
প্রবন্ধ
ফ্রান্ৎস কাফকা
শংকর ব্রহ্ম
ষষ্ঠ পর্ব
শিক্ষা
১৮৮৯ থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত কাফকা প্রাগের তখনকার মাসনা স্ট্রিটে ‘জার্মান বয়েজ এলিমেন্টারি স্কুলে’ পড়াশোনা করেন। তাঁর বয়স ১৩ হলে ‘বার মিৎজভাহ্’ (ইহুদি ছেলেদের বালেগ হওয়ার ধর্মীয় অনুষ্ঠান) অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কাফকার ছোটবেলার ধর্মীয় পড়াশোনার শেষ হয়। কাফকা কখনোই ইহুদি উপাসনালয় সিনাগগে যেতে পছন্দ করতেন না; বছরে মাত্র চারবার বাবার সঙ্গে ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানাদির জন্য সিনাগগে যেতেন।
১৮৯৩-এ এলিমেন্টারি স্কুল ছেড়ে কাফকা প্রাগের ওল্ড টাউন স্কোয়ারের ওপর অবস্থিত কিন্স্কি প্যালেসে (এটারই নিচতলায় ছিল তাঁর বাবার দোকান) কড়া শাসনের ও ক্ল্যাসিক্যাল শিক্ষাদান রীতিতে চালানো জার্মান মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন। এখানে পড়ার মাধ্যমে ছিল জার্মান, কিন্তু কাফকা চেক বলতে ও লিখতে পারতেন।
তাঁর চেক ভাষায় দখলের জন্য তিনি প্রশংসাও কুড়িয়েছিলেন, কিন্তু নিজেকে তিনি চেক ভাষায় সাবলীল মনে করতেন না। ১৯০১-এ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে কাফকা প্রাগের জার্মান কার্ল-ফার্দিনান্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। শুরু করেন রসায়নে, কিন্তু দুই সপ্তাহ পরে আইনের ছাত্র হয়ে যান। আইন নিয়ে পড়াশোনা তাঁর ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ ছিল না, কিন্তু তাঁর বাবা খুশি হয়েছিলেন, কারণ আইনশাস্ত্রে পড়াশোনা শেষে ভালো ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব। এখানে কাফকার বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন সাংবাদিক ফেলিক্স ভেলট্শ্, লেখক অস্কার বাউম, ফ্রানৎস ভেরফেল্ প্রমুখ। প্রথম বছরের পড়া শেষ হতেই কাফকার সঙ্গে পরিচয় হয় ম্যাক্স ব্রডের। ম্যাক্সও ছিলেন আইনের ছাত্র।
শুরু হয় কিংবদন্তিতে রূপ নেওয়া এক আজীবন বন্ধুত্বের। ম্যাক্স ব্রডই প্রথম খেয়াল করেন খুব কম কথা বলা, লাজুক ধরনের এই ছেলেটির মেধা ও প্রজ্ঞা গভীর ও অগাধ। জীবনভর কাফকা খুব উৎসুক পাঠক ছিলেন। ম্যাক্স ও তিনি একসঙ্গে, ম্যাক্সের পরামর্শে, মূল গ্রিক ভাষায় প্লেটোর Protagoras পড়েন এবং কাফকার পরামর্শে তাঁরা দুজনে আবার একসঙ্গে মূল ফরাসিতে ফ্লবেয়ারের Sentimental Education ও The Temptation of Saint Anthony পড়েন। কাফকা চারজন লেখককে তাঁর ‘সত্যিকারের রক্তের ভাই’ বলে ভাবতেন: দস্তয়ইয়েফ্স্কি, ফ্লবেয়ার, ফ্রানৎস