আনোয়ার সাহেবের অদ্ভুত ট্রেনযাত্রা
জালাল উদ্দিন লস্কর
কমলাপুর রেল স্টেশনের ওয়েটিং রুমে অলস ভঙ্গিমায় বসে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলেন কামরুল সাহেব।পুরো নাম কামরুল আনোয়ার চৌধুরী।রাত ১০ টার সিলেটগামী উপবন এক্সপ্রেসে বাড়ী যাবেন বলে তার এই অপেক্ষা।বরাবরই তিনি রাত ১০ টার এই ট্রেনেই বাড়ী যান।ঢাকায় আছেন সাত বছর।সরকারী চাকুরী করেন।পদপদবী তেমন না।কম্পিউটার অপারেটর।
প্রতিমাসেই বাড়ী যান।এই সাত বছরে রাতের ট্রেনে বাড়ী যাওয়ার এই নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম হয় নি আনোয়ার সাহেবের।একবার শাশুরীর মৃত্যুর খবর পেয়ে তড়িঘড়ি করে বাসে গিয়েছিলেন।সে কি বিড়ম্বনাময় এক যাত্রা।যানজটে পথে বাসের মধ্যেই কেটে গিয়েছিল দুই ঘন্টা।মনে হলে এখনও বিরক্তিতে গা ঘিনঘিনিয়ে উঠে।ট্রেন জার্নিকে তাই নিরাপদ মনে করেন।আজকাল ট্রেনেও তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না।তারপরও রাতের ট্রেনে ভ্রমণ করা কামরুল সাহেবের কাছে নেশার মতোন।
এক ধরনের মাদকতা অনুভব করেন।কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভ্রমনটা তার কখনোই উপভোগ করা হয় না।ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়া কামরুল আনোয়ার সাহেবের অনেক পুরনো অভ্যাস।গমগম করা যাত্রীদের ভীড়, হকারদের হাঁকডাক কোনোকিছুতেই তার ঘুমের ব্যাঘাত হয় না।ছোটবেলায় মরহুম পিতা মনোয়ার হোসেনের সাথে অনেকবার ট্রেনে চট্টগ্রামে গিয়েছেন।সেখানে তার এক ফুফু থাকতেন।
তার ফুফা সালাউদ্দিন আহমদ রেলওয়েতে চাকরী করতেন।সেই সুবাদে মনোয়ার সাহেব বিনা টিকেটেই রেল ভ্রমণের সুযোগ পেতেন।সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে বছরে কয়েকবার চট্টগ্রাম যাওয়া মিস করতেন না।আনোয়ার সাহেবের ফুফু মারা গেছেন অনেক দিন।বোনের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মনোয়ার সাহেব শেষবারের মতো চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন।সংগে ছিল ছোট্ট আনোয়ার।ফুফুর মৃত্যুর পর মাস না পার হতেই আনোয়ার সাহেবের ফুফা বাসার কাজকর্মে সহায়তার জন্য রাখা কিশোরী গৃহকর্মী হালিমাকে বিয়ে করেন।
এরপর মনোয়ার সাহেব সালাহউদ্দিনের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।সালাহউদ্দিনও আর যোগাযোগ রাখার দরকার মনে করেন নি।আনোয়ার সাহেবের ফুফুর কোনো সন্তান হয়নি বিয়ের পরের দশ বছরেও।
সালাউদ্দিন মুখে কিছু না বললেও মনে মনে অসন্তুষ্টই ছিলেন স্ত্রী নাসিমা বেগমের প্রতি।তখনও ট্রেন ভ্রমনে আশপাশ প্রতিবেশ সবকিছু ভুলে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়তো আনোয়ার। আজ এই বয়সেও তার ছোটবেলার সেই অভ্যাসের কোনো পরিবর্তন হয় নি।
১০ টা বাজতে খুব একটা বাকি নেই আর।
কামরুল সাহেব ৭ নম্বর প্লাটফরমের দিকে ত্রস্তপায়ে ছুটছেন।স্টেশনের লাউড স্পিকারে সুকন্ঠি ঘোষিকার ঘোষণা। সম্মানীত যাত্রী সাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করে বলছি সিলেটগামী উপবন এক্সপ্রেস কিছুক্ষণের মধ্যেই সিলেটের উদ্দেশ্যে কমলাপুর ছেড়ে যাবে।বাংলাদেশ রেলওয়েতে আপনাদের ভ্রমণ নিরাপদ ও আনন্দদায়ক হউক।
