Dr. Taimur Khan

এই কবিতাজীবন (ধারাবাহিক)

🐦

পর্ব-৮

বাড়ি ফেরার গান

🍁

চারিদিকে কমলা রঙের রোদ উঠেছে। ঝাঁক ঝাঁক পায়রা নেমেছে। কোথাও এমন দেখিনি। সমস্ত সমুদ্রের তীর জুড়ে রংবেরঙের সাজ-পোশাকে যুবক-যুবতীরা পরস্পরের কোলে মাথা রেখে ঢলে পড়েছে। যত এগিয়ে যাচ্ছি ততোই চোখে পড়ছে। এ যে প্রেমের বৃন্দাবন! নারী-পুরুষের এরকম খোলাখুলি পরস্পরের প্রতি আত্মসমর্পণ ইতিপূর্বে আমি দেখেছি বলে মনে হয় না। আরব সাগরের তীরে এরকম একটি মনোরম জায়গা চৌপাটি আমার ধারণার বাইরে। দূর থেকে হারু মামু দেখিয়ে দিলে একটা উঁচু বাড়ি। পর্যটকদের জন্য আবাসস্থল। তার পাশেই আর একটা উঁচু বাড়ি ছিল। সেটা নাকি সমুদ্রের তলায় তলিয়ে গেছে। ছোট ছোট সী বোটগুলি এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। বহু যুবক-যুবতী এইসব বোটে চেপে আছে। কত রকম ফেরিওলা বিক্রি করছে মুখরোচক নানা জিনিস। দেখতে দেখতে ঘোর লেগে গেল। ঝাঁক ঝাঁক পায়রাগুলি কাছাকাছি গেলেও উড়ে পালাচ্ছে না। হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করলাম, তারা সরে গেলে আর ধরলাম না। পায়রা আর প্রেম নিয়েই আর গাছপালা আর সূর্যাস্ত আর সমুদ্রের ঢেউ নিয়েই চৌপাটি দেখে আমাদের মন জুড়িয়ে গেল। মনে মনে আশ্বাস দিয়ে এলাম, আবার কোনোদিন আসব।

আগামিকাল ট্রেন ধরতে হবে। হারু মামু আর আমি বাড়ি ফিরব। আজ সন্ধ্যায় কিছু কেনাকাটা করতে হবে। চৌপাটি থেকে সরাসরি বাস ধরে তাই চোর বাজারে নামলাম। চোরবাজার বলতে সব চুরি করা মালপত্র বিক্রি হয়। দামি গাড়ি রেডিও ঘড়ি টেপরেকর্ডারসহ জামা-কাপড় পর্যন্ত। আমি কখনোই আসিনি। সেদিনই প্রথম চোরবাজার থেকে একটি প্যান্ট ও একটি জামা কিনলাম। আমার জীবনে এটি প্রথম আমার উপার্জনে কেনা জামা প্যান্ট। সামান্য রং চটেছে প্যান্টের, কিন্তু জামাটা বেশ উজ্জ্বল। বরাবরই আমার দামি কিছু কেনার শখ ছিল না। কোনোরকম শালীনতা বজায় রেখে পোশাক পরিচ্ছদ হলেই হল। তাই হারু মামুই পছন্দ করে দিলে। সর্বমোট ১২০ টাকা খরচ হল। ফেরার পথেই পিনখেজুর কিনলাম দু’কিলো। সেবাজারে তার দাম ছিল ৪০ টাকা। বাড়ির ছেলে-মেয়েদের জন্য এক প্যাকেট চকলেট। সবগুলো কিনে গুছিয়ে একটা ফাঁকা বাক্সের মতো টিনে সব ভরে রাখলাম। ভোর ভোর বের হতে হবে। হ্যাঁ বাড়ি ফিরব, বাড়ি ফেরার যে কত আনন্দ সেই দিনই অনুভব করেছিলাম।

গতকাল খান সাহেব শেঠের কাছে আমার ‘পগার’ নিয়েছিলাম। সর্বমোট আড়াই হাজার টাকা আমি মজুরি পেয়েছি। খান সাহেব জিজ্ঞেস করেছিলেন: তু কিঁউ মুলুক যা রাহা হ্যায়?

