GALPO

গল্প

তাসের ঘর
কলমে-সিদ্ধেশ্বর হাটুই
সুখাডালী/সারেঙ্গা/বাঁকুড়া/পশ্চিমবঙ্গ

নন্দলাল বাবুর স্ত্রী রেনুকা এবং তার দুই ছেলে আকাশ ও প্রকাশ এই ছিল তার সংসার। দুই ছেলে বর্তমানে বড় হয়েছে, আকাশের বয়স পঁচিশ বছর এবং প্রকাশের বয়স কুড়ি বছর । তারা রোজগার করার জন্য দু-জনেই বাইরে চলে গেছে। আকাশ কোলকাতায় একটি কারখানায় কাজ করে, আর প্রকাশ তার গ্রামের কয়েকজন বন্ধুর সাথে গুজরাটে চলে গেছে কাজ করতে, সেও কারখানায় কাজ করে। নন্দলাল বাবুর দুই ছেলেই মাঝে মধ্যে বাবার মোবাইলে ফোন করে, বছরে দু-একবার করে বাড়ি আসে। এদিকে নন্দলাল বাবুও সাইকেলে করে পাশের বাজারে গিয়ে মাছ কিনে এনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন। তাতে যা রোজগার হয় মোটামুটি সংসার চলে যায়। নন্দলাল বাবুর স্ত্রী সকালে সংসারের কাজকর্ম সেরে হাট-বাজারও করেন। গ্রামের দোকান থেকে তেল-মশলা এবং সবজি কিনে এনে রান্না করেন, নন্দলাল বাবু যখন ব্যাবসা সেরে বাড়ি ফেরেন তখন দুপুর হয়ে যায়। এসে স্নান সেরে খাবার খান। এভাবেই চলছিল নন্দলাল বাবুর সংসার।

সেদিন রাত্রে যখন নন্দলাল বাবু আর তার স্ত্রী খাবার খেতে বসেছেন তখন তার স্ত্রী নন্দলাল বাবুকে বললেন-“দেখো তুমি তো ছেলেদের কিছু বলছো না, ওরা রোজগার করছে কিন্তু আমাদের কোন টাকা –পয়সা দিচ্ছে না। চলবে কিভাবে ? তুমি তো চুপ করে ওরা যা বলে তাই শোনো, ওরা তোমাকে সেই যে বলে দিয়েছে আমরা টাকা গুলো জমা করে রাখি, বাড়ি বানাবো। হয়ে গেলো…তুমিও ওদের বলে দিয়েছো তাই করবি, তার জন্য ওরা সংসারে কোন টাকা দেয় না, আর দেবেও না । যে যার একাউন্টে রাখছে। তুমি তো বেশি রোজগারও করতে পারো না যে অন্য কিছু করা যাবে, এ দু-বেলা খাও আর থাকো, আমার আর এ সংসারে একটুকুও ভালো লাগছে না।” সমস্ত কথা শুনে নন্দলাল বাবু বললেন-‘দেখো ওরা তো টাকাগুলো রাখছে, ওরা তো আর জলে ফেলে দেয়নি, দেবে প্রয়োজন হলে নিশ্চয়।‘

