** ঐতিহাসিক একটি বিতর্কিত প্রশ্নে আলোকপাত,মতামত লেখকের ব্যক্তিগত। **
“শারদীয়া সাতকাহন ” এ প্রকাশিত।
প্রবন্ধ : সুভাষ কেন জার্মানির সাহায্য নিয়েছিল ?
সত্যেন মণ্ডল
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে ক’জন প্রতিভা সূর্যের মত দীপ্ত তাদের অন্যতম হলেন সুভাষ। একমাত্র সুভাষ চন্দ্র বসুই অনুভব করতে পেরেছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রকৃত পথ কীরূপ হওয়া উচিত। ভারতের ভাগ্যাকাশে যখন সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শোষণ রাহুর মতো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল বা জড়িয়ে ধরেছিল, ভারতীয়দের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক জাতীয় স্বার্থ যখন বিসর্জিত সেই মুহূর্তে সুভাষ এসে ছিলেন ভারতের বঞ্চিত হতভাগ্য মানুষদের কান্ডারী হিসাবে।
আজ অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন সুভাষ কেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য ফ্যাসিস্ট জার্মানির সাহায্য নিয়েছিলেন, প্রশ্নটা যদিও বিতর্ক মূলক তবু সুভাষ চিন্তাধারার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সেটা বিশ্লেষণ করতে হবে ।তবে প্রথমেই জানা প্রয়োজন যে স্বাধীনতার স্বরূপ কীরূপ ? একদলের অভিমত সর্ব প্রকার বন্ধন মুক্তি , অপরদিকে মার্ক্সীয় চিন্তাবিদদের অভিমত শোষণ মূলক সকল প্রকার বন্ধন মুক্তি ।তবে উভয় মতবাদের ক্ষেত্রেই কিছু কিছু Restriction অবশ্যই থাকবে । তাহলে দেখা যাচ্ছে যে স্বাধীনতা প্রসঙ্গে দ্বিতীয় অর্থাৎ মার্ক্সীয় চিন্তাবিদদের অভিমত দাঁড়াচ্ছে এই যে সাম্রাজ্য বাদী শোষণ মুক্তি তো বটেই, তার সঙ্গে সঙ্গে বুর্জোয়াদের হাত থেকেও শোষণ মুক্তি।
এবার আসা যাক 41-42এর আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে । তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে।গোটা বিশ্ব থর থর করে কাঁপছে,একদিকে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্ জোট জার্মানি ইটালি জাপান অন্যদিকে ফ্রান্স, রাশিয়া,ব্রিটেন। পরে এই জোটে যোগ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমতাবস্থায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন কিরূপভাবে পরিচালনা করা সম্ভব ? এই নিয়ে গান্ধী নেহেরু প্রমুখ নেতারা যখন চিন্তিত তখন 1941 এর জানুয়ারী মাসে সুভাষ চন্দ্র দেশত্যাগ করেছিলেন এবং প্রথমে তিনি যান সোভিয়েত রাশিয়ায়।ভারতের মুক্তি সংগ্রামে রাশিয়ার সাহায্যের প্রত্যাশী হয়ে,কিন্তু 1941এর জুনে রাশিয়া জার্মানির দ্বারা আক্রান্ত হওয়ায় মিত্র শক্তি অর্থাৎ ব্রিটেন ও ফ্রান্সের পক্ষাবলম্বন করে। ফলে সুভাষ রাশিয়ার কাছে কোন সাহায্য না পেয়ে বিফল মনোরথে জার্মানির কাছে পৌঁছালেন। এবং জার্মানির কাছে কিছু সাহায্যের আশ্বাস পাবার পর মুক্তি আন্দোলন গড়ে তোলেন, পরে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সুভাষ চন্দ্র জাপানে গেলেন ,জাপানের সাহায্যে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আজাদ হিন্দ সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন।
