এই কবিতাজীবন (ধারাবাহিক)
🐦
পর্ব-১৬
কাছের বন্ধু-স্বজন
🍁
নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকেই পুরো শূন্য দশক পর্যন্ত বহু বন্ধু-স্বজনদের কাছাকাছি পেয়েছি। শুধু টিউশনি করা আর কবিতার আড্ডায় মশগুল হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। তখন গ্রামের বাড়ি পানিসাইলে থাকি। রামপুরহাটে টিউশনি পড়াতে আসি। টিউশনি পড়ানো হয়ে গেলে রেলপাড়ে বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে আড্ডা বসে। বাপ্পাদিত্য শুধু কবিতা লেখে না, ছোটগল্প, প্রবন্ধ যেমন লেখে তেমনি ছবিও আঁকে। ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়ে সে ইংরেজিতে অনার্স করে আর উচ্চশিক্ষার জন্য চেষ্টা করেনি। সর্বক্ষণ সাহিত্য-শিল্প চর্চা করেই সময় কাটায়। তার প্রতিটি লেখার আমি পাঠক।লেখা পড়ে মৌখিক মতামত নয়, লিখিত ভাবেই তার বিশ্লেষণ করতে হয়। এমনি করেই কোনো কোনোদিন কেটে যায়। সেদিন বাপ্পার বাড়িতেই খাওয়া-দাওয়া সেরে নিই। দিশেহারা যৌবনকালে বাপ্পার সঙ্গেই সব কথা শেয়ার করি। ‘দেশ’ পত্রিকায় চিঠি লিখে তখন একটা পরিচিতি ঘটেছে। ক্ষুধা ও হতাশা নিবারণের একটি পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাহিত্যচর্চা।পঁচিশ বছরের যুবক তখনও জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। পানিসাইল গ্রামে ‘নবীন সংঘ’ নামে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে এগারোই জ্যেষ্ঠ ও পঁচিশে বৈশাখ পালন করি। সাহিত্যের আবহাওয়ার মধ্যেই নিজেদের ব্যস্ত রাখি। মাথার উপর অভিভাবক হিসেবে আছেন শ্রীশঙ্করলাল রায়। ‘ডানা’ পত্রিকার সম্পাদক সত্যসাধন চট্টোপাধ্যায় বিশেষভাবে স্নেহ করেন। কবিতার আঙ্গিক গঠন নিয়ে একটি প্রবন্ধ সেই ‘ডানা’ পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়। তারপর থেকেই নিয়মিত লেখক। শ্যামচাঁদ বাগদির তাগাদায় ২০০৩ সালে ‘খা শূন্য আমাকে খা’ এবং ২০০৪ সালে ‘আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা’ প্রকাশিত হওয়ার পর কবিতা বিষয়ে গদ্যগুলি নিয়ে প্রকাশ করে ‘কবির ভাঁড়ারের চাবি'(২০০৬)। সেই সময় বইটি পাঠক মহলে খুব সাড়া ফেলেছিল। তবে সবচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা হয়েছিল ‘কাঞ্চিদেশ’ পত্রিকাটির সম্পাদকীয় বিভাগে থাকার সময়। শ্যামচাঁদেরই তত্ত্বাবধানে ২০০২ সালে ‘কাঞ্চিদেশ’ প্রকাশিত হয়। পত্রিকার নামকরণ করেন শ্রীশঙ্করলাল রায়। সাহিত্যের প্রায় সব বিভাগেই লেখা ছাপা হতে থাকে। পত্রিকার সিংহভাগ লেখা সংশোধন করতে হয় আমাকেই। তবে শ্যামচাঁদের কঠোর পরিশ্রমে পত্রিকাটি অল্প দিনেই সুনাম অর্জন করে।
