয়েছিলাম মিহিকঙ্কাল | বাড়িটার সাথে সাযুজ্য রেখে লোকটার এই নামটিই যুৎসই লেগেছিল আমার | অদ্ভুত নিরাসক্ত চোখ | সে চোখ আসতেও বলে না —এলে মানাও করে না |
মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে বাড়িটায় ঢুকতে লোভ লাগলেও অন্তত মিনিট পাঁচেক দেরি করে ফেলতাম লোকটির চোখে চোখ রাখতে গিয়ে | নিষেধ বা আহবান মানুষের পথ নিশ্চিত করে | হ্যাঁ বা না কোনোটাই না করে অনিশ্চিত বুড়া কঙ্কাল কেবল ধন্দই বাড়িয়ে যেত আমার |
ফুটপাথের কচুরির দোকান থেকে মিহিকঙ্কাল সম্বন্ধে খবর নিলাম। এক ফাজিল কচুরিখোর বললো —-কঙ্কালের বউ তো পালিয়েছেই এবং যেদিন বৌ পালালো সেদিনও নাকি এমনি casual ছিল কঙ্কাল | পালাবার পরেও বৌয়ের প্রেমিক নাকি মিহিকঙ্কালের সাথে বসে থালাভর্তি ভাত খেয়ে গ্যাছে | বউয়ের দু নম্বর ভাতারের সাথে জোড়া থালায় ভাত খেতে খেতে জীবনে নাকি প্রথমবার লোলুপ হাসি হেসেছিল মিহি |
কী ঘেন্না ! কী মধুর সে গা গুলোনো | মিহিকঙ্কাল সম্বন্ধে একচুলও ভিজত না কি মন ? কতদিন রাগ করে ভেবেছি –সত্যি তো ! এক মরাকাঠে কতকালই বা শরীর ঘষবে বউ ! মিহিকঙ্কাল নিয়ে গুছিয়ে খিস্তি চালাতাম | রসে ভরতো জিভ | মনে ফুটফুটে জোছনা | আরে তখন তো আমি এক ফুটের মেয়ে ! ল্যাম্পপোস্ট খুঁজি — গা ঠেসব তো !
শীতের সন্ধ্যা গড়াগড়ি দেয় | ফিরতি পথে দেখি , বারন্দায় বাল্বের কম কম আলোয় সে বসে | ধোঁয়া ধোঁয়া সে সব সন্ধ্যেতে আরো আবছা হয়ে যেত কঙ্কাল | না দেখেও বুঝতাম এখনো লাজহীন চোখদুটি সে যে মেলেই রেখেছে মেইনগেটে |
বাড়িটি ভাঙা পড়েছে | ভাঙা ইঁটে লাথ মেরে এখন নয়া বসত | সেখানে যেতে নেই মানা | তবু পা সরে না | সাজানো গেটে হাসিমুখে দারোয়ান | আমি খুঁজি তারে | আমার মিহিকঙ্কাল | রঙহারা কালীপুতুল |
দেশ ভরছে খিদে খিদে চ্যাটালো মানুষে | কঙ্কালদলে কোথায় খুঁজি আমার না হওয়া ভাতারকে ?
জাগ কঙ্কাল জাগ