স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন আসতে পারে রাশিয়া তো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল এবং তার সংগ্রাম যখন পৃথিবী থেকে সাম্রাজ্যবাদ হঠানোর, আদর্শ যখন স্বাধীনতা ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ,তখন রাশিয়া কেন সুভাষকে সাহায্য করলনা ? এই আলোচনার পূর্বেই আমাদের জানা প্রয়োজন, প্রত্যেক জাতির একটা স্বতন্ত্র জাতীয় স্বার্থ থাকে এবং তা বৈদেশিক নীতি পরিচালনার চাবিকাঠি।
রাশিয়া তখন নিজের দেশের জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করেই সুভাষকে সাহায্য করতে পারেনি।যার ফলে সুভাষ ভারতের স্বতন্ত্র জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করেই জার্মানীর সাহায্য লাভের প্রত্যাশী হয়ে ছিলেন। বস্তুত এর মানে এই নয় যে সুভাষ ব্রিটিশ শোষণ এর পরিবর্তে জার্মান বা জাপানের শোষণ আনতে চেয়েছিলেন। সুভাষ যা চেয়েছিলেন তা হল ভারতের স্বাধীনতা তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতেই।
কিন্তু তখন সুভাষের উক্ত কার্য্যকলাপ ভারতের কিছু কিছু নেতৃবৃন্দের বিশেষ করে সাম্যবাদী এবং কিছু কংগ্রেস ভাবাপন্ন ব্যক্তিদের মধ্যেও ভয়ের উদ্রেক করে , সুভাষ খাল কেটে কুমির আনার চেষ্টা করছেন এবং বাঘের খাঁচা থেকে সিংহের খাঁচায় আমাদের ঢোকাতে চাইছে ,এই ভাবনার ফলে সুভাষের জাতীয় বাহিনী যখন ভারত আক্রমণ করল তখন গোটা ভারত বর্ষে ক্রোধ তেমন ফেটে পড়ল না ।
জনমত তখন অন্যরকম, সুভাষ হতাশ হলেন ,বস্তুত ব্রিটিশ নেতৃবৃন্দের কূটনৈতিক চালে এবং ভারতের এক শ্রেণির স্বাধীনতা সংগ্রামীর অমনোযোগ এবং অসহযোগিতায় সুভাষের আন্দোলন আর এগুতে পারলনা ।
DIPLOMAT সুভাষের চিন্তাধারার স্বরূপ অনেকেই উপলব্ধি করলনা , মিথ্যা একটা ছুঁতা দেখিয়ে এবং মিথ্যা মতবাদ প্রচার করে সুভাষের ত্রুটি ধরা হল, আজও হচ্ছে । কিন্তু উপরোক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সুভাষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েই জাপান ও জার্মানীর সহায়তায় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু দুঃখের এবং পরিতাপের বিষয় সেই সময়ের কংগ্রেস এবং কম্যুনিস্টরা কিন্তু কেউই সুভাষের ঐ কাজকে ভাল চোখে দেখেনি । এখন অবশ্য সুভাষ সম্পর্কে মূল্যায়নের পরিবর্তন হয়েছে ।
সুভাষের চিন্তাধারাকে যদিও এখন বিকৃত করার প্রবণতা কমেছে । সুভাষ আগে চেয়েছিলেন ঔপনিবেশিক শোষণ থেকে মুক্তি তারপর চেয়েছিলেন শোষণমূলক সকল বন্ধন থেকে মুক্তি,আজ সুভাষ চন্দ্রের মহান কর্মে আমরা গর্বিত বোধ করি বস্তুত সুভাষের জাতীয় বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হবার পরই ব্রিটিশরা উপলব্ধি করেছিল খুব শীঘ্রই তাদের ভারত ত্যাগ করতেই হবে ।
তার মতবাদের বিকৃতি না করে প্রচার ও প্রসার ঘটুক,ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষের গৌরব দীপ্ত ভূমিকা চিরকাল সূর্যের মতো ভাস্বর হয়ে থাকুক ,ভাস্বর হয়ে থাকুক সত্যনিষ্ট প্রত্যেক ভারতবাসীর হৃদয়ে ।
সত্যেন মণ্ডল