Dr. Taimur Khan

এই কবিতাজীবন (ধারাবাহিক)

🐦

পর্ব-১২

চরৈবেতি ও দৌড়

🍁

জীবিকার জন্য এবং কলেজে পড়াকালীন আরও দু’বার আমাকে মুম্বাই যেতে হয়। বিশেষ করে দীর্ঘ ছুটিতে এবং ‘স্বপ্ন ভাঙা রাতের আলো’ নামে একটি গল্প লেখার কারণে। দ্বিতীয়বার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর সেই অবসর সময়টুকু আবার মুম্বাই গিয়ে কিছু অর্থ উপার্জনের সুযোগ পাই এবং সেই অর্থের সাহায্যেই বি.এ ক্লাসে ভর্তি হতে পারি। কিছু বইপত্র কেনারও ব্যবস্থা হয়। তারপর ‘স্বপ্ন ভাঙা রাতের আলো’ নামে গল্পটি ‘বিকল্প’ পত্রিকায় লিখেছিলাম। প্রথম কবিতা লেখার পর দ্বিতীয়বার এই গল্পটি। এটিই ছিল আমার জীবনের লেখা প্রথম গল্প। গল্প লিখে মুম্বাই যাবার কারণটি ছিল গুরুতর। গ্রামের একটি মেয়ের বিয়ের আয়োজন সম্পূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের দিন বর আর বিয়ে করতে আসেনি। বিয়ে না করতে আসার কারণ ছিল মেয়ের বাপ পণের টাকা সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে পারেননি। তাই বরপক্ষ মেয়ের বাপকে জব্দ করার জন্যই বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলেন, বিয়ে করতে না আসার পরিকল্পনা করে। কিন্তু এটা জানানো হয়নি। এই অমানবিক আচরণ আমাকে নাড়া দিয়েছিল। লগ্নভ্রষ্টা মেয়েটির পণপ্রথা আর সামাজিক বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহিনী হয়ে ওঠার গল্পটি আমি লিখেছিলাম। সেদিন মেয়েটির বিয়ে না হলেও মেয়েটি চুপচাপ থেকে যায়। কিন্তু আমি চুপ থাকতে পারিনি। গল্পে দেখিয়েছিলাম মেয়েটি তাদের বাড়ির কাজ করা মাহিন্দার ভিন্ন সম্প্রদায়ের এক যুবকের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে নতুন জীবনের আলোর সন্ধানে। যে স্বপ্ন তার ভেঙে গেছিল, সেই স্বপ্ন ভাঙা রাতের আলো হিসেবে ওই ছেলেটিকেই দেখিয়েছিলাম। গল্পটি প্রকাশিত হলে মেয়েটির পরিবার তা মেনে নিতে পারেনি। এটা যে তাদেরই মেয়েকে নিয়ে লেখা গল্প, বিয়ে যে তাদেরই মেয়েরই ভেঙেছে তারই প্রমাণ হিসেবে গ্রাম পঞ্চায়েতে বিচারের আবেদনও করেছিল। কিছু দুষ্ট বুদ্ধি লোকের কুপরামর্শেও আমাদের বাড়িতে ঢিল-পাটকেল ছুঁড়েছিল। সেদিন পেলে আমার থেকে বয়সে বড় সেই মেয়েটির সঙ্গে হয়তো জোরপূর্বক আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য করত, নতুবা মারধর করে হাত-পা ভেঙে শাস্তির ব্যবস্থা করত। গল্প লেখার জন্য সেদিন এই অশিক্ষিত সমাজের কাছে আমার লাঞ্ছনা কম হয়নি। কলেজের পরীক্ষা কিছুদিন পরেই ছিল। কিন্তু তবুও আমাকে মুম্বাই পালিয়ে বাঁচতে হয়েছিল। অবশেষে সেই গল্পটি আমাকে ভস্মীভূত করতে হয় আগুনে এবং কথা দিতে হয় কখনোই এই গল্পটি আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না।

