Dr. Taimur Khan

প্রবন্ধ

জয়নাল আবেদিনের কবিতা আত্মমুক্তির ঘোষণা 

🍁

তৈমুর খান 

🍁

“একক মানুষ শুধু অগ্নি নয়, অগ্নির চেয়েও আরেক বৃহৎ আগুন” ‘একক মানুষের কবিতা’য় এরকমই লিখেছেন জয়নাল আবেদিন (১৯৫৯-২০২২)। এই আগুন জীবন সংগ্রামের। এই আগুন ন্যায় ও সত্যের। এই আগুন আবহমান মানবচেতনার। জীবনের অনন্ত তাড়না থেকেই কবিতায় নিবেদিত এই একক মানুষটি বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে চিরদিনই উপেক্ষিত থেকে গেছেন। বীভৎস দারিদ্র্যের মধ্যে দাঁড়িয়েও নিজস্ব ভঙ্গিতে আত্মমুক্তির ঘোষণা করেছেন। তাই কবিতা তাঁর কাছে কখনো বিলাসিতা হয়ে ওঠেনি। বরং জীবনের এক অমোঘ বিশল্যকরণী যাকে ধারণ করেই তিনি এই জন্মের গরল গ্রহণ করেছেন। কখনো লড়াই থেকে পিছিয়ে আসেননি।

     কবি হিসেবে যেমন, মানুষ হিসেবেও তেমনি অত্যন্ত অনাড়ম্বর সহজ সরল জীবনপথের পথিক ছিলেন জয়নাল আবেদিন। আজীবন দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে শ্রমজীবী মানুষের জীবিকায় স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজেছেন। বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে নিজেকে চেনানোর দায়ও তাঁর ছিল না। মানসম্মান যশখ্যাতি পাওয়ার জন্যও কখনো ব্যাকুল হয়ে ওঠেননি। জীবিকার টানাপোড়েনে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে কীভাবেই বা তিনি কাব্যক্যারিশমা জাহির করবেন? সুতরাং নিয়তিকে মেনে নিয়েই তিনি নিয়তিবাদী মেঠোজীবনের ধুলিমলিন রূপকে আজীবন বরণ করে নিয়েছেন। মৃত্যুর পরেও যদি তাঁকে আমরা ভুলে যাই, তবে আত্মবিস্মৃতি জাতি হিসেবে বাঙালির পরিচয়টিই বড় হয়ে থাকবে। আমরা প্রকৃত একজন কবিকেই অসম্মানিত করে নিজেদেরই ক্ষুদ্রত্বকে জানান দেবো।