সুন্দর বাচনভঙ্গির ঘোষিকার চেহারাটা কল্পনা করেন কামরুল সাহেব।মনে মনে ধরে নেন এই সুকন্ঠি মহিলা নিশ্চয়ই সুন্দরী হবেন। কখন যে নিজের অজান্তেই আরেকজনের পিঠে ধাক্কা লেগে যায় টেরই পান নি কামরুল আনোয়ার।ভোঁ করে হুইশেল বাজছে।লম্বা সময় নিয়ে।ট্রেন ছেড়ে দেবে এখনই।পড়িমড়ি করে কামরুল সাহেব নির্ধারিত কামরায় উঠলেন।
ট্রেন ধীর ধীরে চলতে শুরু করলো।বিমানবন্দর স্টেশন পার হওয়ার পর ট্রেনের গতি বাড়লো।পথে কোনো বড় সমস্যা না হলে কামরুল সাহেবের ছয় ঘন্টা লাগে গন্তব্যে পৌঁছাতে।শায়েস্তাগঞ্জ জংশনে নামতে হয় তাকে।মাঝে মাঝে পথে বিপত্তি বাঁধলে সাত আট ঘন্টায় পৌঁছার অভিজ্ঞতাও আছে তার।
কিছুক্ষণের মধ্যে কামরুল সাহেবের ঘুম পেতে শুরু করল।আস্তে আস্তে তিনি ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলেন।একহাতে ছোট্ট ট্রাভেল ব্যাগটাকে জড়িয়ে রেখে রীতিমতো নাক ডাকাতে শুরু করলেন।ঈদ মৌসুম ছাড়াও এখন ট্রেনে নিয়মিতই প্রচন্ড ভীড় থাকে।অনেকেই ষ্ট্যান্ডিং টিকেট কিনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন।প্রচন্ড গরম।মাথার উপর পাখা ঘুরছে।কামরুল সাহেব ঘুমাচ্ছেন।কখনো পাশের যাত্রীর উপর গিয়ে পড়ছেন।ঘুমের মধ্যেই আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসছেন।
অদ্ভুত ঘুম।কামরুল সাহেব এমনিতেও ঘুমকাতুরে।অফিসেও সুযোগ পেলেই বসে বসে ঘুমিয়ে নেন।ভাবেন এত কাজ করে কি হবে!মাস শেষে বেতন তো ঠিকই থাকছে।তাছাড়া কাজেকর্মে খুব বেশী উৎসাহ পান না।অফিসের অন্য অনেকেরই বাড়তি আয় রোজগার আছে।তার সে সুযোগ নেই।মনে মনে হিংসার আগুনে পুড়েন।সীমিত পয়সায় চলা মুশকিল।নিজের থাকা খাওয়া পকেট খরচ।বাড়ীতে নিয়মিত টাকা দেওয়া।কুলায় না।
কতবার বসকে (প্রেস ম্যানেজার)অনুরোধ করেছে সেকশন পরিবর্তন করার জন্য।কাজ হয় নি।এমন নিয়ম নেই সরকারী চাকুরীতে।তারপরও বসকে খুশী করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।খুশী হতে বসেরও আপত্তি নেই।কিভাবে বসকে খুশী করবেন বুঝতে পারছিলেন না।একদিন সেকশন অফিসারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন।সেকশন অফিসার ইংগিতে যে কথা বলেছিলেন শুনে কামরুল সাহেবের আক্কেল গুড়ুম।গ্রামের বাড়ীতে তার যে জমিজমা আছে সব বিক্রী করে দিলেও এক লাখ টাকা হাতে আসবে না।
দুই লাখ টাকা সে বসকে কিভাবে দেবে!অবশেষে যেভাবেই হউক পঞ্চাশ হাজার টাকা ম্যানেজ করে বস কে দেন।কিছুতেই সম্ভব হবে না জেনেও বস টাকাটা নেন।বছরের পর বছর যায় আনোয়ার সাহেবের আর প্রমোশন হয় না।টাকাও ফেরত চাইতে পারেন না।একদিন ইংগিতে বলেছিলেন স্যার না হয় আমার টাকাটা ফিরিয়ে দেন।পরদিন স্যার আনোয়ার সাহেবকে ডেকে বলে দিলেন তার বিরুদ্ধে না কি এন্তার অভিযোগ।
