Dr. Taimur Khan

আত্মগত গদ্য 🍁 তৈমুর খান
এই কবিতাজীবন (ধারাবাহিক)
🐦
পর্ব- ১০
কবিতা প্রকাশের আনন্দ
🍁
১৯৮৪ সালে রামপুরহাট কলেজ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়েছে। লাইব্রেরি থেকে এক কপি সংগ্রহ করলাম। জানতাম না আমার কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছে। সূচিপত্র দেখেই আনন্দে আত্মহারা। তাড়াতাড়ি কবিতাটি খুলে পড়া শুরু করলাম:
“বিদ্রোহী নজরুল
তৈমুর খান (একাদশ শ্রেণি,কলা বিভাগ)
চির বিদ্রোহী বীর নজরুল
তুমি ধূলির ধরাতে অবিনশ্বর
তুমি চেতনার বুলবুল হে বীর নজরুল!
কী জ্বালাময়ী তোমার বীণা
কী রক্তক্ষয়ী লেখা
ভারত মায়ের পূর্ণস্বাধীনে
সে যে সার্থক স্বপ্ন দেখা!
তুমি সাম্যের গীত গেয়ে
তুলিয়াছ একা শির
টুটিয়াছ অস্পৃশ্যের বাঁধন
এই বিশ্ববাঙালির!
তুমি জ্বালিয়া অনল
ভেঙেছ ভূতের বল হে বীর নজরুল!
অহরহ তুমি যুবকের বুকে
জ্বলন্ত অনলকুণ্ড
তুমি উত্তেজনার শ্রেষ্ঠ প্রতীক
অন্যায়ের কাটো মুণ্ড।
তুমি ভয় ভাঙা ভীষণ প্রভঞ্জন
আপনার তালে নাচো
তুমি উত্তাল উন্মত্ত ভীষণ
মরেও আজও বাঁচো।
তুমি বিদ্ধ হয়েছ চিরনিত্য
অসীম ব্যথার দুঃখে
তবু ফুটেনি দুঃখ চিত্ত ভরিয়া
ম্লান হয়ে ওই বুকে।
তুমি নিষ্পাপ চিরনির্মল
ধরার একটি ফুল হে বীর নজরুল!”
জীবনের প্রথম কবিতা ছাপা হলে এত আনন্দ হয় এবং অন্যকোনো আনন্দের সঙ্গেই তার যে তুলনা করা চলে না তা সেদিনই বুঝেছিলাম। কবিতা ছাপা হলে আমার সম্মান বাড়বে, আমি খিদের অন্ন পাব, অনেক টাকা পাব এমনটি কিন্তু নয়। কবিতা ছাপা হলে কিছুই পাব না, কেউ হয়তো পড়েও দেখবে না, তবুও যে এক সৃষ্টির আনন্দ আছে তা স্রষ্টাই বোঝেন। পত্রিকাটি যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। কবিতার ধারা পাল্টে গেছে অনেক পরে। এই কবিতাটি লিখেছিলাম ১৯৮৩ সালে। নতুন যখন একাদশ শ্রেণির ক্লাসে উপস্থিত হয়েছি, তখনই ক্লাসে ক্লাসে একটা বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়েছিল, ম্যাগাজিনের জন্য লেখা জমা দিতে হবে। বেশ কয়েকটি কবিতা বন্ধুদের নামে জমাও দিয়েছিলাম আর নিজের নামে এই একটিই। বেশিরভাগ কবিতাগুলিই ম্যাগাজিনে ঠাঁই পেয়েছে। বন্ধুদের কাছে তবে আমার একটা পরিচিতি বেড়ে গেল। গ্রাম থেকে আসা পাজামা আর হাওয়াই চপ্পল পরা একটা ছেলে কবিতা লেখে। অফ প্রিয়ডে বন্ধুদের নিয়ে কোনো ফাঁকা রুমে বসি। চলে নতুন কবিতার পাঠ। করোমুল্লা ও বাগাল মুখার্জি নজরুলগীতি-রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে শোনায়। আমি শোনাই কবিতা। এভাবেই কেটে যায় দিন। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর রেডিওতে শুনলাম ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছে। সারাদেশের মানুষের কাছেই গভীর শোকবার্তা পৌঁছে যায়। সেই সময়ও কলেজ ম্যাগাজিনে লেখা চাওয়ার বিজ্ঞাপন চলে আসে। তখন ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়েই পর পর বেশ কয়েকটি কবিতা লিখে ফেলি। বরাবরের মতো এবারও তা বন্ধুদের নামে জমা দিই। নিজের নামেও একটি জমা দিই। উল্লেখ্য ১৯৮৫-তেই কলেজ ম্যাগাজিনটি প্রকাশিত হলে দেখা যায় বেশিরভাগ কবিতাই ইন্দিরা গান্ধীকে স্মরণ করে লেখা হয়েছে। তার মধ্যে অনেক কবিতাই আমার। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুশোক সারা দেশবাসীকেই বিহ্বল করে তুলেছিল। তাই কবিতাটি সকলের কাছেই আদর পেয়েছিল।
“শ্রীমতি ইন্দিরার মৃত্যু সংবাদে
তৈমুর খান (দ্বাদশ শ্রেণি, কলা বিভাগ)
আজ আমার বুকের পরে
কী শোকশূল বিঁধল আসি ওরে
দুটি চোখে অশ্রু ঝরে অব্যক্ত বেদনায়
দেশকে আঁধার করে চলে গেলে মাতা হায়!