আমি বলেছিলাম, মুঝে এডমিশন লেনে পড়েগা, হায়ার এডুকেশনকে লিয়ে। হাম মাধ্যমিক পরীচ্ছা দে কর্ মুম্বাই আয়েথে। এক্সাম কা রেজাল্ট হোনে বালা হ্যায়। হাম বহুত নিডি আদমি হ্যায় ইস্ লিয়ে কাম করনা পড়া।

সব শুনে খান সাহেবের দয়া হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, তেরা পড়নে কা কিতনা খরাচ লাগতাহে? বাতাইয়ে, হাম থোড়া হেল্প করেঙ্গে।

আমি কাচুমাচু করে বলেছিলাম পানশো রুপাইয়া হোনেসে হো জায়েগী।

খান সাহেব ৫০০ টাকার বদলে ১০০০ টাকা দিয়েছিলেন। ১৯৮৩ সালে সেই এক হাজার টাকার দাম অনেক। মোট সাড়ে তিন হাজার টাকা নিয়ে আমি বাড়ি ফিরছিলাম। যদিও খান সাহেব বলেছিল, কংগ্রেস আই এর অফিসে সর্বক্ষণের জন্য এক ‘ফোন রিসিভ বয়’ এর চাকরি করার জন্য। তাতে ৫ হাজার টাকা মাসিক বেতন দিতেন। কিন্তু আমি না করে দিয়েছিলাম। আমার দুই মাস পেরিয়ে গেছে গ্রাম ছেড়ে আর থাকতে ভালো লাগে না। তাই এরকম সুযোগ ছেড়ে দেওয়াতে হারু মামু পর্যন্ত বলেছিল ‘এটা ঠিক হল না’। যাইহোক পরে এই কাজটিতে আলতামিস ঢুকেছিল। কিন্তু সেও বেশিদিন করতে পারেনি। ছেড়ে দিয়ে আবার রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজই সে করেছিল।

ট্রেনে চেপে হুহু শব্দে যতই ট্রেন ছুটছে ততোই আনন্দে মন নেচে উঠছে। দুই মাস দশ দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও মুম্বাইয়ের মানুষজনের প্রতি আমার একটা গভীর টান অনুভব করলাম। বিশেষ করে মারাঠা শ্রমিকদের ব্যবহার আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে তারা আমাকে একবার বসার সুযোগ দিত। সন্ধেবেলায় নিজে খাবার কিনতে যেতে না পারলে তারাই কিনে এনে দিত। নির্মীয়মান বিল্ডিং এর মেঝেতেই চট পেতে আমরা একসঙ্গে ঘুমাতাম। ভোর হলে জল তুলে ভাত রান্না করতাম। কোনোদিন আলু-পেঁয়াজ না থাকলে তা ওদের কাছেই পেতাম। যে মারাঠা রাজমিস্ত্রিটি আমাদের সঙ্গে কাজ করত, সে সেই সময়কার বিএ পাস। একদিন একটা লোহার কড়িকাঠে সাদা চক দিয়ে হিন্দিতে আমি আমার নাম লিখেছিলাম। তার নিচে লিখেছিলাম ‘দিমাগ বিগাড় যাতা হে’। সেই রাজমিস্ত্রিটি সেটা পড়ে নিয়ে আমাকে লেখাপড়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। তারপরে থেকেই আমাকে বিশেষভাবেই স্নেহ করত।

ওটাতে যাওয়া-আসার সুবাদে বিল্ডিং এর ওপর তলায় ভাড়া থাকা এক সাংবাদিক পরিবারের মেয়ে ফারজানা শাহ আমার সঙ্গে আলাপ করে। সে তখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। বাবা নামি একটা ইংরেজি দৈনিকের সাংবাদিক। একদিন আমাকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করেছিল:

Are you educated? Where is your home? Come on what to do here?