তাকে কারন দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হচ্ছে দুএকদিনের মধ্যেই।সন্তোষজনক জবাব দিতে না পারলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন আনোয়ার সাহেব।অফিস পলিটিক্স সম্পর্কে ভালোই ধারণা রাখেন আনোয়ার সাহেব।তাই একদম চুপসে গিয়েছিলেন।তার দিকে তাকিয়ে সেকশনের অন্য লোকজন হাসাহাসি করতো।
এটা যে তার বসের টাকা ফেরত না দেওয়ার ফন্দি বুঝতে আর বাকি রইলো না তার।এভাবেই কিছুদিন কেটে গেলো।কারন দর্শানোর চিঠি আর আসলো না তার কাছে।বসও মাঝেমাঝে ডেকে নিয়ে একটুআধটু প্রশংসা করতে লাগলেন আবার।আনোয়ার সাহেব বস কে টাকা দেওয়ার কথা জীবনের জন্য ভুলে যেতে চাইলেন।ভুলে গেলেনও।
ঘুমের ঘোরে কামরুল সাহেব এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। মনোরম এক উদ্যানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি।চারিদিক ফুলে ফুলে ভরা।নানা রকমের ফলের গাছ।ফলভারে নুইয়ে আছে।কেমন মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে।কামরুল সাহেব উদ্যানে হেঁটে বেড়াচ্ছেন।হঠাৎ দূর থেকে একটা ছায়া মূর্তী তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলেন।
ভয় পেয়ে ঘামতে শুরু করলেন কামরুল সাহেব।জনমানবশুন্য এই উদ্যানে তার দিকে ছায়ামূর্তিটিকে এগিয়ে আসতে দেখে কামরুল সাহেব পিছু হটতে চাইলেন।কোনো ঝোঁপের আড়ালে আত্মগোপন করতে চাইলেন।তার পা চলছিল না।নিজের শরীরটাকে পর্বতপ্রমান ভারী মনে লাগলো আনোয়ার সাহেবের কাছে।ক্রমেই ছায়ামূর্তিটি কাছাকাছি হতে শুরু করলো।স্মিত হেসে একটা সময়ে একদম আনোয়ার সাহেবের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।
–ভয় পেয়েছিলে আনোয়ার?
-আরে,এ যে দেখছি শিলার গলার আওয়াজ,চেহারাটাও ঠিক শিলারই মতো!
আনোয়ার সাহেব ধন্ধে পড়ে গেলেন।এখানে শিলা আসবে কিভাবে?শিলা তো সেই কবেই মরে ভুত হয়ে গেছে।একসাথে কলেজে পড়তো। একসাথে থাকতে থাকতে একটা গভীর সম্পর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছিল আনোয়ার সাহেব ও শিলার।
একে অপরকে ভালোবাসতো।প্রাণের চেয়ে বেশীই ভালবাসতো।
–হ্যাঁ,আমি শিলা।তুমি ঠিকই ধরেছ।আত্মহত্যা করে যারা মরে তাদের আত্মা মরার পরে ভুত হয়ে যায়।আমিও ভুত হয়ে গেছি।ভুতেরা জীবিত মানুষদের মনের কথা বুঝতে পারে।
–তুমি এখানে কি করছ?সাহসে ভর করে জিজ্ঞাসা করলেন আনোয়ার সাহেব।তুমি না আরো ১০ বছর আগেই মরে গেছ।
—আমার মরার সময় হয় নি তখন।নিজে নিজেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলাম।নিতে বাধ্য হয়েছিলাম।তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা কেউ মেনে নিতে চায় নি।না বন্ধু বান্ধব।না পরিবার।বাবা মা তো নয়ই।বেশী ইমোশনাল ছিলাম।তোমাকে পাগলের মতো ভালবাসতাম।ভালোবাসার মানুষকে যখন পাব না তখন আর দুনিয়াতে থেকে কী হবে।তাই সবাইকে মুক্তি দিলাম।এখানে ভালো আছি।
এই বাগানে ঘুরে বেড়াই।আমাকে এই বাগানেই থাকতে দেওয়া হয়েছে।ফলমূল খাই।খুব খেতেও হয় না।ক্ষিধাও পায় না তেমন।কোনো কাজ নেই।করো সাথে দেখাও হয় না।আজ তুমি এসেছ বলে দেখা হয়ে গেলো।তুমি কি করে এখানে এসেছ আনোয়ার?
