GM MUSA

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন নারী শিক্ষার পথিকৃৎ
-জিএম মুছা

১৮৩৯ সালে একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার , সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য “হিন্দু ল কমিটি” (ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়) কে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উপাধিতে ভূষিত করেন, যা ১৯৪১ সালে ২২ এপ্রিল সংস্কৃত কলেজের দেয়া প্রশংসাপত্রের উল্লেখ করা হয়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উনবিংশ শতকের একজন বাঙালি শিক্ষাবিদ সমাজ সংস্কারক, লেখক -সংস্কৃতি পণ্ডিত হিসাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় অষ্টম স্থান অধিকার করেন।
বিশিষ্ট বাঙালি এই শিক্ষাবিদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ সালের ২৬ শে সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামের পিতা ঠাকুরদাসের ঔরসে মাতা ভগবতী দেবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন ,তার পারিবারিক পদবী বন্দোপাধ্যায় বিধায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় , যদিও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বাক্ষর করতেন ‘ঈশ্বর শর্মা নামে’।
তিনি একজন বাঙালি শিক্ষাবিদ ও মহান সমাজ সংস্কারক হিসেবে তৎকালীন ঘুনে ধরা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজকে সংস্কার কুসংস্কার মুক্ত করার জন্য অনেক জনহিত কর মূলক কাজ করে গেছেন ,তেমনি ভাবে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজকে তিনি অত্যন্ত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পেরেছিলেন, রক্ষণশীল সমাজ মনে করতেন নারী/ স্ত্রীকে শিক্ষা দেয়া নিষিদ্ধ ও সমাজবিরোধী কাজ।
তখন তিনি তার নিজের চিন্তা চেতনা ও বোধ থেকে অনুধাবন করেছিলেন নারী শিক্ষার বিস্তার লাভ ছাড়া সমাজ উন্নয়ন করা কোনমতেই সম্ভব নয়, যে কারণে সমাজের সমাজ পতিদের তীব্র প্রতিবাদ ও বিরোধিতার মুখে, নারী শিক্ষাকে ত্বরান্বিত করার জোর চেষ্টা, সম্প্রসারণ অন্যদিকে নারী শিক্ষার বিশেষ সমর্থক হওয়ার কারণে, সরকার বাহাদুর, এই সকল কাজের দায়িত্ব দেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের উপর , কাজে দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথমে বালিকা বিদ্যালয় খোলার জন্য স্থানীয় সমাজ ব্যবস্থার ও সমাজের মানুষের সমর্থনে বর্ধমানে একটি স্কুল স্থাপন করেন, ১৮৫৭সালের নভেম্বর থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাসের মধ্যে বিদ্যাসাগর আরো নতুন ৩৫টি বিদ্যালয় স্থাপন করতে সক্ষম হন । এক পর্যায়ে শিক্ষা কর্তৃপক্ষের পরিচালকের সঙ্গে তার মতদ্বন্দ্বের কারণে তিনি এই সকল কাজ বেশিদুরে এগিয়ে নিতে পারেননি, তাই তিনি সেই সময়ের একমাত্র উচ্চপদস্থ বাঙালি কর্মকর্তা হাওয়া সত্বেও নির্দ্বিধায় সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদ ও স্কুল পরিদর্শকের পদে ইস্তফা দেন।
তবুও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেমে থাকেননি, এরপর তিনি বিশেষ করে মেয়েদের/নারী শিক্ষা সম্প্রসারণের কাজে সর্বতোভাবে সরককে যথেষ্ট সহযোগিতা করেন, তিনি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েও পদ পদবীর লোভ না করে ওই সময় বিদ্যাসাগর ‘বেথুন সোসাইটির’ সঙ্গে যুক্ত হন। কারণ ‘বেথুন সোসাইটির’ কাজেই ছিল নারী/স্ত্রী শিক্ষা বিস্তার পারিবারিক ও সমাজে নারীদের সম্মান মর্যাদা বৃদ্ধি করা, তাই তিনি ধনী ও জমিদারদের শিক্ষা বিস্তার করার লক্ষ্যে স্কুল স্থাপনের জন্য উৎসাহিত করেন। এছাড়াও সংস্কৃত কলেজের সংস্কার ও আধুনিকরণ , এবং বাংলা ও বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন ও শিক্ষা ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো পাঠ্যপুস্তক এবং তা প্রকাশ করা।
এক্ষেত্রে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি শিক্ষা ব্যবস্থা এবং নারী শিক্ষা বিস্তারে ও সম্প্রসারণের জন্য তিনি বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ, ১৮৫১ সালে প্রকাশের পূর্বে, প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এরকম কোন আদর্শ পাঠ্যপুস্তক ছিল না। তার রচিত বর্ণ পরিচয় প্রথম ভাগের মান এতই উন্নত ছিল তা প্রকাশের পর প্রায় অর্ধশতাব্দীর অধিককাল ধরে গ্রন্থটি বঙ্গদেশের প্রাথমিক পর্যায়ে সকল কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য একটি আদর্শ সুখ-পঠ্য পুস্তক ছিল। যাহার মুদ্রণ দুই শত বছর পরও লক্ষ্য করা যায়।