আমার মাথার ওপর থেকে নোজফুল স্যারের সরে যাবার পর নানা অঘটনের মধ্যেই আমাকে পড়তে হয়েছিল। তবুও সেই সময়ই দুটি পত্রিকা ও প্রতিষ্ঠান আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। প্রথমটির নাম ‘চরৈবেতি’। বীরভূম জেলার ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন রাজগ্রাম থেকে প্রকাশিত হত ত্রৈমাসিক হিসেবে। কিন্তু পত্রিকার সংগঠকেরা প্রতিমাসেই সাহিত্য পাঠের আসর করতেন। সাহিত্য পাঠের সেই আসরে কবিতা, ছোটগল্প, অণুগল্প পাঠ ও আলোচনা হত। এলাকার বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষকরা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন। আমাদের নতুন কবিতাটি সেখানেই পাঠ করার সুযোগ পেতাম। পত্রিকার সম্পাদক কুদ্দুস আলি চা-বিস্কুট সহযোগে জলযোগ করাতেন। পত্রিকা প্রকাশের দিন মাছ-ভাতেরও ব্যবস্থা থাকত। এইখানেই বীরভূম জেলার স্বনামধন্য সাহিত্যিক আবদুর রাকিব উপস্থিত থাকতেন। বিশেষ করে তিনিই হতেন অনুষ্ঠানের সভাপতি। তাঁর ভাষণে সাহিত্য বিষয়ে যথার্থ মূল্যায়নকেই গুরুত্ব দেওয়া হত। আমরা উন্মুখ হয়ে থাকতাম আমাদের সাহিত্য বিষয়ে তিনি কী বলেন তা শোনার জন্য। আবদুর রাকিব ছাড়াও অনুষ্ঠানে থাকতেন মাস্টার বনঅলি। বীরভূম জেলার খানপুরের জমিদার বংশের সন্তান বনঅলি। ‘বনঅলি’ নামটি সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল। বনঅলির আসল নাম ছিল আলি আহাদ ফুরকান। সারাজীবন কবিতা লিখলেও একটিও কাব্য প্রকাশ করে যাননি। প্রতি সপ্তাহেই তিনি একটি করে চিঠি লিখতেন আমাকে। প্রতিটিতেই থাকত একটি কবিতার সঙ্গে একটি চিত্রলিপি। গ্রাম্য জীবনের পরিবেশকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন আত্মনির্বাসনের ক্ষেত্র হিসেবে। তাই নাম-যশ-খ্যাতির আকাঙ্ক্ষাকে প্রশ্রয় দেননি। সম্পাদক কুদ্দুস আলি সেই সময় বেশি ছোটগল্প লিখতেন। পাথরখাদান থেকে উঠে আসা কুলি-কামিনদের জীবনচিত্র তাঁর গল্পে ফুটে উঠত। রাজগ্রামেই তখন অতি তরুণ ইমদাদুল হোসেন কবিতা লিখতে শুরু করেন। প্রথম কবিতা তাঁর ‘দেশ’ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়। কবিতার নাম ছিল ‘ইক্ষুক্ষেতের ভিতর পরীক্ষাহল’। কবিতার প্রথম লাইনটি ছিল ‘ইক্ষুক্ষেতের ভিতর পরীক্ষাহল, ইক্ষু খেতে খেতে পরীক্ষা দিই আমরা’। সেই সময় দারুণ সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু কবি ছিলেন বিড়িবাঁধা শ্রমিক ঘরের সন্তান। অভাবে-দারিদ্র্যে বিধ্বস্ত। তাই অল্প বয়সেই মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে রেললাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন বলেই তাঁর বিদ্যার ব্যাপ্তি দেখে মাঝে মাঝে শিহরিত হতাম। বিশেষ করে পারস্য দেশের কবি, আরাবিয়ান কবি এবং উর্দু কবিদের বহু কবিতা তিনি অনুবাদ করে শোনাতেন। অনুষ্ঠান থেকে ফিরতে ফিরতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে যেত। ট্রেনে ওঠার সময় এক খিলিপান কিনে দিতেন সম্পাদক। তা মুখে পুরে নিয়ে রামপুরহাট স্টেশনে নেমে যেতাম।

