গল্পঃ হ্যালুসিনেশন
জালাল উদ্দিন লস্কর
অনেকক্ষণ ধরেই সিএনজিটা নিয়ে বসে আছে রমজান আলী।যাত্রীর দেখা নেই।এখন ভরদুপুর। এই সময়টাতে যাত্রী এমনিতেই কম থাকে।আর এটা কোনো সিএনজি স্ট্যান্ডও নয় যে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য যখন-তখন যাত্রীরা এসে হুড়মুড়িয়ে সিএনজিতে উঠে বসবে।
শিমুলতলি গ্রাম ভেদ করে চলে গেছে এলজিইডির একটি পাকা সড়ক।এখানে শিমুলতলীর কিংবা শিমুলতলীতে আসা লোকজন সিএনজিতে চড়ে আসেন।বিশ্বরোড থেকে আসা সিএনজিগুলো শিমুলতলীতে আসা লোকজনকে উঠায় না।মাঝখানে গাড়ী বদলে আসতে হয় এখানকার লোকজনদের।
উদ্বিগ্ন রমজান আলী ভাবছে, আজ তবে কার মুখ দেখে বাড়ী থেকে বের হলাম।এতো সময়ে একজন যাত্রীর দেখাও পেলাম না।
ভাড়ার সিএনজি।রোজগার হউক না হউক মালিককে পাইপাই করে তার পাওনা ভাড়ার টাকা বুঝিয়ে দিতে হয়।
দিনকাল ভালো যাচ্ছে না।দেশে এখন নতুন আতংক করোনা।সরকার লকডাউন দিয়েছে।মানুষজন নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া বাড়ীর বাইরে কোথাও যেতে চায় না।কিন্তু রমজান আলী এবং তার মতো নিম্ন আয়ের মানুষদের এতো নিয়ম মানলে চলে না।পেটের ফিকির তাদের করতেই হয় যে।
ঘরে স্ত্রী ছেলেমেয়ে আছে।আছে বৃদ্ধা অসুস্থ মা। তাই রাস্তাঘাটে পুলিশ কিংবা প্রশাসনের লোকজন আটকাতে পারে,জেল-জরিমানা করতে পারে জেনেও রমজান আলীর মতো খেটে খাওয়া মানুষদের তাই রাস্তায় নামতে হয়।সেদিন খেপ নিয়ে একটু দূরের গন্তব্যে যাওয়ার সময় অল্পের জন্য হাইওয়ে পুলিশের হাতে আটক হওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিল।ধরা পড়লেই মোটা অংকের টাকা জরিমানা দিতে হতো।
হাইওয়ে পুলিশের ভ্যানটি রমজান আলীর সিএনজিকে ধাওয়া দিয়েছিল।ধাওয়া খেয়ে একটা চিপা রাস্তায় দ্রুতই ঢুকে পড়েছিল রমজান সিএনজি নিয়ে।
এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ রমজান আলী দেখতে পায় গ্রামের ভেতরের দিকের রাস্তা ধরে জনা চারেক লোক সড়কের দিকেই আসছে।হয়তো মোকামবাড়ী বাজারেই যাবে তারা।রমজান আলীর চোখেমুখে খুশী ঝিলিক দিয়ে যায়।যাক কোপাটা তাহলে কাটলো!