আজ কোন্ দুরাচারী
বুকের মাণিক নিল কাড়ি
সে কিরে মানুষ নয়
নিষ্ঠুর হাতে হানিল আঘাত দারুণ বুলেট ঘায়!
যদি হ’ত তাই
আপন বুকের রক্ত দিতাম ভাই
তার বুলেটের আগে বুক পাতিয়ায়
তবু বিশ্ব মাতারে দিতাম কি বিদায়?
বিশ্ব জননী, কেমন করে ভুলি
কেমনে মুছে আঁখি আবার এশির তুলি!
এই শোক-দাবানল কেমনে নিভাই
তোমার মৃত্যুতে সব সান্ত্বনা নিষ্ফল হয়!
মনে হয় ডুবে গেলাম কোন্ অতল সাগরে
মনে হয় আর জাগব না ফিরে
তোমাকে ছাড়া আজ বিশ্ব শূন্যময়
শোকজর্জর দেশবাসীকে দাও মা অভয়!”
কবিতার এই শেষ লাইনটি নন্দদুলাল গাঙ্গুলি স্যার লিখে দিয়েছিলেন। একদিন কলেজ থেকে ফিরে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেই মুহূর্তেই কবিতাটি দেখাই। স্যার বলেছিলেন, এই মুহূর্তে খুব প্রাসঙ্গিক ভাবনা। এমন মৃত্যুশোক সব ধরনের মানুষকেই স্পর্শ করেছে। তাই এরকম কবিতা লেখাই স্বাভাবিক।
১৯৮৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে সদ্য ভর্তি হয়েছি বি এ ক্লাসে। ইংরেজিতে অনার্স নেব বলেই ইংরেজি অনার্সের ক্লাসেও যেতে শুরু করেছি। দরখাস্ত জমা হয়ে গেছে। কিন্তু একমাস ক্লাস করে বুঝলাম ইংরেজি অনার্সে টিউশান না নিলে নিজে নিজেই পড়া যাবে না। সব সহপাঠীরাই টিউশান পড়তে শুরু করেছে। আমার কাছে তেমন বইপত্রও নেই। বই কেনার মতো সামর্থ্যও নেই। তাই অগত্যা অনার্স পরিবর্তন করে বাংলা বিষয়ের জন্য পুনরায় দরখাস্ত করলাম। সেই সময়েও আবার কলেজ ম্যাগাজিনের বিজ্ঞাপন। এবার বুঝেছিলাম কবিতার ধারা পাল্টাতে হবে। জীবনানন্দ দাশ তখন মনের মধ্যে প্রবেশ করেছেন। তাঁর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘সাতটি তারার তিমির’ অসম্ভব ভালো লেগে গেছে। ‘জীবনানন্দ দাশ’ নামের একটা জীবনী গ্রন্থও কিনে ফেলেছি। সেই সময় বেশ কিছু কবিতা লিখে আবারও কলেজ ম্যাগাজিনে জমা দিলাম। সব কবিতাগুলিই যেন একই ধারার হয়ে গেল। নিজের নামে দিলাম ‘যেতে চাই চলো’ নামের কবিতাটি। এ সময় ভেদ করে, এ অন্ধকার ভেদ করে, এ জীবন ভেদ করে, এই হতাশা ভেদ করে যেতে চাইলাম। কিন্তু কোথায় যাব? যেতে চাইলাম মানুষের ঠিকানায়। যেতে চাইলাম রণভূমিতে। তির-ধনুক সেই শব্দই। ক্লেদাক্ত ঘাম মুছে, দারিদ্র্য-লাঞ্ছনায়-অবজ্ঞায় শক্ত করে কোমর বেঁধে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম।
ম্যাগাজিন এর জন্য কবিতা ঝাড়াই-বাছাই করতে গিয়ে কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুনীলবরণ ব্যানার্জি এবং বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নোজফুল হক দেখলেন প্রায় একই ভাবধারার বেশ কিছু কবিতা জমা পড়েছে। তখনো পর্যন্ত নোজফুল হক স্যারের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। সব কবিতাগুলোকে বেছে একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন ক্লাসরুম থেকে বাসায়। সেদিন দুরু দুরু বুকে স্যারের কাছে উপস্থিত হয়েছিলাম। তখন তিনি বললেন: তুমি তৈমুর?