শুধু তাই নয় আমরা যদি ভারতীয় নারী শিক্ষার কথা বলি সে ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই ভারতের শিক্ষার দেবী একজন নারী হলেও প্রাক ঔপেনিবেশিক বহু পূর্বে ভারতে মেয়েদের লেখাপড়া করার কোন অধিকার ছিল না, প্রাচীন ভারতে একসময় নারী শিক্ষার প্রচলন থাকলেও সমাজ একসময় ধীরে ধীরে পুরুষতান্ত্রিক হয়ে উঠতে আরম্ভ করে, তখন থেকে নারীকে নিষ্ক্রিয় করে অন্ত:পুরে ঠেলে দেয়ার প্রবণতা প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যায়, ওই সময় থেকে নারী ধীরে ধীরে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হতে থাকে ,শেষ পর্যন্ত নারী অশিক্ষিত হয়ে পড়লে পুরুষতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজটি সহজতর হয়ে ওঠে, যার ফলে নারী সমাজের নানা কুসংস্কারের অন্ধবিশ্বাসে শিকারে পরিণত হয়। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে বিশেষ করে নারীদের মধ্যে কৌলিন্যপ্রথা, বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথা দেখা দেয়, সামন্ত প্রথা প্রচলিত সমাজের নারীদের শিক্ষার অভাবে সমাজের মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে দীর্ঘদিন টিকে ছিল, তাই বিদ্যাসাগর সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কারের বিষয় অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে অনুধাবন করতে পেরে, নারী শিক্ষার সম্প্রসারকে সমাজ সংস্কারের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নারীকে সু -শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার মধ্য দিয়ে নারী সমাজের মধ্যে সকল কুসংস্কাকে নির্মূল করার উদ্দেশ্য দৃঢ় ব্রত নিয়ে নারী শিক্ষার সম্প্রসারের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন,এছাড়াও তিনি নারী সমাজের দীর্ঘ বঞ্চনা লাঞ্ছনা অবহেলা দুঃখ দুর্দশা নারীকে শিক্ষিত করে তোলার মাধ্যমে দূর করতে চেয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগর নিজেই একজন মানবতাবাদী মানুষ ছিলেন তাই তার সেই দর্শন তাকে নিপীড়িতদের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও সহমর্মিতা, সহানুভূতি সমদর্শী দৃষ্টি ভঙ্গি তাকে নারী শিক্ষা সংস্কারের প্রতি উৎসাহী করে তুলেছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বিদ্যাসাগর বুঝত পেরেছিলেন, গ্রামের মেয়েরা গ্রামীণ সমাজের বেশি সামাজিক শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়, সে কারণে তিনি নারী শিক্ষা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি তার নারী শিক্ষা আন্দোলনটি একেবারে বাস্তবের মাটি থেকে শুরু করেছিলেন যার ফলে হতে পেরেছিলেন সফল ও সার্থক।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে উডের ডেসপ্যাচে, স্ত্রী শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিলে
বিদ্যাসাগর খুব খুশি হন, তারপরের বছর ১৮৫৫ সালে বিদ্যাসাগর স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হয়ে নারী শিক্ষার জোয়ার আনেন, এবং বর্ধমান, হাওড়া, হুগলী ,বীরভূম, ২৪ পরগনা ও মেদিনীপুরে অত্যন্ত অঞ্চলের প্রায় ৩৫টি বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং সকল বালিকা বিদ্যালয় গুলিতে মোট ১,৩০০ জন্য, ব্যক্তিগতভাবে ৩,৪০০ টাকা খরচ করেন, তার এই ব্যক্তি কর্ম প্রচেষ্টায় আমাদের উপলব্ধির দ্বার খুলে যায়, শুধুমাত্র তার এই কর্ম প্রয়াসের মধ্যেই আমরা উপলব্ধি করতে পারি, বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার প্রসারে কতটা আন্তরিক ছিলেন, পরবর্তীতে সরকারের কাছে বারবার তদবির করায়, ওই সকল বিদ্যালয় গুলিতে সরকার কিছু আর্থিক ব্যবভার গ্রহণ করতে রাজি হন, বিদ্যাসাগরের সর্বশেষ কর্মপ্রায়াস ছিল গ্রাম অঞ্চলে নারীদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের জন্য, বাংলার বিভিন্ন জেলায় ‘নারী শিক্ষা বিধায়নী সম্মিলনী প্রতিষ্ঠা’ করেন, এমনকি তিনি নিজের গ্রামে মা ভগবতী দেবী স্মৃতি উদ্দেশ্যে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তোলেন” ভগবতী বিদ্যালয়”
নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণে বিদ্যাসাগর তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় আর দৃঢ় ইচ্ছা শক্তি দিয়ে বাংলা নারী শিক্ষা বাংলার সর্বস্তরে তা বিস্তৃত করেছিলেন, বিদ্যাসাগর ২০০ বছর আগে নারী জাগরণ ও নারী শিক্ষার জন্য যে চিন্তা ভাবনা করেছিলেন আমরা আজ তার জন্মের ২০০২ বছর পরে এসে নারী শিক্ষা, নারী জাগরণ, নারীর ক্ষমতায়ন উপলব্ধি করতে পারছি, এটাই ছিল একবিংশ শতাব্দীর জন্ম নেয়া চন্দ্র বিদ্যাসাগর সেই মহীরুহের উপলব্ধি ও সুদূর প্রসারী চিন্তা চেতনার ফসল।।

(সমাপ্ত)

যোগাযোগ:
রওশন আলী স্মৃতি ভবন,৩য় তলা, ০৮ নম্বর কক্ষ,৩ মুজিব সড়ক, যশোর-৭৪০০। কোতয়ালী মডেল থানা,সদর- যশোর-৭৪০০।
মোবাইল: ০১৭১১০৪৭১৪০
Gmail: gmabumusa89@gmail.com

Leave a Reply