লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদকেরাও যথার্থ লেখার মূল্য দিতে জানেন
তৈমুর খান
‘সাহিত্য আলপনা’ পত্রিকার সম্পাদক রাজীব ঘাঁটীর কথাটি মরমে খুব স্পর্শ করল। সে বলল: “মফস্সলের লিটিল ম্যাগাজিনগুলির লেখককে দেওয়া সাম্মানিক প্রায় গুরুত্বহীন। এর কোন কদর নেই।”
রাজীবের এই কথার উত্তরে শুধু একটি কথাই বলতে চাই: এর গুরুত্ব অপরিসীম। লিটল ম্যাগাজিনের দেওয়া ৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ২০০ টাকা, অথবা আরো বেশি কিছু প্রাপ্তি আমার জীবনে ঘটেছে। বাণিজ্যিক ম্যাগাজিনে লিখে ২০০০ , ৫০০০, ১০০০০ পেয়েও যতটা না আনন্দ হয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি আনন্দ হয়েছে লিটিল ম্যাগাজিনের সামান্য ওই কয়টি টাকায়। ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথের ‘কথা ও কাহিনী’ কাব্য থেকে ‘শ্রেষ্ঠদান’ কবিতাটি আমার কাছে আদর্শ ছিল। আর বর্তমানে এই আদর্শ লিটিল ম্যাগাজিনের দেওয়া অর্থ।
আমার জীবনের কিছু বাস্তব মুহূর্ত আজও আমাকে স্মৃতিকাতর করে তোলে। ছোটবেলায় আমার সবচেয়ে গরিব মেজো পিসির বাড়ি যেতে আমি বেশি পছন্দ করতাম। কী কারণ ছিল তা বলতে পারবো না। পিসিদের এতই অভাব ছিল যে, একবেলা খেয়ে আরো দুবেলা প্রায় উপোস দিতে হত। কাঠ খড় ঘুঁটে ঝরাপাতা কুড়িয়ে সন্ধ্যেবেলায় মাটির উনানে রান্না হত ভাত। তরকারি হত বেগুন পোড়া, শাকপাতা, তেঁতুলসহ পুঁটিমাছ। ওই একবার খেলেও পরম তৃপ্তি উপভোগ করতাম। কয়েকদিন থাকার পর পিসি ঘুঁটে বিক্রি করা আটআনা-চারআনা পয়সা দিত। তাই নিয়ে পকেটে বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফিরতাম। যেন রাজা-বাদশারাও যুদ্ধ জয় করে অমন আনন্দ পেত না।
এখন এই লিটিল ম্যাগাজিনগুলিকেও আমার সেই গরিব ঘুঁটে কুড়ানি পিসিমার মতোই মনে হয়। ক্ষুন্নিবৃত্তির জীবন যে কত আনন্দময় হয়, কত আন্তরিক হয়, কত মায়ামমতার পরশ মাখানো হয় তা বলে বোঝাতে পারবো না। তাই বারবার লিটিল ম্যাগাজিনগুলিতে লিখি। অর্থ দিলেও লিখি, না দিলেও লিখি। সেখানে লিখেই আনন্দ পাই।
বাণিজ্যিক ম্যাগাজিনগুলি ধনী লোকের বাড়িতে বিরিয়ানি খাওয়ার নিমন্ত্রণের মতোই। সেখানে ভদ্রলোক সেজে আরাম আয়েশে উপবেশন করা যায়, ঢেকুর তোলা যায়, নিজের প্রগলভ জানান দেওয়া যায়, অন্যকে ঘৃণা করা যায়, অন্যের সঙ্গে নিজেকে তফাত করা যায়, কিন্তু প্রকৃত মনের আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায় না। এক কৃত্রিম ট্রেডমার্কা লেভেলে নিজেকে বাজারজাত করা যায় মাত্র।
তবু তো লিখতে হবে, একজন লেখককে সর্বত্রই লিখতে হবে। যখন লেখাটিই তার কাজ, তখন কোনো মাধ্যমকেই দূরে সরিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। প্রতি বছরের মতো এ বছরও বেশকিছু লিটিল ম্যাগাজিন আমাকে তাদের ‘শ্রেষ্ঠদান’ পাঠিয়েছে। ১০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত। এমনকী কিছু নেট (ব্লগ) ম্যাগাজিনও অর্থ পাঠিয়েছে এবং নেহাত তার পরিমাণ কম নয়।
রাজীব ঘাঁটীর মতো সম্পাদক, ‘উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা’ পত্রিকার সম্পাদক, ‘বিকল্প বার্তা’ পত্রিকার সম্পাদক, ‘খোঁজ’ পত্রিকার সম্পাদক, ‘উদ্ভাস’ পত্রিকার সম্পাদক, ‘সুখপাঠ’ পত্রিকার সম্পাদক এবং আরো বেশকিছু সম্পাদক যাঁরা সারাবছর ধরে শুধুমাত্র লিটিল ম্যাগাজিন করার জন্য ব্যক্তিগত জীবনের খরচ কমিয়েও লিটিল ম্যাগাজিন প্রকাশ করার স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের ত্যাগ কতখানি তার পরিমাপ করা যাবে না।
এদের সংসার পরিজন সুখস্বপ্ন এই ম্যাগাজিন করার জন্যই অনেকটাই বঞ্চিত হয় তা বলাই বাহুল্য। শুধুমাত্র সাহিত্যকে ভালবেসে, বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে, নিঃস্বার্থভাবেই নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। চর্চাকারী কবি-লেখকরা তাঁদের সৃষ্টিকে এইসব সম্পাদকের হাতে তুলে দিয়ে স্বস্তি বোধ করেন। কালের নিরিখে কার লেখা অমর হবে, কে টিকে থাকবেন সে বিচার করার ভার সম্পাদকের নেই।
তবে সমসাময়িক কালের নিরিখে তিনি যে সৃষ্টিকে অনন্য এবং অসাধারণ ভাবেন তাকেই প্রকাশ করে চলেন। পত্রিকাও স্বাধীনভাবে সম্পাদনা করেন। অনেক সময়ই তিনি ঋণগ্রস্ত হন। অক্লান্ত পরিশ্রমে বিজ্ঞাপনের পথেও হাঁটেন, কিন্তু কখনোই লেখকদের কাছে অর্থের বিনিময়ে যেকোনো ধরনের লেখা সবসময়ই ছাপতে চান না। তিনি একটা মূল্যমান অবশ্যই বিচার করেন। এখানেই একজন প্রকৃত সম্পাদকের অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য বলেই মনে করি।