গ্রিলপারসার ও হাইনরিখ ফন ক্লাইস্ট । এর পাশাপাশি চেক সাহিত্য ভালোবাসতেন কাফকা আর গ্যেয়টেকে খুব পছন্দ করতেন। ১৯০৬ সালের ১৮ জুলাই তিনি আইনশাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি পান এবং এর পরে এক বছর আদালতে বাধ্যতামূলক বেতনহীন ক্লার্কের চাকরি করেন। পড়াশোনার ক্ষেত্রে কাফকার প্রিয় বিষয়, অনুমান করি, ছিল দর্শন ও ধর্ম। কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি কোনো বিশেষ টান তিনি দেখাননি। ১৯১৭ সালের পরে তিনি পাস্কাল, শোপেনহাউয়ার, সাধু অগাস্তিনের Confessions, শেষ দিককার টলস্টয়ের খ্রিষ্টীয় ডায়েরিগুলো– এসব পড়েন।
এঁদের মধ্যে অস্তিত্ববাদী দার্শনিক সোরেন কির্য়েকেগার্ড কাফকার ওপর সবচেয়ে বড় প্রভাব ফেলেন বলে ধারণা করা হয়। অনেক কাফকা গবেষকে বিশ্বাস করেন, ডেনিশ এই দার্শনিকের মধ্যেই আছে কাফকাকে বোঝার অন্যতম কার্যকর চাবিকাঠি। কাফকার উপন্যাস দুর্গ-এর প্রথম প্রকাশের এপিলোগে ম্যাক্স ব্রডও সে কথা উল্লেখ করে গেছেন। কিন্তু বাস্তবে কাফকা কির্য়েকেগার্ডকে যেভাবে বুঝেছিলেন, তাতে মনে হয় না, কির্য়েকেগার্ডের পক্ষে কাফকার লেখায় বিরাট কোনো ছাপ ফেলা সম্ভব ছিল। কাফকা ও কির্য়েকেগার্ড– এ প্রসঙ্গে আমরা শেষ দিকে আরেকটু আলোচনা করব।
কর্মজীবন
কাফকা মোট দুটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন এবং একটি বড় ব্যবসায়িক উদ্যোগে মাথা ঘামান। প্রথম চাকরিটি ছিল এক ইতালিয়ান বিমা কোম্পানি Assicurazioni Generali-তে। ১৯০৭ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯০৮-এর ১৫ জুলাই পর্যন্ত ইতালিয়ান এই কোম্পানির প্রাগের অফিসে খুব অসুখী এক সময় কাটে তাঁর। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টার দীর্ঘ কর্মঘণ্টা তাঁকে বিষর্ম করে তোলে; বেতনও কম আর সেই সঙ্গে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকা লেখালেখির জন্য সময় দেওয়া যাচ্ছে না, এ দুটো সত্যই পীড়া দিতে থাকে তাঁকে। তাঁর অনেক চিঠিতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৫ জুলাই ১৯০৮-এ চাকরি থেকে পদত্যাগ করার দুই সপ্তাহ পরে তিনি সরকারি বিমা প্রতিষ্ঠান Workers’ Accident Insurance Institute for the Kingdom of Bohemia-তে যোগ দেন।