    কবির একটিমাত্র কাব্য ‘সাঁঝের অনুস্বরে’ হাতের কাছে নিয়ে কবিকে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে তুলে নিলাম। বাংলা কবিতার বহু পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা বহুদিন থেকেই পড়ার সুযোগ হয়েছে। বহুদিন থেকেই তিনি মনের দুয়ারে করাঘাত করে চলেছেন। একটা সকালের মতো শান্ত ও স্নিগ্ধ তাঁর কবিতার আত্মা। একটা ছোট্ট বাগানের মতো তাঁর শব্দের আয়োজন। একটা জ্যোৎস্না প্লাবিত রাত্রির মতো অনন্তপ্রসারী তাঁর আবেগ। একটা মন ভালো করার আবেদনে ভরপুর তাঁর স্ফুরিত শব্দমালা। কখনো তিনি চড়ুই পাখির মতো উড়েছেন। কখনো মৌমাছির মতো গুনগুন শব্দে মধু সংগ্রহ করেছেন। কখনো এক হাঁটু ধুলোলাগা কৃষকের মতো মাটির রাস্তায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির আহ্বান করেছেন। তাঁর সাইকেলটিই জীবন সংগ্রামের যুদ্ধাস্ত্র। একমাত্র বাহন। সেটিকে নিয়েই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছেন। সুখ খুঁজেছেন। অসুখেরও আরোগ্য চেয়েছেন। স্বপ্নের কাছে বসে ভালবাসতে চেয়েছেন জীবনকে। নিজের সঙ্গে নিজের ভাষায় নিজের মতোই কথা বলেছেন। তাঁর কথায় উপমা নেই, শ্লেষ নেই, ভারী অলংকারও পরাননি কখনো। ভাবের সুচারু রূপ বা অমসৃণ রূপ, মুক্তরূপ বা অসংযত রূপকে অকপটে প্রকাশ করেছেন। তিনি ছলনা জানতেন না। বড় কবি হবার শখ নিয়েও কবিতা লিখেননি। জীবনের গতিকে নির্ণয় করেই নিজেকে টেনে নামিয়েছেন শব্দের কাছে। বারবার নিজেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। বেঁচে থাকা যখন কঠিন হয়ে উঠেছে,তার বোঝা আর বয়ে নিয়ে যেতে পারছেন না দেখেছেন; তখনই কবিতা লেখার প্রয়োজন অনুভব করেছেন। নিজস্ব কষ্টগুলি কবিতার শব্দতরঙ্গে আপতিত হয়েছে। নিজস্ব বেদনাগুলি কবিতার শব্দে অভিঘাত তুলেছে। কলঙ্কিত সময়, বিভ্রান্ত সুখ-ঐশ্বর্য আসলেই প্রকৃত প্রাপ্তিতে তাঁকে সমৃদ্ধ করতে পারেনি। তাই তথাকথিত ‘রাজবাড়ির’ প্রতীকে যৌনপল্লির সোপানকেই বুঝিয়েছেন ‘ফাঁক’ কবিতায়:

“রাজবাড়ি যাওয়ার পথ খোঁজ করতে আমাকে

 দেখিয়ে দিল যৌনপল্লির মোড়”

 ‘রাজবাড়ি’ বর্তমান সভ্যতার উচ্চকিত ক্ষমতাঘরের প্রতীক, যেখান থেকে ঐশ্বর্য, প্রশাসন, আইন,কৌশল সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু আসলে সেসব যে ভ্রষ্ট, অসামাজিক, ঘৃণ্য পথাচার তার উৎসকে বোঝাতেই ‘যৌনপল্লি’র ব্যবহার। প্রাত্যহিক ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য তৎপরতা কতখানি দরকার, তার জন্য নিজেকে নিজেই প্ররোচনা দিয়েছেন। কেউ যে তাঁর সহায়ক নয়, না দেশ, না দেশের শাসক। যাদের হাতে ক্ষমতা আছে তারা সেই যৌনকর্মীই। সকালের আলস্য ভেঙে কর্মযোগী হবার প্রয়াসে তাই স্বগত সংলাপ শুনতে পাই:

 “সূর্য উঠছে

 নদীর মতো অভিমান নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকো না

 চোখ খুলে নাও শিশিরের জলে

 পথের ভুল পথই ভুলে যাক।

 বাড়ছে বেলা

 জাগছে গাছ, জাগছে কার্নিশের রঙ

 ঘুরপাকে মোড়।

 আর দেরি করো না

 বেরিয়ে পড়ো

 যৌনকর্মীদের মিছিল বেরোনোর আগে

 তোমাকে পৌঁছুতে হবে নির্দিষ্ট ঠিকানায়।”

                                  (দাঁড়িয়ে থেকো না)

 যৌনকর্মীরা সেই রাজনৈতিক দল, যারা প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। কথার আশ্বাস-জাল বুনে মানুষকে ফাঁদে ফেলে শোষণ করে। দেশকে বেশ্যাখানায় পরিণত করে।