অনেকবার স্বীকার করতে হয়েছে ‘দৌড়’ পত্রিকাটিই আমার প্রিয় পত্রিকা।

আশির দশকের শেষ ভাগ। কলেজ জীবন তখনও শেষ হয়নি। রামপুরহাট থেকে প্রকাশিত ‘বিকল্প’ পত্রিকার সম্পাদক ‘দৌড়’ পত্রিকার একটি কপি দিয়ে আমাকে বললেন ওই ঠিকানায় লেখা পাঠাতে। তখন পর্যন্ত কলেজ ম্যাগাজিন এবং ‘বিকল্প’ পত্রিকা ছাড়া তেমন আর কোথাও লিখিনি। নিজের লেখার প্রতি তখনও আত্মবিশ্বাস জেগে ওঠেনি। কোনো পত্রিকায় লেখা পাঠালে ছাপা হবে এরকম ভরসাও করতে পারতাম না। কিন্তু ‘দৌড়’ পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলাম কবিতা। তখন এক টাকার ডাক টিকিট খামের উপর বসিয়ে ঠিকানা লিখেই পাঠানোর রীতি ছিল। সেদিন কী লিখেছিলাম?

“দুর্ভাগ্যে ভেসে যাব আমি

বেকারত্ব আমার কপাল

দ্যাখো পৃথিবী—

কেমন করে মানুষ অবলুপ্ত হয়”

হ্যাঁ, এভাবেই শুরু হয়েছিল, কবিতাটির নাম ছিল ‘পৃথিবী দেখুক’। জীবনের প্রথম থেকেই এক প্রকারের হতাশা আর বঞ্চনা উপলব্ধি করেই তখন বড় হচ্ছিলাম। কারণ ছাত্রজীবন থেকেই আমাকে সংগ্রাম করে বড় হতে হচ্ছিল। এরকমই জীবনের কথা ছিল কবিতাটিতে। তাই প্রথম পাঠানো কবিতা ছাপা হবে কিনা কোনো ভরসাও ছিল না।

কিন্তু আশ্চর্য হয়েছিলাম কবিতা পাঠিয়ে খুব বেশি দিন আর অপেক্ষা করতে হয়নি। ‘দৌড়’ পত্রিকার সম্পাদক মধুমঙ্গল বিশ্বাস সুন্দর হস্তাক্ষরে একটি পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলেন আমার বাড়ির ঠিকানায়। সেই চিঠি প্রাপ্তির আনন্দ আমার কাছে এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে। একান্ত নিজস্ব মুহূর্তে সেই চিঠিখানি বারবার দেখেছি। সুন্দর হস্তাক্ষর এবং আন্তরিক উষ্ণতা ছড়ানো তার প্রতিটি শব্দমালা আমাকে উজ্জীবিত করেছে। এক স্বপ্নতীর্থের সন্ধান পেয়েছি যেন সেদিন থেকেই।