আমাদের জীবনে সাম্প্রতিক কালের কবিতার বিষয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করেন সত্যসাধন চট্টোপাধ্যায়। শ্যামপাহাড়ি ট্রেনিং কলেজের তিনি ছিলেন অধ্যাপক। একইসঙ্গে ইংরেজি ও অর্থনীতিতে মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। নিজে ছিলেন জীবনানন্দ দাশের ভক্ত। নিজের লেখার মধ্যে নাথিংনেস্ ভাবনাতেই সক্রিয় ছিলেন। খুব কম কথা বলতেন, কিন্তু দার্শনিক চিন্তায় সব সময় বিভোর থাকতেন। তাঁর কাছেই ইংরেজি সাহিত্যের বহু পাঠ গ্রহণ করেছি। ডব্লিউ বি ইয়েটস, টি এস এলিয়ট, আলবার্ট কামু,জাঁ পল সাঁতরা, ওয়াল্ট হুইট ম্যান, ই ই কামিংস প্রমুখ বহু সাহিত্যিকের সাহিত্য বিষয়ে সম্যক ধারণা দিতে পেরেছিলেন। পরে ‘ডানা’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগেও আমাকে ঠাঁই দিয়েছিলেন। কবিতার ভাবদর্শনে তিনি ছিলেন আমাদের দার্শনিক প্রজ্ঞাদানের একমাত্র অভিভাবক। নির্মোহ চালচলনের ভেতর সাদাসিধে জীবনযাপনই আমরা অনুকরণ করতে থাকি। তিনি ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের বংশের উত্তরসূরী। তাই তাঁর মননচিন্তনে মানবমহিমার গভীর পরিচয় ফুটে উঠত।
রামপুরহাটে আর একজনকে আমরা প্রথম থেকেই পেয়েছিলাম তিনি হলেন বিজ্ঞানের ছাত্র অনিমেষ মণ্ডল। বয়স কম হলেও সাহিত্যের নতুনত্ব অনুধাবন করার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। আমাদের সঙ্গেই সর্বক্ষণ থাকত। তার বিখ্যাত বই ‘ভারতবর্ষ কোনোদিন জানবে না’ এবং ‘আমার কোনো প্রতিভা নেই’ সেই সময় যথেষ্ট সাড়া ফেলে। পরবর্তীকালে আরও বহু কাব্যগ্রন্থ এবং গদ্যের বই প্রকাশিত হয়েছে। অনিমেষ বিজ্ঞান ও দর্শনকে যেমন একসঙ্গে মিলিয়েছেন, তেমনি আত্মযাপনের ভেতর এক ভিন্ন জীবনপ্রজ্ঞারও উপলব্ধি করেছেন। আমরা একই সঙ্গে সাহিত্যচর্চা করলেও সম্পূর্ণ ভিন্নধারার দুই মেরুর জীবনপথিক।
কবিতাজীবন যে আমাদের বাস্তবজীবনেরই আরেকটি রূপ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাস্তবজীবনে যতোবারই সংঘাত এসে আছড়ে পড়েছে, কবিতাজীবন ততোবারই শব্দ অন্বেষণ করেছে।মন যখনই পুড়েছে, কবিতাজীবন তখনই ছাই উড়িয়েছে। সুতরাং কবিতা আত্মার গান, উপলব্ধির স্বরলিপি, মরমের বাতাস। যার মধ্যে কষ্ট আছে, শূন্যতা আছে, অন্ধকার ও আলো আছে। প্রেম এসে বারবার আঘাত করেছে। দরজা খুলে প্রেমকে ভেতরে আসতে বলেছি। প্রেম ভিতরেও এসেছে। কিন্তু সেই প্রেমেকে পূর্ণতা দিতে পারিনি। প্রেম নিজে থেকেই চলে গেছে। একটা কষ্ট আর একটা কষ্টের কাছে গিয়ে শান্তি পেতে চেয়েছে। একটা অন্ধকার আর একটা অন্ধকারের কাছে গিয়ে আলো পেতে চেয়েছে। সমগ্র জীবন ধরে শুধু মৃত্যু রচনা করে যাওয়ার নামই কবিতা। যদিও বাঁচতে চাওয়ার আকুলতা তারই নামান্তর। বাপ্পা একবার বলেছে, ‘এইসব প্রেমের চিঠিগুলো নিয়ে ভবিষ্যতে একটা উপন্যাস লিখব। যে কবিকে আমরা পেয়েছি, তার জীবন যন্ত্রণাকে পাঠকও অনুভব করবে।’
কত চিঠি তখন লেখা হত। কত ধৈর্য নিয়ে তারা লিখত। প্রতি সপ্তাহেই পেতাম তাদের চিঠি। আমাকে উত্তর দিতে হত। আমার বসন্তে ফুল না ফুটলেও যে কোকিল ডেকে যেত তা এই চিঠিগুলিই ছিল তার প্রমাণ। বাপ্পা কোনোদিন উপন্যাস লিখতে পারবে না তা আমিও জানতাম। তবু চিঠিগুলো আমাকে বোঝার মতো ভারী মনে হত।