অফিসে তাঁর দায়িত্ব ছিল মিল-কারখানার শ্রমিকেরা কাজ করতে গিয়ে আহত হলে, সেসব দুর্ঘটনার তদন্ত করা ও ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নির্ধারণ করা; তখনকার দিনে মেশিনে কাটা পড়ে হাতের আঙুল হারানো কিংবা অন্য কোনো অঙ্গের ক্ষতি হওয়া ছিল বেশ নৈমিত্তিক ঘটনা। আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম ম্যানেজমেন্ট গুরু পিটার ড্রাকারের দাবি যে ফ্রানৎস কাফকাই আজকালকার মিল-কারখানায় ব্যবহৃত মাথার শক্ত হেলমেটের মতো জিনিসটার উদ্ভাবক, যদিও এ তথ্যের সমর্থনে কাফকার অফিসের কাগজপত্র থেকে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি (অনুসন্ধিৎসু পাঠক সাম্প্রতিক প্রকাশিত, বিখ্যাত কাফকা স্কলার স্ট্যানলি কর্নগোল্ড ও অন্যদের সম্পাদিত Franz Kafka – The Office Writings বইটি ঘেঁটে দেখতে পারেন)।
কাফকার বাবা তাঁর ছেলের এই চাকরিকে Brotberuf বা ‘রুটির চাকরি’ বলে খোঁটা দিতেন; অসংখ্য লেখায় কাফকা নিজেও অফিস-জীবনের অনেক কিছু নিয়ে তাঁর মনঃকষ্টের কথা বলে গেছেন — এর মধ্যে অন্যতম বেশ কিছু ডায়েরি এন্ট্রিতে অফিসের তোষামোদি সংস্কৃতি, বস্-তোষণ ইত্যাদি নিয়ে তাঁর কিছু কমিক্যাল লেখা। কিন্তু এই একই মানুষ অফিসে কাজের বেলায় ছিলেন খুঁতখুঁতে, যত্নশীল, সৃজনশীল এবং নিবেদিতপ্রাণ। এরই ফলস্বরূপ দ্রুত অনেকগুলো পদোন্নতি হয় তাঁর; এবং নভেম্বর ১৯১৫ নাগাদ তাঁর বেতন গিয়ে দাঁড়ায় বছরে ৫ হাজার ৭৯৬ ক্রাউন, যার মূল্য, তখনকার দিনে, এখনকার হিসাবে মোটামুটি মাসে প্রায় সোয়া ৬ লাখ বাংলাদেশি টাকার মতো। কাফকার সময়ে তাঁরই পরিদর্শন করা অফিসগুলোয় শ্রমিকদের গড় বেতন ছিল বছরে ৯০০ থেকে ১০০০ ক্রাউন।
দৈনিক মাত্র ছয় ঘণ্টা অফিসে চাকরি করে মাসে ৬ লাখ টাকার উপরে আয় করা কাফকার চাকরিকে কোনোভাবেই বাজে, নিম্নপদের কোনো চাকরি বলা যাবে না। ১৯১৮-র জানুয়ারিতে কাফকার বাবা ৫ লাখ ক্রাউন দিয়ে একটা অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন, যার মূল্য তখনকার দিনে আজকের প্রায় ৫ মিলিয়ন পাউন্ডের সঙ্গে তুলনীয়। জেমস্ হয়েস্-এর Excavating Kafka (২০০৮) এবং পিটার-আন্দ্রে অল্ট এর সাড়া-জাগানো জার্মান কাফকা-জীবনী Der ewige sohn (The Eternal Son; ইংরেজি অনুবাদ এখনো বের হয়নি)-এর এই তথ্য কাফকার নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থা এবং তাঁর চাকরির ভয়ংকরত্ব বিষয়ে গড়ে ওঠা মিথের ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে। পদোন্নতি পেয়ে একসময় কাফকার কাজ হয় ক্ষতিপূরণ দাবির যথার্থতা নির্ণয় করা, রিপোর্ট লেখা, ব্যবসায়ীদের আবেদন নিষ্পত্তি করা ইত্যাদি। এই বিশাল প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদন (Annual Report:) তৈরি করার মতো বড় কাজটিও কাফকা করেছেন অনেক বছর। তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরির ও সম্পাদনার কাজে তাঁর দক্ষতার বিশেষ প্রশংসা করতেন।