 কবি নিজের বৃত্তেই অবস্থান করেন। দৈনন্দিন কাজকর্মের ভেতর নিজেকেই ছড়িয়ে দেন। নিজেরই অবগাহন থেকে বারবার নিজেকেই তুলে ধরেন। কবিতায় সেই ব্যক্তি ‘আমি’র মধ্যেই সময় ও সমাজের উচ্চারণ, ব্যক্তিগত দিনপাতের মধ্যেই মহাসময়ের ধারণ নির্ণীত হয়। এখানেও তার অন্যথা হয়নি। যাপন ক্রিয়ার নির্বেদ মুক্তির প্রথম পরিক্রমাকেই তিনি লিখতে চেয়েছেন ‘আমি’ কবিতায়:

 “আমি সেই সকালবেলা

 ক্রিং ক্রিং বাজিয়ে তোমার ঘুম ভাঙাতে

 চলে এলাম,

 আমি একগুচ্ছ খোলা হাওয়া

 দরজা ঠেলে তোমার শরীর জুড়িয়ে দিলাম

 আমি ধুলো পায়ে তোমার উঠোন ভরাট করে

 রাগিয়েও দিলাম তোমাকে

 তাই বলে তুমি আমাকে গালমন্দ করো না।”

       খবরের কাগজ বিক্রির হকার হয়ে সাতসকালে বাড়ির দরজায় তা পৌঁছে দিতে আসেন। অনেকেই বিরক্ত হয়ে যান বেল্ বাজিয়ে ঘুম ভাঙানোর কারণে। কিন্তু কবি যে ‘খোলা হাওয়া’ অর্থাৎ তিনি তো মুক্ত বলেই স্বচ্ছন্দ। কেউ রাগ করতে পারেন, কিন্তু গালমন্দ না করার আবেদনও জানান তাকে। কবিতাটির শেষ অংশে লেখেন নিজের ব্যর্থ জীবনের কথা:

“এত ভোর ভোর উঠেও আমার কিছু হল না

 সংসার হল না, ঘরবাড়ি হল না

 দাতাও হতে পারলাম না, শুধু পথ মাপলাম

 আর কোন মুখে কত কালি তাও দেখলাম।”

         ঘর-সংসারহীন জীবন কবির শুধু পথ মেপেই কেটে গেল। পথে পথে দেখলেন ‘কার মুখে কত কালি’ লেগে আছে। এখানেই রাষ্ট্র ও সমাজ, সময় ও মানুষ পাঠের পরিক্রমা। নিজেই কবি যখন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন, তখন এগিয়ে যাবার জন্য বিচ্ছিন্ন নিজেকে আবার একনিষ্ঠতায় ফেরাতে চান। রাতের গন্ধে অন্ধকারের মাতাল হয়ে যাওয়া দেখে, ঘুমের নিঃশ্বাসের জাগরণ দেখে, দূর বাঁশবনে কারও কান্না শুনে কবিও তেতে ওঠেন। তখন লেখেন:

 “রোদ ঠেলে হাঁটছি”

 ‘হাঁটছি’ ক্রিয়াপদটি চলমান মহাকালের সীমানায় চিরন্তন মানবীয় প্রজ্ঞারই প্রবাহ। প্রতিটি জীবনই হাঁটার ক্রিয়ার অনুসারী। প্রতিটি জীবনেরই ঠিকানা আছে। এই ঠিকানা জয়নাল আবেদিনেরও ছিল বলেই আয়োজনেরও শেষ হয়নি। আয়োজনেরও প্রতিযোগিতা দেখা দিয়েছে। কবিতায় লিখেছেন:

“একটি পথ। পথের ধারে শিশিরের বাচ্চারা শুয়ে আছে।

 তাদের ঘরবাড়ি নেই।”

 পথ তো একটিই। শিশিরের বাচ্চারা সব পথের ধারেই শুয়ে থাকে। তাদেরও ঘরবাড়ি থাকে না। চলার মধ্যেই তো জীবনের পরিক্রমাটি অনুধাবন করা যায়। সেখানে স্থিরতার বা আবদ্ধতার চিহ্ন ‘ঘরবাড়ি’। তা থাকলে আমাদের সভ্যতাই থেমে যেত। সুতরাং জীবনের অবধারিত গতিমানতাকেই কবি বোঝাতে চেয়েছেন। ইংরেজি সাহিত্যের কবি রবার্ট ফ্রস্ট বলেছেন:

“In three words I can sum up everything I ‘ve learned about life: it goes on.”