আমি ইংরেজিতে তেমন সড়গড় হতে পারিনি। তাই প্রথমেই এরকম ইংরেজি বাক্য শুনে আমি থতমত খেয়ে গেছিলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিলাম:

I read class ten .I came to Mumbai to work. I came to here meet them.

তারপর সে আবার বলেছিল,

I want to know where your house is.

তখন আমি তার উত্তরে বলেছিলাম:

I live in Birbhum district in West Bengal. I’m very poor, because it has come to work here.

পুনরায় সে জানতে চেয়েছিল:

Do not you want to study?

উত্তরের তাকে বলেছিলাম

Of course, there is a need for money.

এই কথা শুনেই সেদিন সে আমাকে তার পিতার কাছে ডেকে নিয়ে গেছিল। তার পিতাকে বলেছিল একটি ছেলে পড়ার জন্য কাজ করতে এসেছে। দেখো এই ছেলেটাকে কোনো সাহায্য করতে পারো কিনা।

তার পিতা আমাকে বলেছিল, মুম্বাইয়ে পড়াশোনা করলে সে ব্যবস্থা করে দেবে। তাই পুনরায় আবার দেখা করতে বলেছিল। সেদিন মেয়েটির আন্তরিকতা এবং তার পিতার ব্যবহার আমাকে ভীষণ ভালো লেগেছিল। তারা অন্যভাষীর মানুষ হলেও বাঙালি হিসেবে আমাকে ঘৃণা করেনি। তাদের কথাও বারবার মনে পড়ছে আমার।

একদিন মোট বইতে বইতে এক শিখ সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িতে যেতে হয়েছিল। তাদের ঘরে মাল নামিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে ফিরতে ফিরতে আমার সমবয়সী একটা ছেলে আমাকে জানতে চেয়েছিল, আমার নাম কী। তার কথা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম, কেউ তো কোনোদিন রাস্তার লোকের নাম শুনতে চায় না! তাকে বিনীতভাবে বলেছিলা,হমারা নামকা ক্যা জরুরাত হ্যায়?

ও তখন হিন্দিতে বলেছিল, তোমাকে দেখে এই কাজের লোক মনে হচ্ছে না, তাই জানতে চাইছি।

আমি তখন আমার নাম বলেছিলাম এবং আরও তাকে জানিয়েছিলাম, আমি বাধ্য হয়েই এই কাজ করতে এসেছি। সে শুনে খুব আফসোস করেছিল।

ভাবতে ভাবতেই কতদূর চলে এসেছি, কিছুক্ষণ পরেই হাওড়া স্টেশনে নামব, তারপর ‘দানাপুর লোকাল’ নামক ট্রেন ধরে রামপুরহাট। সেদিন মনে মনে একটা গানই বারবার ফিরে আসছিল:

“যত দূরেই যাই না কেন,

আপন কেহ নয় রে

আপন গাঁয়ের মতো

কেউ কোথাও নাই রে।

বাবা-মায়ের কাছে ফিরে

সব কষ্ট যায়রে দূরে

সব পেয়েছি মনে যে হয়

অন্ধকার আর নাইরে।”

বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ রামপুরহাট স্টেশনে নেমেই একটা রিক্সা ভাড়া করে গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলেছি। যেতে যেতেই গ্রামের সবাই হুল্লোড় করে জানিয়ে দিল: তুই মাধ্যমিকে সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছিস। মাত্র ২৭% পাস তার মধ্যে আমি সেকেন্ড ডিভিশন!

আমাদের বিদ্যালয় এর ফার্স্ট বয় পশ্চিমবাংলার দশম লাভ করেছে। তাই স্কুলের গৌরব অনেকখানি। বাড়ি ঢোকার আগেই এরকম খবর আমাকে অনেকখানি আনন্দিত করল। বহুদিন মায়ের হাতের রান্না খাওয়া হয়নি ও রাত্রে ঠিকমতো ঘুমানো হয়নি। ক্লান্ত বিষণ্ন মুহূর্তগুলি আর আমাকে আক্রমণ করতে পারল না। স্নান করার জন্য আমি পুকুর ঘাট এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

চলবে….

Dr. Taimur Khan

Leave a Reply