Dr. Taimur Khan

আত্মগত গদ্য

এই কবিতাজীবন

🐦

 ‘এই কবিতা জীবন’ নামে ধারাবাহিক আত্মগত গদ্য লিখছেন ৯০ দশকের কবি তৈমুর খান। কী আছে গদ্যটিতে?

 কবিতাজীবন জীবনের মতো নাকি! যে জীবন স্বপ্নের, যে জীবন সংগ্রামের, যে জীবন বেঁচে থাকবার, যে জীবন বিদ্রোহের এবং অবশ্যই যে জীবন সমাজের। কবিতাজীবন কি সেই জীবনেরই মতো? কবিতা না লিখলেই বা কেমন জীবন হতো, কবিতা লিখেই বা কেমন জীবন পেয়েছেন, কী লেখেন কবিতায়, কেনই বা লেখেন, কেমন ছিল তাঁর সময়… এসব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছেন ধারাবাহিক গদ্যটিতে। কবিতায় মেশানো জীবন অথবা জীবনে মেশানো কবিতা কে বড় হতে চায়, কে কাকে অনুসরণ করে, কে কার প্রশ্নের উত্তর দেয়… এসবের মধ্যেই আসুন আমরা প্রবেশ করি।

পর্ব-১

কবিতার জন্ম 

🍁

 ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি মাস। সবুজ ঘাসের আলে আলে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছি। হ্যাঁ পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। জুনিয়র হাইস্কুলটি ফাঁকা একটি মাঠের মধ্যে। বছর কয়েক আগে আমাদের গ্রামের প্রান্তেই স্থাপিত হয়েছে। স্কুলটির সামনেই বিশাল একটি বটগাছ। কখনো কখনো সেখানেও ক্লাস বসে। ঘাসের উপর বসে মাথা ঝুঁকিয়ে বই খুলে সামনে মেলে ধরি। রোদ উঠলে গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ছিটেফোঁটা আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে। রোদের নকশাগুলি অপাঠ্য শব্দের মতো মনে হয়। গাছের উপর কিঁচিরমিচির করে পাখির ঝাঁক। তাদের শব্দও বুঝতে পারি না। তবু শুনে শুনে ১১ বছরের বালক উদাসীন হয়ে যাই। বারবার মনে পড়ে:

“কোন্ দেশেতে তরুলতা

সকল দেশের চাইতে শ্যামল?

কোন্ দেশেতে চলতে গেলেই

দলতে হয় রে দূর্বা কোমল?

কোথায় ফলে সোনার ফসল,

সোনার কমল ফোটেরে?

সে আমাদের বাংলাদেশ,

আমাদেরই বাংলা রে!”

 সেই বছরই কাজী নজরুল ইসলামের ছোট্ট জীবনী গ্রন্থ ‘কাজী নজরুল’ আমাদের পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্য। সপ্তাহে একদিন তার ক্লাস হয়। কিন্তু বইটি রোজই আমার কাছে থাকে। অন্য বই থেকে সেটিরই মর্যাদা বেশি। বারবার তার উদ্ধৃত কবিতার পংক্তিগুলি পড়তে থাকি। আমার মুখস্থ হয়ে যায়। ছেঁড়া বুকপকেটে হাত ঢুকিয়ে যখন বলতে থাকি:

“হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান্‌।

তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান

কন্টক-মুকুট শোভা।—দিয়াছ, তাপস,

অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;”

তখন মনের মধ্যে একটা আলাদা শক্তির উৎস উপলব্ধি হতে থাকে।  রুটির দোকানে ময়দা মাখানোর কাজ করা নজরুলকে নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে থাকি। ভেতরে ভেতরে একটা গুনগুনের জন্ম হয়। তখন লিখতে পারি না। তখন সরষে ক্ষেতের  পাশ দিয়ে যেতে যেতে দিগন্ত বিস্তৃত হলুদ ফুলের আয়োজন দেখে বিস্ময়ে চেয়ে থাকি। আর এই সরষে ফুল নিয়েই প্রথম কবিতা লেখা হয় অংকের খাতায়। না, সে কবিতা কাউকে দেখাইনি। নজরুলের ‘ঝিঙেফুল’ তখনও আমার পড়া হয়নি। অনেক পরে পড়েছিলাম। কিন্তু সরষে ফুল চোখে দেখা বিষয়। নিম্নবিত্ত চাষি ঘরের ছেলে। তাই মাটির সঙ্গে ছিল ছোট থেকেই সম্পর্ক। স্বাভাবিকভাবেই সরষে ফুল আমাকে আকৃষ্ট করবে। কবিতাও লেখাবে। ভাবতে শেখাবে। নতুন কোনো শব্দ, নতুন কোনো ফসলের স্বপ্ন দেখাবে। সেটারই সূচনা হয়েছিল সেদিন।