যেমনটা ধারণা করেছিল রমজান এই লোকগুলো মোকামবাড়ী বাজারেই যাবে।ওরা সাকুল্যে চারজন।আরো একজন যাত্রী হলে ফুল ট্রিপটা হয়।
লোকগুলো সিএনজিতে উঠেই তাড়া দিতে লাগলো।
-দেখি আর কেউরে পাই কি না।
রমজান আলীর গলায় কেমন যেন আড়ষ্ট ভাব।
লোকগুলোর ক্রমাগত তাড়া খেয়ে রমজান আলী আর কোনো যাত্রী পাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে সিএনজি স্টার্ট দেওয়ায় মনোনিবেশ করলো।
কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছে না সিএনজি।অনেকভাবে চেষ্টা করেও বিগড়ে যাওয়া সিএনজি স্টার্ট নেওয়াতে না পেরে রমজানের নিজেরই মেজাজ গেলো বিগড়ে।
অসহিষ্ণু যাত্রীরাও সুযোগ বুঝে নিজেদের বিরক্তি লুকালো না।রমজানকে দুই-চার কথা শুনিয়ে দিলো।
-গাড়ী পাল্টাও মিয়া।কি গাড়ী লইছ।ধ্বজভঙ্গ মার্কা গাড়ী।
ধ্বজভঙ্গ শব্দটা শুনে সাথে থাকা অল্পবয়সী মহিলাটা ফিক করে হেসে ফেলে।
তবে কি মহিলাটি ধ্বজভঙ্গ শব্দটার সাথে পরিচিত?বিগড়ে যাওয়া মেজাজ নিয়ে এদিকটা নিয়েও খানিকটা ভেবে নেয় রমজান আলী।আড়চোখে একবার মহিলাকে দেখে নিতেও ভুল করে না রমজান।
যাই হউক কিছুক্ষণ বাদে একটা খালি গাড়ী আসলে রমজানই তাদের সেই গাড়ীতে উঠিয়ে দেয়।মনেমনে নিজের দূর্ভাগ্যকে দোষারোপ করতে করতে রমজান ভাবে, আজ এমনিতেই রোজগার নাই।তারপর বিগড়ে যাওয়া সিএনজিটাকে গ্যারেজে নিয়ে ঠিকঠাক করাতে আবার কত টাকা পকেট থেকে খসে যাবে কে জানে! সে যেমন করোনা আর লকডাউনের ছলনায় যাত্রীদের কাছ থেকে সুযোগে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে ছাড়ে না গ্যারেজ মালিকও তো তার সাথে এমন করতে পারে।তদুপরি বিকল সিএনজিটাকে তিন মাইল দূরের গ্যারেজে নেওয়াও অনেক ঝক্কির।
সিএনজির পেছনের সীটে গিয়ে গা এলিয়ে দিলো রমজান।তার দুচোখ বুঁজে আসছে।না কি চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে! আজ মালিকের টাকা কিভাবে ম্যানেজ করবে সে।
নিত্য রোজগারের টাকায় চলা সংসারের জন্যই সে আজ কি করতে পারবে।এইসব চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে যায় রমজান তা নিজেই টের পায় না।
রমজান ঘুমের মধ্যে নিজেকে আবিস্কার করে একটা হাসপাতালের বেডে।মাথায় ব্যান্ডেজ।হাতে স্যালাইন লাগানো।পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার স্ত্রী সখিনা।সখিনা বিরবির করে স্বামীর উদ্দেশ্যে কি যেন বলতে চাইছে।রমজান স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সখিনার কন্ঠ।
-এত কইরা তোমারে কইলাম আইজ গাড়ীত যাওয়ার দরকার নাই।যেভাবে আল্লায় চালায় চালাইয়া নিমু।তুমি যাও একবার আমার অসুখ্যা মায়েরে একবার সলিমগঞ্জে গিয়া দেইখ্যা আহ।তুমি আমার কথা শুনলায় না।আমার মায়ে তোমারে নিজের ছাউয়ালের মত আদর করে।বেড়ানিতে গেলে নিজের পাত থাইকা তোমারে তুইলা খাওয়ায় অহনো।
রমজান সব শুনছে।জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেও পারছে না।
ডাক্তাররা বলাবলি করছে মাথার আঘাতটা গুরুতর।আরেকটু হলে মারা যেতে পারতো। একজন তো বলেই ফেললোঃ
-সাবধানে গাড়ী চালাইতে পারে না।ড্রাইভারের সিটে বইসা নিজেরে নবাবজাদা মনে করে।নেশাটেশাও করে হয়তো!