এখানে যে একবার আসে সে আর পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারে না।
শেষের কথাটা শুনে আনোয়ার সাহেব ভয় পেয়ে গেলেন।তাহলে তিনি আর ফিরে যেতে পারবেন না এখান থেকে?তিনি না বাড়ী যাবেন বলে কমলাপুর থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন! এখানে কেমন করে এসে পড়লেন তাহলে!!ধরধর করে ঘামতে লাগলেন তিনি।তার গলা শুকিয়ে আসছে।অনেক কষ্টে শিলার উদ্দেশ্যে বললেন,-তাহলে তো ভালোই হয়।
তুমি আর আমি ছাড়া এখানে কেউ নাই।দুনিয়ায় যে স্বপ্ন পূরন হয় নি এখানে তা পরিপূর্নতা পাবে।মন্দ কি?
শিলা আনোয়ারকে বললোঃ -এ তোমার মনের কথা নয়।আমাকে খুশী করতে মিথ্যে বলছ তুমি।
আমরা যখন প্রেম করতাম তখনও আমাকে খুশী করতে অবলীলায় কতো মিথ্যাই না তুমি বলতে!
তোমার মনে আছে পালিয়ে দূরে কোথাও গিয়ে সংসার পাতার কথা বলেছিলাম তোমাকে।তুমি রাজীও হয়ছিলে।কখন কিভাবে বাড়ী থেকে কোথায় এসে তোমার সাথে দেখা করবো কোথায় যাবো সেসব ঠিক হলো।নির্দিষ্ট সময়ে আমি বাবা মা ভাইবোন সমাজ সবকিছু ভুলে আমি নির্দিষ্ট জায়গায় আসলাম।তুমি আসলে না।
অনেক অপেক্ষা করলাম।চারিদিকে জানাজানি হয়ে গেরো মিজান মৃধার মেয়ে ও পাড়ার আনোয়ারের সাথে পালিয়ে গেছে।বাবা মার মুখ ছোট হলো।এদিকে তোমার আসার খবর নেই।বুঝতে পারলাম তুমি ভয় পেয়ে গেছ।তুমি আর আসছ না।
অবশেষে সেই পোড়ামুখ নিয়ে বাড়ী ফিরে গেলাম।আমাকে একনজর দেখতে আস্ত পাড়া ভেঙ্গে পড়লো আমাদের বাড়ীতে।কতোজন কত কি বলাবলি করতে লাগলো।মনে হয়েছিল আমি চিড়িয়াখানার কোনো প্রাণী।একসময় সবাই যে যার বাড়ীতে গেলো।কিন্তু মানুষের মুখ বন্ধ হলো না।বাবাকে দেখতাম সবসময় মন খারাপ করে থাকেন।মাকেও।বাইরে থেকে আসার পর বাবা অনেক সময় নির্বাক হয়ে বসে থাকতেন।মুখে কিছু বলতেন না।বাড়ীর স্বজন পরিজনেরা গঞ্জনা দিতে লাগলো।
সুযোগ পেলেই মা কে দু’চার কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়তো না।আমাকে কেন্দ্র করে এই অশান্তি আমাকেও অশান্ত করে তুললো।ভাবলাম এ জীবন ছন্দ হারিয়েছে।কি হবে এ জীবন রেখে! অবশেষে একদিন নিজেই নিজের জীবন শেষ করে দিলাম।সেই থেকে এখানেই আছি।
-আমার বাবা মা কেমন আছে আনোয়ার? সুমনা,সালেহীন এরা কেমন আছে?