মুম্বাই থেকে শিক্ষিত একটি মারাঠি যুবতী এদেশীয় এক রাজমিস্ত্রির সঙ্গে প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে আসে। এসে দেখে তার প্রেমিকের পূর্বের ছেলেমেয়েসহ স্ত্রী বর্তমান। ছোট্ট একটা বাড়িতে থাকার জায়গাও নেই। রাজমিস্ত্রি শুধু তার সোনার অলংকারপাতি ও টাকাপয়সা হাতিয়ে নেবার জন্য তাকে নিয়ে এসেছে। এক মাসেরও বেশি আর সে তার বাড়িতে থাকতে পারে না। তাকে বাড়ি থেকে বেরও করে দেয়। হিন্দিভাষী এই যুবতী স্টেশনে বসে একাকী কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার কাছে একটা টাকাও নেই। তাকে স্টেশন থেকে ফিরিয়ে এনে কয়েকদিন এক বিধবা পিসির বাড়িতে রেখে অবশেষে মুম্বাই ফেরত পাঠানোর আয়োজন করি। সমস্ত গ্রাম ঘুরে চাঁদা তুলে শ-তিনেক টাকায় টিকিট কেটে তাকে ট্রেনে তুলে দিই। সেই কৃতজ্ঞতা সে ভুলতে পারে না। অনেক চিঠির পর চিঠি লিখতে থাকে। এক একটা চিঠি এক একটা কবিতার মতো। একটা চিঠির বাংলা তরজমা করলে এরকমই দাঁড়ায়:
“মৃত্যু থেকে ফিরিয়ে দিয়েছ তুমি
বাকি জীবন আমি তোমাকেই দিতে চাই
একজন পুরুষ যদি শয়তান হয়
আর একজন তবে দেবতা নিশ্চয়।
মরীচিকারাই স্বপ্নের ভ্রম আঁকে
তৃষ্ণাকাতর পথিকের ভুল হয়
তবু তো পথের বাঁকে
কিছু সুহৃদ পাওয়া যায়।”
এই মেয়েটির নাম ছিল সুজাতা সোহান্ট। একটা কোম্পানিতে ক্লার্কের চাকরি করত। বাড়িতে এক ভাই আর বিধবা মা। মুম্বাই না ফিরে গেলে তাদেরও অসহায় অবস্থা। যে কয়টা টাকা এতদিন জমিয়েছিল তা এই প্রেমিকেরই হস্তগত হয়ে গেছে। মুম্বাইয়ের চাঁদনী চক এলাকায় তার বাড়ি। অন্তত একবার গেলে যেন দেখা করি এই তার আবেদন ছিল। কিন্তু যেতে পারিনি। মনের মধ্যে কিছুটা জমি দখল করলেও সে আপনজন হয়েই থেকে গেছে। একদিন ওকে ব্রহ্মণী নদীর তীরে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম:
‘বিবাহিত জীবন কেমন লেগেছিল?’
উত্তরে জানিয়েছিল, ‘যার সঙ্গে এসেছিলাম সে মস্তিষ্ক বিকৃত অসভ্য একটা মানুষ। কোনো সুখই অনুভব করতে পারিনি। বরং তার আচরণ ছিল শত্রুর মতো।’
আমি বলেছিলাম, ‘তাহলে প্রেম করেছিলে কেন?’
উত্তরে সে জানিয়েছিল, ‘ওখানে খুব ভালো ব্যবহার করত, অভিনয় করত গ্রামের একজন সাদাসিধে মানুষ হিসেবে। তাই ভেবেছিলাম লোকটা খুব সরল।’
এখন কবিতা লিখতে গেলে ওর মুখটি মনে পড়ে। একটা স্বপ্ন দেখা জীবন কীভাবে ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তাই লিখতে বসলেই নিজের অজান্তেই লিখে ফেলি:
“সাধনা
———-
হৃদয় খাতায় বাক্য ও শব্দেরা শুয়ে আছে
এত দীর্ঘশ্বাসের পর কাকে জাগাব আজ?
মাথার ওপর মেঘেরা জমেছে
বাগানে ময়ূর নেই,বাগান ঘিরে রেখেছে সমাজ
কোলন আর সেমিকোলনে কিছুটা বিশ্রাম
মাঝে মাঝে যদিও বসেছে ড্যাস
বিকল্প কমার কাছে বিবৃতির বিন্যাস
সমূহ শূন্যতা নিয়ে উদাসীন চেয়ে রইলাম
সব নিবেদন পুড়ে গেলে স্বপ্নেরা বসবে কোথায়?
দাঁড়ি টেনে টেনে সব সহজিয়া বোধ
বাউলের ঘরকন্নায় ডুবে যায়
একে একে সম্মোহন সাজায় নির্বোধ…”
তৈমুর খান