কিছুদিন পর নন্দলাল বাবুর ছোট ছেলের ফোন এল, নন্দলাল বাবু তখন দুপুরের খাবার খাবেন বলে বসেছেন। নন্দলাল বাবু ফোনটা ধরে চুপ করে বসে রইলেন , এদিকে প্রকাশ দুটি কথা বলেই ফোন কেটে দিয়েছে, শুধু বলেছে-“বাবা আমি এখানের একটি মেয়েকে গতকাল বিয়ে করেছি, আর ওর বাবা আমাকে এখানেই থাকতে বলেছেন, আমি আর গ্রামে ফিরে যাবো না।“
এই কথা শুনে নন্দলাল বাবু ভীষণ কষ্ট পেলেন। খাবারটা না খেয়ে উঠেই স্ত্রীকে সমস্ত ব্যাপারটা বললেন। তখন তার স্ত্রী নন্দলাল বাবুকেই দোষারোপ করলেন। নন্দলাল বাবু না খেয়ে শুয়ে পড়লেন। সন্ধ্যের সময় যখন বিছানা ছেড়ে উঠলেন তখন তার স্ত্রী তাকে বললেন-“দেখো যা হবার তা তো হয়েই গেছে, দুই ছেলেকেই বাড়ি আসতে বলো, ওদের বোঝাও।“ স্ত্রীর কথা শুনে নন্দলাল বাবু দুই ছেলেকেই ফোন করে বাড়ি ফিরে আসতে বললেন।
তারপর দশ দিন কেটে গেছে কোন ছেলেই আর নন্দলাল বাবুকে ফোন করে না, আর বাড়িও ফেরে না। নন্দলাল বাবু ফোন করলেও ছেলেরা ফোন ধরে না। কয়েকদিন পরে নন্দলাল বাবু তার বড় ছেলে আকাশের এক গ্রামের বন্ধুর কাছে খবর পান যে, আকাশ আজ থেকে দুমাস পূর্বেই বিয়ে করেছে। এবং সেও কোলকাতায় থাকবে গ্রামে আর ফিরবে না। নন্দলাল বাবু আরো জোর আঘাত পেলেন, তার স্ত্রীকে ভয়ে ভয়ে বড় ছেলে আকাশের বিয়ে হওয়ার কথাটা শোনালেন। তার স্ত্রী নন্দলাল বাবুর কথা শুনে হাসলেন, আর বললেন-“দেখো তোমার-ই তো ছেলে, কী অবস্থা একটিকেও তো মানুষের মতো মানুষ করতে পারলে না। যা হয়েছে ঠিক হয়েছে।“ নন্দলাল বাবু কিছু না বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তারপর রেগে গিয়ে বললেন-“আমার কাউকে প্রয়োজন নেই, ওদের সাথে আমার আর কোন সম্পর্ক নেই……শেষ…শেষ…সমস্ত সম্পর্ক শেষ।“ এই বলে বাইরের দিকে বেরিয়ে গেলেন।

পরের দিন নন্দলাল বাবু ব্যবসায় গেলেন না,…. মন খারাপ। কোন ছেলে আর ফোনও করে না। এভাবে কিছুদিন পেরিয়ে যায়। একদিন সকালে হঠাৎ নন্দলাল বাবু ঘুম থেকে উঠে এদিক -ওদিক তার স্ত্রী কে খুঁজে বেড়ান, কিন্তু কোথাও যখন দেখতে পেলেন না তখন পাড়ার দিকে যান, পাড়াতে গিয়ে দেখেন পাড়ার লোকজন জটলা করে কী যেন আলোচনা করছিলেন, তাদের কাছে গিয়ে নন্দলাল বাবু জানতে চান কী ব্যাপার, তখন সকলে তাকে বলেন -তাদের গ্রামের ভোলা, যে সবজি দোকান করত তার সঙ্গে তোমার স্ত্রী রেনুকা আজ ভোরে পালিয়ে গিয়ে আবার বিয়ে করেছে। একথা শুনে নন্দলাল বাবুর মাথায় যেন বাজ পড়ল, কাউকে কিছু না বলে আস্তে আস্তে নন্দলাল বাবু বাড়ি চলে এলেন।

তারপর নন্দলাল বাবুকে গ্রামের কিছু লোক শান্তনা দিলেন বটে, কিন্তু কোন কাজ হয় না। নন্দলাল বাবু পাগলের মতো হয়ে গেলেন। কোন কাজকর্ম, খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করতেন না। ছেলেরা ও আর ফোন করে না, আবার নন্দলাল বাবু ফোন করলেও ধরে না। কারোর সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই। জীবনটা যেন লজ্জা, দুঃখ দিয়ে দিনের পর দিন যন্ত্রণায় ডুবিয়ে রাখছে। কোন রকমে নিজেকে সামলে নন্দলাল বাবু তার কয়েকদিন পর আবার সেই পুরানো ব্যাবসায় হাত লাগালেন। এভাবেই সে একলা ঘরে দিন যাপন করতে লাগলেন।