 মাটির বাড়িতে তখন বসার জায়গা হত না। গ্রীষ্মকালে উঠোনেই খেজুরতালাই পেতে লম্ফু জ্বেলে পড়তে বসতাম। অন্য পাশে বাবা কোনোদিন রামায়ণ-মহাভারত, তো কোনোদিন হাতেমতাই-আলিফ লাইলা সুর করে পড়তেন। সেদিকেই কান থাকত। কত দৈত্য-দানবের বর্ণনা দেখতাম। কত যুদ্ধবিগ্রহের আওয়াজ পেতাম। সে এক ভিন্ন রাজ্যে মন চলে যেত। সুদূর আকাশের দিকে চেয়ে দেখতাম সেই দেশ। কখনো অন্ধকারে বিষণ্ন চাঁদ। কখনো উজ্জ্বল জোৎস্না। ঘরের পাশে বাঁশঝাড় থেকে   জেগে উঠত পাখি। দূরে কোথাও ডাকত পেঁচা। শুনতে শুনতে উঠোনেই ঘুমিয়ে পড়তাম। বই খোলাই থেকে যেত।

  এভাবেই যখন বড় হচ্ছিলাম, কবিতা তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ভাদ্র-আশ্বিনের দিনগুলিতে অধিকাংশ সময়েই অনাহারে কাটত। এক বেলা খুদের জাউ, তো অন্যবেলা আধভাঙা গমের জাউ। কোনোদিন খেতে পারতাম, তো কোনোদিন খেতে পারতাম না। ছোট পিসি একখানা বাটি নিয়ে অন্যের বাড়ি থেকে কখনো কখনো ফ্যানভাত চেয়ে আনত। কখনো কখনো শুধুই ভাত। তাই খেতে-খেতেই কবিতার জন্ম হল। একদিন সেই দারিদ্র্যকেই নতুন করে লিখতে চাইলাম। সমাজের শ্রেণিবিভাজন বুঝতে পারলাম। সাতদিন ধরে একনাগাড়েই বর্ষণ শুরু হয়েছে। মাঠঘাট থৈ থৈ করছে জলে। বাবা গেছে অনেক দূর চাষের কাজে মুনিষ খাটতে। তিনদিন ধরে বাড়ি ফিরতে পারেনি। মা বসে আছে দরজায়। বাড়িতে খাবার মতো কিছুই নেই। অনেক রাতে বাবা ফিরলেন মাথায় করে কয়েক কিলো ভেজা চাল নিয়ে। রাত জেগে অপেক্ষা করতে থাকলাম কতক্ষণে তা ভাত হয়ে আমাদের সামনে আসবে।

 সেসব দিনগুলিই ছিল কবিতা জন্মের পূর্বমুহূর্ত। হ্যাঁ কবিতার উৎস ছিল ওই দারিদ্র্যই। অনাহার ক্লিষ্ট জীবনের অসহায়ত্ব। পরে লিখেছিলাম: 

“খা-রে খোকা, দুহাত ভরে খা

 এই আকাশ খা, বাতাস খা, মাটি খা, পাথর খা…”

 সারা বিকেল, সারা দুপুর আমার মন শুধু খাই খাই করত। কিছুতেই পেট ভরত না। আমার পরের বোনটি তুলে আনত বুনো কচুর গাছ। বড় মাটির হাঁড়িতে মা তাই সেদ্ধ করতেন। কোনো কোনো রাতে তাই খেয়েই ঘুমিয়ে পড়তাম। মহাকাব্য আর রূপকথার রাক্ষস-খোক্বসেরা তখন মনের চোরা পথে আসা-যাওয়া করত। একখানা তরবারি নিয়ে আমিও হাতেমতাই হয়ে যেতাম। কখনো কখনো পাতালে নেমে তুলে আনতাম মণিমাণিক্য। কখনো কখনো আলিফ লাইলার গল্পের মতো উড়ন্ত চাদরে চেপে পাড়ি দিতাম বহুদূর দিগন্তের দেশ। মনে মনে আমাদের দারিদ্র্য দূর হয়ে যেত। কষ্টের অসুর বধ করতাম। মনের কল্পনা শক্তি ধৈর্যের প্রাচীর নির্মাণ করত।

 দশটা না বাজতেই স্কুলে হাজির হয়ে চলে যেতাম পরের জমিতে চাষের কাজে নিযুক্ত বাবার কাছে। গেরস্থ বাড়ির দেওয়া জলখাবারে আমিও ভাগ বসাতাম বাবার সঙ্গে। আবার কখনো নিজেও বাবার জন্য কয়েক ছটাক ভেজাভাত আর আমানি নিয়ে মাথায় চাপিয়ে মাঠে যেতাম। জামবাটি ত্যারচা হয়ে গড়িয়ে পড়ত মাথা থেকে। আমিও তখন জিভ বার করে তা চেটে চেটে খেতাম। অবসর সময়ে গরু চরাতে হত, অথবা মাঠে মাঠে ঘাস কেটে বেড়াতে হত। সেই কাটা ঘাসও বিক্রি করতাম। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে জমিতে ঝরে পড়া ধানগুলিও সংগ্রহ করার জন্য বেরিয়ে পড়তাম। বেশ কিছু ধান সংগ্রহ করতে পারলে আমাদের কয়েকদিনের ভাতের অভাব দূর হত। ঠিক এমনই  ক্ষুন্নিবৃত্তির জীবনের মধ্যদিয়েই বড় হচ্ছিলাম আর নজরুলকে অনুকরণ করে লিখছিলাম কবিতা। কবিতা বলতে তখন শুধু বক্তব্য আর অন্ত্যমিলযুক্ত পয়ার। বাবার পুরনো বইগুলি বহুবার পঠিত হতে থাকত। জসীমউদ্দীন, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকুমার রায় ঘুরেফিরে এঁদেরই কবিতা বারবার মুখস্থ হয়ে যেত। আপন মনে কতবার পাঠ করেছি তা বলতে পারব না। আজও মনে পড়ে:

“আদুরী 

কুমুদরঞ্জন মল্লিক

ওরে ওই দেখ্ পড়িয়াছে বান অজয়ে,

ঘাট মাঠ বাট সব দিল আজ ডুবায়ে,

থাকি থাকি দেখ্‌ চমকি উঠিছে বিজুরি,

হাঁসগুলি তোর ডেকে নিয়ে আয় আদুরী।

মার কথা শুনে ছুটিল কৃষক বালিকা,

সে যে সোহাগিনী দয়াবতী পশুপালিকা।

পদ্মদীঘির পদ্মের হেরি মাধুরী

তিতি করে তার হাঁসগুলি ডাকে আদুরী।

বালিকা চকিতে দেখিল নিকটে আসিয়া,

বন্যার জলে হাঁসগুলি যায় ভাসিয়া।

হংস ধরিতে লাফায়ে পড়িল দুলালী,

পদ্মদীঘির যেন সে স্বর্ণমরালী।

আর হাঁস লয়ে কই সে এল না ফিরিয়া,

বাপ মা তাহার কেঁদে খোঁজে গ্রাম ঘুরিয়া।

দেখে সবে হায় পরদিন সেথা আসি যে,

পদ্মের মাঝে সে মুখকমল ভাসিছে।”

 পড়তে পড়তে চোখে জল এসে যায়। কাজী নজরুল ইসলাম যে স্কুলে পড়তেন সেই স্কুলেরই হেডমাস্টার ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক। তাই এই কবির প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরও বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কতকগুলি সাদা কাগজ কেটে নিয়ে সুচ সুতো দিয়ে সেলাই করে একটা বইয়ের আকার দিয়েছিলাম। তার উপরে নাম দিয়েছিলাম ‘ঘাসফুল’। ভিতরে ভিতরে একেক দিনে একেক পাতা পূর্ণ করতাম। সেখানকার প্রথম কবিতাটিই ছিল ‘সরষে ফুল’। কবিতাটি শুরু হয়েছিল এভাবেই:

 “সরষে ফুল, সরষে ফুল

 সুগন্ধে করিস আকুল

 হলুদবরণ রূপ দেখি তোর মাঠ জুড়ে

 দেখে আমার চোখ জুড়াই, মন ভরে।

 শীতের সকাল আলোয় ভরা মাঠে

 যাচ্ছি আমি একাই হেঁটে হেঁটে

 ফুল ফুটিয়ে ডাকিস কত অলি

 এত হলুদ রং বলতো কোথায় পেলি?”

 পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এই জুনিয়র স্কুলেই চলতে থাকে পড়াশুনা। খাতাটিও ভর্তি হতে থাকে কবিতায়। কখনো প্রকৃতির কবিতা, কখনো বিদ্রোহের কবিতা। কখনো নজরুলকে নকল করছি,তো কখনো সুকুমার রায়কে। কখনো কালিদাস রায়, তো কখনো সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। কখনো সরস্বতীকে নিয়ে কবিতা লিখছি, তো কখনো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। স্কুলের অনুষ্ঠানে পড়তে হবে। অষ্টম শ্রেণিতে উঠেই প্রথম মেয়েদের মুখের হাসি ভালো লাগতে থাকে। ভালো লাগতে থাকে তাদের সামনে কবিতা পড়তে। কখনো আবৃত্তি,তো কখনো নিজের লেখা। ওদের বিকশিত শরীরে প্রথম অনুভব করি এক ধরনের রঙের উজ্জ্বলতা। কবিতা লিখেই ওদের আকৃষ্ট করতে হবে। আবৃত্তি করেই ওদের মনোযোগ পেতে হবে। তাই সেদিকেই অগ্রসর হতে থাকি। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবিতা লেখার মহড়া চলতে থাকে। মাথার চুল বড় হয় হোক। নিজেকে কাজী নজরুল ভাবতে ভালো লাগে। ‘বল বীর বল চির উন্নত শির’ নিজের ভেতর থেকে কেউ যেন বলে ওঠে।

 চলবে……

Dr. Taimur Khan

Leave a Reply