দুপুর দুটোয় শেষ হয়ে যেত কাফকার অফিসের কাজ, অতএব সাহিত্যের জন্য দেওয়ার মতো সময় তাঁর মিলত যথেষ্ট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যখন প্রাগের যুবকদের সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগ দিতে হচ্ছে, তখন অফিসের ঊর্ধ্বতনেরা কাফকাকে এ প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘জরুরি প্রয়োজন’ ঘোষণা করার কারণেই তাঁর আর যুদ্ধে যাওয়া লাগেনি। শুধু সেবারই নয়, পরে তিনি অসুস্থ হলে যেভাবে বারবার তাঁর অফিস তাঁর জন্য দীর্ঘ সব ছুটি মঞ্জুর করেছে এবং শেষে অতি অল্প বয়সে শারীরিক অসুস্থতার কারণে পূর্ণ পেনশন নিয়েই কাফকাকে যেভাবে চাকরিতে ইস্তফা দিতে দেওয়া হয়েছে — এর সবই দানবীয় এক অফিসে আমলাতান্ত্রিক অন্ধকারে হাতড়াতে থাকা ফ্রানৎস কাফকা মিথের বিপরীতে আমাদের নতুন করে তাঁকে নিয়ে ভাবতে উৎসাহ জোগায়।
১৯১১ সালে কাফকার বোন এলির স্বামী কার্ল হারমান ও ফ্রানৎস কাফকা মিলে প্রাগের প্রথম অ্যাজবেস্টস্ কারখানা খোলায় মনস্থির করেন। মেয়ের বিয়েতে কাফকার বাবার দেওয়া যৌতুকের টাকাই ছিল এ ব্যবসার মূল পুঁজি। প্রথমদিকে এই ব্যবসার প্রতি কাফকা খুবই আগ্রহ দেখান, পরে তাঁর লেখালেখিতে ব্যাঘাত ঘটছে বলে তিনি এর ওপর বিরাগভাজন হয়ে ওঠেন।
জীবনের এরকম এক সময়েই তাঁর পরিচয় ঘটে এক ইদ্দিশ নাট্যদলের সঙ্গে। প্রাগে নাটক মঞ্চায়ন করতে আসা ইদ্দিশ অভিনেতাদের দলটির নেতা ইজাক লাউভির (দুই রকম বানানে Isaak Lowy এবং Jitskhok Levi) সঙ্গে কাফকার গাঢ় বন্ধুত্ব হয়। ১৯১১-এর অক্টোবরে এদের একটি নাটক দেখে কাফকা পরের টানা ছয় মাস ইদ্দিশ ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে ডুবে যান। এই আগ্রহ থেকেই পরে ডানা মেলে কাফকার ইহুদিধর্মের (Judaism) প্রতি আগ্রহের। এর কাছাকাছি সময়েই কাফকা মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে বাকি জীবনের জন্য শাকাহারী (Vegetarian) হয়ে যান। ১৯১৫ সালে তাঁর যুদ্ধে যাওয়ার ডাক আসে, কিন্তু আগেই যেমন বলা হয়েছে, সরকারি কাজে তাঁর প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে অফিস তাঁকে যুদ্ধে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেয়।
পরে অবশ্য, ১৯১৭ সালে, তিনি নিজেই কিছুটা যুদ্ধক্ষেত্রের প্রতি রোমান্টিসিজম ও কিছুটা রহস্যময় এক কারণে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ দেখান, কিন্তু তত দিনে যক্ষ্মার কারণে ডাক্তারি দৃষ্টিকোণ থেকেই সেনাবাহিনী তাঁকে নিতে অপারগতা জানিয়ে বসে। ১৯১৮ সালে, মাত্র ৩৫ বছর বয়সে, তাঁর অফিস শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁর পেনশন মঞ্জুর করে। এর পরের ছয়টি বছর মোটামুটি নানা স্যানাটোরিয়ামে (হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যনিবাস) ঘুরে ঘুরেই জীবন কাটে তাঁর।