রমজানের চোখে ভেসে উঠে তার সিএনজি থেকে নেমে যাওয়া সেই মহিলাটির ছবি যে একটু আগেই ফিক করে হেসে দিয়েছিল ধ্বজভঙ্গ শব্দটা শুনে। এই শব্দটা রমজান আগে অনেকবার হাটবাজারে ক্যানভাসারের মুখে শুনেছে।
মজমা সাজিয়ে রসিয়ে রসিয়ে কথা বলে অশিক্ষিত অল্পশিক্ষিত লোকজনদের হিপনোটাইজ করে যৌন রোগের ওষুধ বিক্রেতা ক্যানভাসারেরা অনিবার্যভাবেই এই শব্দটা বলতো।সমবেত লোকজন মন্ত্রমুগ্ধের মতো ক্যানভাসারের লেকচার শুনতো আর নিজেদের সাথে মিলিয়ে নিতো।ফাঁকেফাঁকে চলতো একতারা কিংবা ম্যান্ডোলিন বাজিয়ে চটুল গান।গান গাইতো ক্যানভাসারের সাথে থাকা কমবয়সী একটি ছেলে।কখনোকখনো কমবয়সী মেয়েকেও এমন মজমায় গান গাইতে দেখেছে রমজান।সেদিন অবশ্য মজমা লোকে লোকারণ্য হয়ে যেতো মেয়ে কন্ঠের গান শোনার জন্য।কিছুটা মেয়ে গায়িকাটাকে একনজর দেখার জন্যও বটে!অনেক সময় গান শেষ হলে মজমা ফাঁকা হয়ে যেতো।
কিছু মানুষ তখনো লাজুক লাজুক মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতো।স্ত্রীর কাছে নিজেকে হিরো প্রমানের চেষ্টায় এবং খানিকটা অতৃপ্তির জেরে কেউকেউ ক্যানভাসারের কানে কানে কি সব বলার পর ক্যানভাসারের কাছ থেকে কি একটা পুটুলী আর ছোট্ট শিশি ভর্তি মালিশের তেল নিয়ে বাড়ী ফিরতো । এখন আর এমন ক্যানভাসারদের দেখা মেলে না।
–রমজান ভাই,ও রমজান ভাই!
ডাকাডাকি শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে রমজান।দেখে তার সিএনজির পাশে আরেকটা সিএনজি দাঁড়ানো।০০৩১ সিরিয়ালের এই গাড়িটাতো চালায় ইউনুস।তা হলে ইউনুসই তাকে ডাকছে।ততক্ষণে দৃশ্যপটে হাজির হয় ইউনুস।
-তুমি মিয়া নবাবজাদার মতো এইখানে ঘুমাইতাছ।আর ওই দিকে সামেদ মিয়া সিএনজি একসিডেন কইরা হাসপাতালে মরবার লাগছে।
-কি কইবার লাগছ ইউনুস।একটু আগে না সামেদ যাত্রী ভর্তি কইরা সিএনজি লইয়া গেল খালি।
-হ! মোকামবাড়ী বাজারের কাছাকাছি যাওয়ার পর উল্টা দিক থাইকা আসা একটা টেরাক বেরেক ফেইল কইরা সামেদের সিএনজিরে ধাক্কা মারার পর রাস্তার কিনারের ২০ হাত গহীন গাতায় পইড়া গেছিল সিএনজিডা। ২ জন জাগাত মারা গেছে।একটা কমবয়সী মহিলাও মরছে।গাড়ী থাইকা টাইনা বাইর করনের পর দেখি মহিলাডার ঠোঁটত একটা মিষ্টি হাসি লাইগা আছে।
রমজান দ্রুত তার বাড়ীর দিকে হাঁটা দেয়।আজই তার অসুস্থ শাশুরীকে দেখতে যাওয়া দরকার।
জালাল উদ্দিন লস্কর
শিক্ষক ও সাংবাদিক
মাধবপুর, হবিগঞ্জ