–তোমার মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই চাচা হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান।শোক সইতে না পেরে চাচীও কয়েকদিনের ব্যবধানে মারা গেলেন।
সুমনা সালেহীনের খবর জানি না।আমি ঢাকায় থাকি।মাসে একবার বাড়ীতে আসি।দুইদিনের বেশী থাকা হয় না।সংসারের কাজকর্ম স্ত্রী সন্তানের নিয়ে ব্যস্ততায় দুইদিন সময় চোখের পলকেই চলে যায়।আবার কখনো এখানে আসা হলে সুমনা সালেহীনের খবর নিয়ে আসবো।তোমাকে জানাব তাদের কথা।
-আনোয়ার তুমি আসলে বুঝতে পারছ না,এখানে পৃথিবীর কোনো মানুষ একবারের বেশী আসতে পারে না। বাবা মা ও তাহলে মারা গিয়েছেন! এখানে একদিনও তাদের দেখা পেলাম না।হয়তো মৃত্যুর স্ট্যাটাসের ভিন্নতার কারনেই।
-আমি এখন আসি শিলা।আমকে বাড়ী যেতে হবে।দুইদিন পরই ঢাকায় ফেরার কথা।
নাম না জানা একটা ফুল গাছ থেকে একটা অতি মনোহর ফুল ছিঁড়ে আনলো শিলা।আনোয়ারকে দেওয়ার ভঙ্গি করলো।আনোয়ার হাত বাড়াতেই আবার একটু পিছু হটে গেলো শিলা। কয়েকবার এমন করলো শিলা।কলেজ জীবনে শিলার সাথে এমন অনেক রোমাঞ্চের স্মৃতি মনে পড়তে লাগলো আনোয়ার সাহেবের।অবশেষে ফুলটা আনোয়ারের হাতে দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো শিলা।এই বিশাল উদ্যানে নিজেকে খুব একা মনে হতে লাগলো আনোয়ার সাহেবের।যতদূর দৃষ্টি যায় দেখতে চেষ্টা করলেন।শিলাকে আর দেখা গেলো না।হাতে থাকা ফুলটা নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিতে চাইলেন।পারলেন না।হাতটা যেন বিশাল এক শিলাখন্ডের মতো ভারী বোধ হলো।
কয়েকবার চেষ্টা করলেন।পারলেন না।হঠাৎ এক ধমক শুনতে পেলেন,-ওই মিয়া গাড়ীতে এতো ঘুমায় মানুষ? কয়বার আমার উপরে পড়ছেন?
সোজা হইয়া বসেন।
সাথে গাড়ীর এক প্রচন্ড ঝাঁকুনি।গাড়ী ব্রেক করেছে।কামরুল সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো।দেখলেন মানুষজন ঠেলাঠেলি করে গাড়ী থেকে নামতে দরজার দিকে যাচ্ছে।জানালা দিয়ে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন এটা আখাউড়া জংশন।
এখানে বেশ সময় গাড়ী থামে।ইঞ্জিন ঘুরাতে হয়।
আর বড়জোড় একঘন্টার জার্নি শেষে আনোয়ার সাহেব শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছে যাবেন।তার পর ভোরের আলো ফুটলে ফাড়ি রাস্তায় আধাঘন্টার পথ পেরোলেই আনোয়ার সাহেবের গ্রাম।
চা-ওয়ালাকে ডেকে এককাপ চা পান করলেন আনোয়ার সাহেব। আর ঘুমানো যাবে না।একবার ঘুমের মধ্যে সিলেট চলে গিয়েছিলেন আনোয়ার সাহেব।বিনা টিকেটে ভ্রমনের জন্য জরিমানা গুনতে হয়েছিল সেবার।সাথের মালপত্রও খোয়া গিয়েছিল।অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন নি এই ভেবেই তৃপ্তি পেয়েছিলেন তখন।পরে উল্টো আশি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ী আসতে হয়েছিল তাকে।ভাগ্যিস টাকা পয়সা খোয়া যায় নি।ট্রাভেল ব্যাগটা নিয়েই সন্তুষ্ট হয়েছিল চোর!লাভ আরো হয়েছিল।দুইদিন ছুটির একদিন শেষ হয়ে গিয়েছিল পথে পথেই।