 অর্থাৎ তিনটি শব্দে আমি জীবন সম্পর্কে যা কিছু শিখেছি তার সংক্ষিপ্তসার করতে পারি: এটি চলতে থাকে। এই ‘it goes on’-ই মূল কথা। কবিকে কেউ বাঁধতে পারেনি। মোহ টেনে ধরতে পারেনি। জলের গিঁট খুলে খুলে এক পা দু’পা করে জলে নেমেছেন। গতজন্মের কথা স্মরণ এসেছে। জলের শরীরে অতীতের পাপড়িগুলিকে মিশে থাকতে দেখেছেন। জলের প্রবাহে জীবনের প্রবাহও চলমান হয়েছে। তেমনি পাখিদের উড়ানেও সেই গতির নিদর্শন। মুক্তির পবনও সব আগল খুলে দিয়েছে। পার্থিব মোহের আবরণ ছিন্ন করেই কবি লিখেছেন:

“ভালোবাসার মুখে লাথি, প্রেমের বুকে ছুরি

 মাঝরাত্রি একলা ছাদে উড়িয়ে দিলাম ঘুড়ি।”

 এই ঘুড়ি তো ঐশীকেতন বোধ যা মহাকাশের সীমানায় পৌঁছে যায়। আবার তা জন্মান্তরেও ফিরে আসে বাষ্পীভূত চেতনার সংবদ্ধতায়:

“বাতাস ধরে ঝুলে থাকি শিশির ছুয়ে নামি

 তাইতো আমি সময় খেকো সোনার চেয়েও দামি।”

     জীবন তো এভাবেই পুরুষ রূপের আধারে ঘুরপাক খায়। চলমান প্রজ্ঞার অন্তরিত প্রক্রিয়ায় শরীর ধারণ করে আবার তা বোধের সঞ্চারে বিদেহীও হয়ে ওঠে। সেই অনুভব থেকেই আত্মস্বরূপের পরিচয় দেন:

“ঘুম পেলে ঘুমোই, চোরের মতো বসে থাকি

 রাত নামলে চরতে বেরোই, অলিগলি

 ঘুরে ঘুরে তুলে আনি সকাল বেলার রোদ,

 শরীর খারাপ হবে বলে গায়ে মাখি না, যে

 আমাকে একেবারেই পছন্দ করে না

 তাকে নিয়েই ঘর বাঁধবো বলে তাকিয়ে থাকি।”

                                                  (টান)

    রাতের সঙ্গে,রোদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, অপছন্দকারীর সঙ্গে ঘর বাঁধার বাসনা— মানুষ থেকে যখন নিজেকে ভিন্ন পর্যায়ের স্পর্ধায় নামি আনতে পারেন তখনই তা সম্ভব। সময়ের সঙ্গে নিজেকে গাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া, রোদকে বহন করে নিয়ে যাওয়া, জীবনকে মহাজীবনে ছড়িয়ে দেওয়া সেই কবির পক্ষেই সম্ভব। কত কম লিখে কত বেশি বলা যায় এবং কবিতা লেখার উৎস যে আত্মজীবন-ই হয়ে উঠতে পারে—জয়নাল আবেদিন তা দেখিয়ে দিয়েছেন। বাংলা সাহিত্যে বহু কবি আছেন, আরও বহু কবি আসবেন, কিন্তু জয়নাল আবেদিনের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ছিন্ন ও ভগ্ন জীবনের আত্মস্বর চিরদিনই আমরা শুনতে পাব।

Dr. Taimur Khan

Leave a Reply