বোনের স্বামীর সঙ্গে অ্যাজবেস্টস্ ফ্যাক্টরি চালু করার আকুতি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে (তারিখ: ৫ নভেম্বর, ১৯১৫) হাবসবুর্গ সাম্রাজ্যের সম্রাট ফ্রানৎস জোসেফের চালু করা অস্ট্রিয়ান যুদ্ধ-বন্ডে বিনিয়োগ করে ১৫ বছর ট্যাক্স-ফ্রি বার্ষিক ৫.৫% সুদ হারে লাভ পাওয়ার জন্য বড় অঙ্কের টাকা খাটানো এবং নিবেদিতপ্রাণ হয়ে অফিসে কাজ করে তাঁর বারবার পদোন্নতি পাওয়ার ও মোটা বেতনের কর্মকর্তা হওয়ার ঘটনাগুলো আমাদের তাঁর অপার্থিব, সাধু-সন্ত রূপের উল্টোদিকে তাঁকে এক প্রখর বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন, বৈষয়িক ও পার্থিব মানুষ হিসেবে দেখতে প্রণোদনা জোগায়।
কাফকার বাবা– হারমান কাফকা
বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে খুব কম লেখকের বাবাই ফ্রানৎস কাফকার বাবা হারমান কাফকার মতো বিনা অপরাধে এভাবে নিন্দিত ও গবেষকদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। যেকোনো কাফকা-গবেষণায়ই হারমান কাফকা এক অন্যতম বড় চরিত্র এবং তাঁর চেহারাটি সেখানে সব সময়ই নিষ্ঠুর, অনুভূতিশূন্য এক পিতার, যিনি তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তানকে আজীবন আতঙ্কের মধ্যে রেখেছিলেন, বাস্তবিক অর্থেই তাকে পোকার চেয়ে বেশি সম্মান দেখাননি, যার ফলে সন্তানটি বেড়ে উঠেছিল আত্মবিশ্বাসহীন এক ব্যর্থ মানুষ হিসেবে।
কাফকা-গবেষক স্ট্যানলি কর্নগোল্ডের ভাষায় হারমান কাফকা ছিলেন ‘বিশালদেহী, স্বার্থপর ও স্বেচ্ছাচারী এক ব্যবসায়ী’; আর ছেলে ফ্রানৎস কাফকার মতে, তিনি ছিলেন, ‘শক্তি, স্বাস্থ্য, ক্ষুধা, উঁচু গলা, বাকপটুতা, নিজের প্রতি মুগ্ধতা, পার্থিব কর্তৃত্ব, সহ্যক্ষমতা, উপস্থিত বুদ্ধি এবং মানুষের স্বভাব সম্বন্ধে জ্ঞানের দিক থেকে একজন সত্যিকারের কাফকা’ (‘যেমনটা আমি কখনোই হতে পারিনি,’ কাফকা লিখেছেন)।
বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটি কাফকা তাঁর আত্মবিশ্লেষণের সবচেয়ে দামি ও বড় দলিল তাঁর বিখ্যাত বাবাকে লেখা চিঠিতে ((Letter to His Father) লিখে রেখে গেছেন। ১৯১৯ সালের নভেম্বরে লেখা প্রায় ১০০ পাতার এই চিঠি ফ্রানৎস কাফকার আত্মজীবনীমূলক প্রধান রচনা, যার উল্লেখ যেকোনো প্রামাণ্য কাফকা-গবেষণা বইয়ে থাকবেই। তিনি চেয়েছিলেন, বাবাকে এই চিঠি পাঠিয়ে বাবার সঙ্গে সম্পর্কের একটি দফারফা করবেন। কিন্তু তাঁর প্রিয় ছোট বোন ওট্লা এবং তাঁর মা তাঁকে চিঠিটি পাঠাতে নিষেধ করেন। কাফকা এটিকে ব্যক্তিগত এক দলিল হিসেবেই রেখে দেন, পরে ১৯২০ সালে তাঁর প্রেয়সী মিলেনা য়েসেন্স্কাকে তিনি চিঠিটি পড়তে দেন মিলেনার দিক থেকে তাঁকে বোঝার সুবিধা করে দিতে।