সেই আটের দশকের শেষভাগ থেকে আজও ‘দৌড়’ পত্রিকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি, বরং আরও গভীর হয়েছে। ‘দৌড়ে’র প্রায় প্রতিটি সংখ্যাতেই আমি লেখার সুযোগ পেয়েছি। আমার প্রথম গদ্য লেখার সূচনা হয়েছে ‘দৌড়’ পত্রিকাতেই। গদ্য লেখার মতো সাহস তখনও ছিল না। সম্পাদক একপ্রকার জোর করেই তাড়া দিয়ে আমাকে গদ্য লিখিয়েছেন। তারপর পুস্তক সমালোচনা, কবিতা নিয়ে বিশ্লেষণ, গল্প সংখ্যার জন্য গল্প লেখা একে একে প্রতিটি বিষয়েই আমাকে সড়গড় করে তুলেছেন। নিজেকে উজাড় করে লিখতে পেরেছি নিজের মতো লেখা। একের পর এক আত্মগত গদ্য, ১০ জন প্রিয়কবি বিষয়ে গদ্য, দাম্পত্য জীবনের গদ্য এবং কবিতা বিষয়ে বহু বিচিত্র গদ্য প্রকাশিত হয়েছে। সম্পাদক জানেন, কাকে দ্বারা কী লেখানো সম্ভব। পত্রিকা বিষয়ে বিভিন্ন সংখ্যা নিয়ে নানা পরিকল্পনাও করেছেন যা আমার কাছে মনে হয়েছে এক মেধাবী উত্তরণ। খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করেছি, ‘দৌড়’ পত্রিকা আর পাঁচটা পত্রিকার মতো গতানুগতিক হয়ে ওঠেনি। বারবার বিষয় পরিবর্তন, আঙ্গিক পরিবর্তন, প্রচ্ছদ ও গেটাপ নিয়ে নতুন ভাবনা পত্রিকাটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বাংলাদেশের নামকরা বহু কবির সঙ্গে তরুণ কবিরাও এই পত্রিকায় লিখেছেন। ত্রিপুরা, অসম এবং বহু প্রবাসী কবিও এই পত্রিকায় লেখার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন। আমার খুব মনে পড়ে, মধ্যপ্রদেশের ছত্রিশগড়ে থাকতেন তেজেন্দ্রলাল মজুমদার। প্রবীণ সাহিত্যিক। তাঁর শ্রেষ্ঠকবিতাসহ বহু কাব্য ও গল্পগ্রন্থ ‘দৌড়’ প্রকাশনা থেকে প্রকাশ করেছেন। দীর্ঘদিনের তিনি ‘দৌড়’ পত্রিকার লেখকও। তেমনি অকাল প্রয়াত সঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা ‘দ্বৈরথ’ নামে একটি বিখ্যাত উপন্যাস এই প্রকাশনা থেকে প্রকাশ করেছিলেন। অপরদিকে তীর্থঙ্কর মৈত্র, চিত্তরঞ্জন হীরা প্রমুখ বিশিষ্ট সাহিত্যিক এই ‘দৌড়’ পত্রিকার নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। যার ফলে ‘দৌড়ে’র সামগ্রিক পরিকল্পনায় আমরাও সমৃদ্ধ হয়েছি।