এভাবে একটা বছর কেটে গেছে স্ত্রী, এবং ছেলেদের সঙ্গে তার কোন যোগাযোগ নেই। নিজেই রান্না-বান্না করে খায় আর থাকেন। এভাবেই দিন গুলো নন্দলাল বাবুর চলে যাচ্ছিল। এমন সময় নন্দলাল বাবুর গ্রামের সম্পর্কের এক কাকা নন্দলাল বাবুকে একটি যুক্তি দিলেন-বললেন-“তার জানা চেনা একজন বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলা আছে তাকে বিয়ে করতে।“ একথা শুনে নন্দলাল বাবু প্রথমে না করলেও পরে ভেবে চিন্তা করে হ্যাঁ করলেন। এবং কয়েকদিন পর তাকে বিয়ে করলেন।

নন্দলাল বাবুর নতুন সংসারে মন দিলেন , নতুন স্ত্রী তাকে খাবার করে দেন। তিন বেলা সঠিক সময়ে খাবার নন্দলাল বাবু মুখের সামনে পাচ্ছিলেন, এটাই বা কম কিসের। কিন্তু এভাবে কয়েক মাস চলার পর নন্দলাল বাবুর ব্যাবসা আর ভালো চলছিল না। তখন তার নতুন স্ত্রী তাকে পরামর্শ দেন বাইরের রাজ্যে গিয়ে কিছু কাজ করে উপার্জন করর। সেইমতো নন্দলাল বাবুও তার গ্রামের এক বন্ধু যে অনেক আগের থেকে বাইরে কাজ করতো তার সঙ্গে যোগাযোগ করে বাইরে কাজ করতে চলে গেলেন। নতুন স্ত্রী কে যাবার আগে একটা ফোন কিনে দিয়ে গিয়েছিলেন, দিনে দুবার ফোন করে কথাও বলতেন।

নন্দলাল বাবু বাইরে যাবার চার মাস পর যখন ভাবলেন এবার- বেশ কয়েক দিনের জন্য ছুটি নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরবেন.। আর মাত্র তিন দিন পর তার পাওনা ছুটি মিলবে । নন্দলাল বাবু ছুটিতে বাড়ি ফিরবেন ঠিক তার একদিন পূর্বে এদিকে গ্রামের বাড়িতে রেখে আসা নতুন স্ত্রী একজন গামের যুবক কে বিয়ে করে তার সঙ্গে পালিয়ে গেছেন। যদিও সেকথা নন্দলাল বাবু জানতেন না। এদিকে নন্দলাল বাবু যেদিন বাড়ি আসবেন বলে ট্রেনের টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে নতুন স্ত্রীকে ফোন করছেন বার বার, কিন্তু কেউ ফোন ধরছে না । নন্দলাল বাবু ভাবলেন হয়তো ফোনটা খারাপ হয়ে গেছে। কোন রকমে নন্দলাল বাবু গ্রামে ফিরলেন। ফিরে এসে গ্রামের মানুষের কাছে শুনলেন তার নতুন স্ত্রীও পালিয়েছেন। যেন লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারছিলেন না নন্দলাল বাবু গ্রামের লোকর কাছে।

তার দু-দিন পর নন্দলাল বাবু বাজার থেকে একটি ধানে দেওয়া বিষ গোপনে কিনে এনে বাড়িতে দরজা বন্ধ করে পুরো বিষটা পান করে নিলেন, এবং ছটফট করতে করতে মারা গেলেন। পরের দিন দরজা ভেঙে যখন পাড়ার লোক নন্দলাল বাবুর বাড়িতে প্রবেশ করলেন দেখলেন-নন্দলাল বাবু মরে পড়ে আছেন। গ্রামের মানুষ পুলিশকে খবর দেন, পুলিশ এসে নন্দলাল বাবুর মরদেহ নিয়ে যানএবং পোষ্ট মোর্টেম করিয়ে আনেন। পরের দিন পুলিশ নিজেদের উদ্যোগেই নন্দলাল বাবুর মরদেহ তার গ্রামের পুকুর পাড়ের শ্মশানে দাহ করেন।

SIDDHESWAR HATUI

Leave a Reply