উত্তরে জানালাম, হ্যাঁ, আমিই।
তখন স্যার আর কিছুই বললেন না। একটা টেপ রেকর্ডার চালু করে বললেন, এটা শোনো!
টেপ রেকর্ডার বেজে চলল:
“যেতে চাই চলো
সংগ্রামে সর্বনাশে
অন্ধকারের অন্ধ পথে
আর কোথায় নিয়ে যেতে পারো?
বিবমিষায় নিঃস্ব হবো
দৈব আকাশ মাথায় ভাঙো
অগৌরবে যতই ঢাকো
এ পথ জুড়ে মৃত্যু নামাও যত!”
তারপর টেপ রেকর্ডার থামিয়ে দিয়ে বললেন: এটা কি তোমার কবিতা?
আমি বললাম, হ্যাঁ স্যার আমার কবিতা!
স্যার বললেন, তাহলে এই কবিতাগুলি কার লেখা?
আমি আর অস্বীকার করতে পারলাম না। বন্ধুদের নামে কবিতা লিখে দেওয়া আমার ঠিক হয়নি। স্যার বললেন, আর কখনো এই কাজ করবে না।
আমি বললাম, বহু কবিতা লিখেছি স্যার তাই, কোথাও ছাপা হয় না, বলেই যখন যে চায়, তার নামেই দিয়ে দিই।
সেই দিনই আশ্বাস দিলেন, একটা পত্রিকা করে লেখা ছাপানো হবে, তবে আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
এদিকে স্যারের বাড়িতে যাওয়া-আসার মুহূর্তেই ‘বিকল্প’ পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল। তিনি বললেন, পত্রিকায় একটা কবিতা ছাপিয়ে দেব, তার বদলে দশ কপি পত্রিকা বিক্রি করে দিতে হবে। পত্রিকার পার কপি দাম হবে পাঁচ টাকা। ৫০ টাকা দিতে পারলে একটা কবিতা ছাপানো হবে।
তাকে আমি বললাম, ঠিক আছে পত্রিকা বিক্রি করে টাকা দেব। স্যারকে না জানিয়েই সম্পাদককে একটা কবিতা দিয়েছিলাম। কলেজ ম্যাগাজিন ছাড়া কোনো লিটিল ম্যাগাজিনে সেটিই ছিল আমার প্রথম মুদ্রিত কবিতা। কবিতাটি এখানে তুলে দিলাম।
“বিরহ ঝরে ঝরে
————————
প্রেম নয় নারী নয়
বিরহের ঝিলিমিলি হাওয়ায়
ফোঁস ফোঁস আওয়াজ
সমস্ত দ্রাঘিমা জুড়ে বিরহ ঝরে ঝরে…
অসহায়া অনাদৃতার ফোলা ফোলা চোখ
গণিকালয়ে, যাযাবরদের ছেঁড়া তাঁবুতে
রাতের হিমে বয়ে যায় বিরহপ্রপাত…
শব্দ ওঠে… চেঁচামেচি কিচকিচ
গিটারের স্বরলিপি গান হয়—
তবু বর্ষণ নেই শ্রাবণের গানে বিরহ ঝরে ঝরে
উড়ন্ত আকাশ ঢেলে দেয় বিরহের তপ্ত শোক:
রাতের রুক্ষ এলোচুলে সকিনার অশ্রুর মতো
দিনান্তের ম্লান রক্ত কষে বিরহ ঝরে ঝরে”
কবিতাটি প্রকাশিত হলে ১০ কপি পত্রিকা নিয়ে আসি। সম্পাদকের বাড়ি গিয়ে বাইরে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। তারপর পত্রিকাগুলি মনের আনন্দে এক একবার খুলে খুলে দেখি। আর নিজের লেখার প্রতি বারবার মমতার চোখে তাকাই। এভাবেই এক মাস কেটে যায়, কিন্তু পত্রিকা বিক্রি করে ৫০ টাকা পরিশোধ করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল। এক কপিও কাউকে বিক্রি করতে পারিনি। অবশেষে ৫০ টাকার জন্য আমাকে মজুর খাটতে হয়। তবু লেখার আনন্দ মজুরখাটাকেও ছাপিয়ে যায়। এসব একদিন নোজফুল স্যার শুনে বললেন: আগামি মাসেই পত্রিকা বের হবে, পত্রিকার একটা নামকরণ করো।

চলবে….

তৈমুর খান

Leave a Reply