এ চিঠিতেই আমরা দেখতে পাই বাবা হারমান কীভাবে ছেলেকে ‘টেবিলের চারপাশে তাড়িয়ে বেড়াতেন’, কীভাবে তাঁকে হুমকি দিতেন (‘আমি তোমাকে মাছের মতো ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলব’), কীভাবে খুব ছোটবেলায় এক রাতে ছেলে কাঁদতে থাকলে বাবা তাঁকে বিছানা থেকে তুলে বাড়ির বাইরে পেছনের বারান্দায় ফেলে রেখেছিলেন, যার ফলে ছেলের মনে হয়েছিল বাবার তুলনায় সে অতি তুচ্ছ কিছু। কাফকার ভাষ্যমতে, তাঁর বাবা দোকানের কর্মচারীদের ওপর জুলুম করতেন, খুব খোঁটা দিয়ে কথা বলতেন তাঁর সন্তানদের সঙ্গে এবং একবার এসব জুলুমে ত্যক্ত হয়ে দোকানের সবাই চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার মনস্থির করলে ছেলেকেই সবাইকে এক-এক করে বুঝিয়ে ঠান্ডা করতে হয়েছিল। বাবাকে কাফকার ‘দৈত্য’ বলে মনে হতো।
বাবার সঙ্গে সাঁতারের পুলে গেলে, বাবার বিশাল বপুর সামনে তাঁর নিজেকে মনে হতো, ‘একটা ছোট কঙ্কাল, অনিশ্চিত, ডাইভিং বোর্ডের ওপরে খালি পায়ে ঘোরাঘুরি করছি, পানি ভয় পাচ্ছি; সাঁতারের সময় তুমি যেভাবে হাত-পা চালাও তা আমার পক্ষে করা সম্ভব না।’ খাবার টেবিলে বাবা হারমান গপগপ করে গরম ধোঁয়া ওঠা খাবার গিলতেন বড় বড় গাল ভরে, মাংসের হাড় চিবাতেন কড়মড় করে, কিন্তু তাঁর সন্তানদের বলতেন যে ওভাবে খাওয়া নিষেধ। (চিঠির এ অংশ আমাদের মনে করিয়ে দেয় কাফকার গল্পের মাংসভোজী অনেক চরিত্রের কথা, যেমন আমেরিকা উপন্যাসের ভোজনপ্রিয় গ্রিন কিংবা ‘এক অনশন-শিল্পী’ গল্পের খসড়ার সেই নরমাংসভোজী চরিত্রকে)। কাফকার ভাষায় তাঁর বাবা তাঁর পুরো জীবন দখল করে ছিলেন, ‘পৃথিবীর পুরো মানচিত্রের উপর শুয়ে ছিলেন’ তিনি, ফ্রানৎসের জন্য ‘কোনো জায়গাই রাখেননি’। বাবাকে অনুকরণ করতে ব্যর্থ হয়ে কাফকা তাঁর অক্ষমতার জন্য নিজেকেই দোষী ভাবতে শুরু করলেন; তাঁর নিজের সারাংশ: ‘তোমার জন্য, বাবা, আমি আমার আত্মবিশ্বাস হারিয়েছি, বিনিময়ে পেয়েছি এক সীমাহীন অপরাধবোধ।’
ফ্রানৎস কাফকা জীবনের শেষ দিকে যখন কপর্দকশূন্য মেয়ে ইউলি ওরিৎসেককে বিয়ে করতে চাইলেন, তাঁর বাবা তখন খেপে গেলেন। কাফকার ভাষায়, তাঁর বাবা তাঁকে বললেন: ‘মেয়েটা খুব সম্ভব তার ব্লাউজ একটুখানি উঠিয়েছে, প্রাগের ইহুদি মেয়েগুলো যেভাবে ওঠায় আর কি, আর তুমি? তুমি মজে গেলে, ঠিক করলে ঐ মুহূর্তেই তাকে বিয়ে করবে। তোমাকে আমি একবারেই বুঝি না। তুমি বড় হয়েছ, শহরে থাকছ, কিন্তু তোমার চলার পথে দেখা হওয়া প্রথম মেয়েটাকে বিয়ে করা ছাড়া অন্য কিছুর কথা ভাবতে পারছ না।