শুধু লেখা প্রকাশ করেই ‘দৌড়’ পত্রিকার সম্পাদক নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন তাই নয়, তরুণ কবির গুচ্ছ গুচ্ছ লেখা প্রকাশ করে এবং তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে এবং তাঁর লেখার মান অনুযায়ী তাঁকে ‘দৌড়-সাহিত্য পুরস্কার’ প্রদান করেও সম্মানিত করেছেন। সাহিত্য জগতে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছেন। এমনকী আমার মতো কলকাতা থেকে বহু দূরে অবস্থিত এক প্রান্তিক কবিকে এই সম্মান জানাতে কার্পণ্য করেননি। সাম্প্রতিক কালে আমাকে নিয়ে ‘দৌড়’ পত্রিকার একটা বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করেছেন যা আমার কাছে অভাবনীয়। এই মুহূর্তে এত বড় হৃদয়ের মানুষ আমি আর খুঁজে পাইনি। সবাই যখন নিজেকে নিয়েই ভাবছেন, নিজের মান-যশ-খ্যাতির জন্য অস্থির হয়ে উঠছেন, তখন ‘দৌড়ে’র সম্পাদক বাংলা সাহিত্যের কথা ভাবছেন, প্রান্তিক কোনো সাহিত্যিকের প্রতিভার অন্বেষণ করছেন, তাঁর মূল্যায়ন করার আয়োজন করছেন এ কী কম কথা? সমস্ত যৌবনকাল ধরে আমার বিনম্র পাগলামি গুচ্ছ ‘দৌড়’ যেমন সহ্য করে এসেছে, তেমনি আজও প্রৌঢ়ত্বের সোপানে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ও ‘দৌড়’ আমাকে দূরে ঠেলে দেয়নি। বরং আমার সৃষ্টিকে সম্মান জানিয়ে আগে যেমন আমার প্রথম কাব্য ‘কোথায় পা রাখি'(১৯৯৪), ‘বৃষ্টিতরু'(১৯৯৯) প্রকাশ করেছে, তেমনি ‘দৌড়’-এরই প্রকাশিত ‘প্রত্নচরিত’ কাব্যগ্রন্থটিকে পুরস্কৃত (২০১৫) করেছে।সম্প্রতি আমার সামগ্রিক মূল্যায়ন করতেও তৎপর হয়েছে। কলকাতা যখন কলকাতাকে নিয়েই ব্যস্ত, তখন ‘দৌড়’ পত্রিকা সমস্ত বাংলা ভাষাভাষীর জন্যই উন্মুক্ত। নিরপেক্ষতায় সহমর্মিতায় প্রকৃত প্রতিভার মর্যাদা এবং ভালোবাসা জানাতে সর্বদা তৎপর। শুধুমাত্র প্রতিভার গুণেই একজন লেখক ‘দৌড়ে’র কাছে সম্মানিত, এছাড়া আর কোনো কৌলিন্য নেই, গোষ্ঠীবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ, জাতিবাদ, ধর্মবাদ ‘দৌড়’ কখনও বিশ্বাস করে না। যখনই কোনো রাজনৈতিক দল অমানবিক আচরণ করেছে, মানবহন্তারকের ভূমিকা গ্রহণ করেছে— ‘দৌড়’ তখনই প্রতিবাদ জানিয়েছে। মরিচঝাঁপি সংখ্যা, সিঙ্গুরের জমি আন্দোলন সংখ্যা, ভাষা সংখ্যা, বাংলাদেশের সাহিত্য সংখ্যা ইত্যাদি বহু সংখ্যা প্রকাশ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। প্রথম থেকেই ‘দৌড়’কে তাই এক মানবিক আশ্রয়ের পরাকাষ্ঠা হিসেবেই দেখেছি। অন্যায়ের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর হিসেবেই পেয়েছি। কখনোই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বিসর্জন দেয়নি। বিশুদ্ধ সাহিত্যের সঙ্গে যেমন পথ চলতে চেয়েছে, তেমনি কখনোই কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে নিজ আদর্শের রূপান্তর ঘটায়নি।

বহু পত্রিকার উত্থান-পতন ঘটছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে। কিন্তু ‘দৌড়ে’র ইতিহাসে চিরদিনই এক বিশুদ্ধ ঐতিহ্যের প্রজ্ঞাময় দীপ্তি প্রতিভাত হবে। ইতিহাসে লেখা থাকবে, শুধুমাত্র সাহিত্যকে ভালবেসে, সাহিত্যিককে ভালোবেসে এক তরুণ তাঁর স্কুল জীবন থেকেই শুরু করেছিলেন যে পত্রিকাটি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিজ আদর্শে অবিচল থেকে তাকে সচল রেখেছিলেন। বহু প্রান্তিক সাহিত্যিককে তুলে এনেছিলেন। যাঁদের কথা কেউ বলতে চায়নি, যাঁদের লেখা কেউ ছাপতে চায়নি, যাঁদের প্রতিভার মূল্য কেউ দেয়নি—তাঁদেরই আশ্রয়দাতা ছিল ‘দৌড়’। ‘দৌড়’ যে আমার মতো অনেকেরই প্রিয় পত্রিকা তা একদিন ইতিহাসও সেই কথা বলতে বাধ্য হবে। ‘দৌড়’ দপ্তরের নাম ‘কুটুমবাড়ি’ আমার কাছে পার্থিব স্বর্গের মতোই চিরদিন আপন হয়েই বিরাজ করবে সাহিত্যের তীর্থক্ষেত্র হিসেবে।

চলবে….

তৈমুর খান

Leave a Reply