অন্য কোনো “রাস্তা” কি তোমার নেই? ওইসব জায়গায় যেতে যদি তোমার ভয় লাগে, আমি তোমাকে সাথে নিয়ে যাব।’ বাবার কাছ থেকে পাওয়া গণিকালয়ে যাওয়ার এই ইঙ্গিত কাফকার কাছে মনে হয়েছিল পৃথিবীর ‘সবচেয়ে নোংরা জিনিস’। বাবার কর্তৃত্ব থেকে মুক্তির জন্য কাফকা পথ হিসেবে দেখতেন নিজের ক্যারিয়ারকে। চিঠিতে তিনি লিখেছেন যে তাঁর বাবা-মা ছেলে কোন বিষয়ে পড়বে তা নিয়ে তাঁকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, কিন্তু এই স্বাধীনতা, কাফকার মতে, ছিল অর্থহীন। যে অপরাধবোধ তাঁর বাবা তাঁর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, এর ফলে পড়াশোনাতে কাফকা কোনো আনন্দই পেতেন না, প্রতিবছর পরীক্ষার আগে তিনি ভাবতেন যে ফেল করবেন। যদিও প্রতিবছরই তিনি পাস করে গেছেন, তবু তাঁর ভাষায়, পড়াশোনার প্রতি তাঁর ততটুকুই আগ্রহ ছিল যেরকম আগ্রহ কোনো টাকা চুরি করা ব্যাংক কমকর্তার, যেকোনো সময়ে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ের মধ্যে, থাকে তার দৈনন্দিন ব্যাংকিংয়ের কাজে।
পরে তিনি দেখলেন, বাবার হাত থেকে পালানোর আরেকটি রাস্তা হচ্ছে ‘সাহিত্য’। কাফকা এ চিঠিতে স্বীকার করেছেন, সাহিত্যের মধ্যে সত্যিই কিছুটা হলেও তাঁর সান্ত¡না মিলেছিল। কিন্তু তাতে স্বাধীনতা বা মুক্তি আসেনি, কারণ – ‘আমার সব লেখাই যে ছিল তোমাকে নিয়ে, লেখালেখির মধ্যে আমি শুধু ওসব জিনিসেরই বিলাপ করে গেছি যেগুলো তোমার বুকে মাথা রেখে করতে পারিনি।’ কর্তৃত্বপরায়ণ বাবার মূর্তি আমরা কাফকার অন্যতম বিখ্যাত দুটো গল্পের মধ্যে পাই ‘রায়’ ও ‘রূপান্তর’।
প্রথমটিতে ছেলে বিয়ে করে স্বাধীন হতে চাইলে তাঁর বুড়ো বাবা তাঁকে তাঁর বিয়ের পাত্রী নিয়ে ওভাবেই খোঁটা দেন, যেভাবে হারমান তাঁর ছেলেকে দিয়েছিলেন, যেমনটা উপরে বলা হয়েছে, সে ইউলি ওরিৎসেককে বিয়ে করতে চাইলে। গল্পের মধ্যে, পরে এই বাবা ছেলেকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। আর দ্বিতীয় গল্পটিতে ছেলে পোকা হয়ে গেলে বাবাই একসময় তার গায়ে একটা আপেল ছুড়ে মেরে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
গত ১০০ বছর ধরে ব্যক্তি কাফকাকে বোঝার যতভাবে চেষ্টা হয়েছে তার সবচেয়ে বড় চেষ্টাটাই হয়েছে তাঁর বাবাকে লেখা এই চিঠির মাধ্যমে। এই চিঠি নিয়েই লেখা হয়েছে ১ হাজার ২০০-র উপরে গবেষণা গ্রন্থ।
(ক্রমশঃ)