ট্রেন শায়েস্তাগঞ্জ পৌঁছাল।এখানে আরো দুই আড়াই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে।রাত না পোহালে করিমপুর যাওয়ার সিএনজি পাওয়া যাবে না।ষ্টেশনে বসে বসেই সময়টা পার করতে হবে।বিরক্তিকর।ঘুম জড়ানো চোখে কংক্রিটের বেঞ্চিতে বসে এতো সময় কাটানো আসলেই কষ্টকর।উপায় নেই। অদূরবর্তি মসজিদ থেকে ফজরের আজানের সুমিষ্ট সুর ভেসে আসছে।আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।
আনোয়ার সাহেব ভাবতে লাগলেন আসলেই তো ঘুমের চেয়ে নামায উত্তম। সারা জীবনতো বলতে গেলে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিলেন।নিজের কাছেই নিজেকে ফালতু মনে হলো।আস্তে আস্তে আঁধার কেটে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।কোনো সিএনজি নজরে পড়ছে না। আনোয়ার সাহেবের আর তর সইছে না।আজকে যেন বাড়ীর কথা একটু বেশীই মনে পড়ছে। মনে পড়ছে ছেলে মেয়েদের কথা।বউয়ের কথাও মনে হচ্ছে খুব।সচরাচর অন্য সময় বউয়ের কথা তেমন মনে হয় না তার।আজ তবে এমন হচ্ছে কেন?আনোয়ার সাহেব হিসাব মিলাতে পারছেন না।
বাড়ীতে আনোয়ার সাহেবের বৃদ্ধা মা,স্ত্রী মুনিয়া আর ছোট দুই সন্তান।পুত্র আহাদ।আর কন্যা অনামিকা।এমনিতে বউয়ের কথা তেমন করে কখনোই ভাবেন না কামরুল সাহেব। বিয়ে করতে হয় তাই করেছেন।সংসারী হয়েছেন।কিন্তু মনের মধ্যে বারোমাস জুড়েই আছে শিলা।দুই সন্তানের বাবা হয়েছেন।শিলাকে ভুলতে পারেন নি এক মুহুর্তের জন্যও।
মুনিয়ার পাশে শুয়েও শিলাকেই ভেবে এসেছেন সবসময়।কেন সেদিন শিলাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন নি সেটা আরেক কাহিনী।এটা এখানে উহ্যই থাক।সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই সিএনজিওয়ালাদের হাঁকডাক কানে আসলো।উঠে এগিয়ে গেলেন। একটা সিএনজি রিজার্ভ করে ফেললেন।এতো সকালে করিমপুরের আর কোনো যাত্রী নাই।কামরুল সাহেবের মনও আনচান করছে বাড়ীর জন্য।
সিএনজি ছুটে চলেছে।আবার কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গেলেন কামরুল সাহেব।চাকরীতে আরেকটু উন্নতি হলেই বউ বাচ্চা ও বৃদ্ধা মা কে ঢাকায় নিয়ে যাবেন।ফ্যমিলি বাসার ভাড়া,অন্যান্য খরচ।এখন যা পান তাতে কুলাবে না।দূর থেকে চিরচেনা করিমপুর গ্রামটাকে দেখা যাচ্ছে। ছবির মতো একটা গ্রাম।আবহমান বাংরার চিরন্তন রূপ।মসজিদের মাইক থেকে শোা সংবাদের ঘোষণা আসছে।স্পষ্ট বুঝতে পারছেন না আনোয়ার সাহেব।
সাতসকালে শোক সংবাদ শোনা তার কাছে সবসময়ই অপছন্দের বিষয়।তাই সেদিকে মন দিচ্ছেন না।করিমপুর সড়ক বাজারে সিএনজি থামলো।নেমে আসলেন আনোয়ার সাহেব।প্রতিবার ঢাকা থেকে আসার সময় করিমপুর পৌঁছে সড়কবাজারের মাসুকের চা এর দোকানে চা খাওয়া তার অনেকদিনের অভ্যাস।গ্রামের দুচারজনের সাথে দেখা হয়।কথা হয়।ফজরের নামাজ শেষে একটু হাঁটাহাটি করে অনেকেই মাসুকের দোকানে চা খেতে আসেন।
আনোয়ার সাহেব মাসুকের দোকানে ঢুকতেই দেখতে পেলেন জমাদার বাড়ীর সামাদ জমাদারকে।মুরুব্বী মানুষ।চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ।নিয়মিত নামায কালাম করেন।চেহারাতে আলাদা ঔজ্জল্য।
আসসালামুআলাইকুম চাচা।
–আনোয়ার তুমি কখন আসলে? এসে পড়েছে ভালোই হয়েছে তাহলে।বস চা খাও।
কেমন জানি খটকা লাগলো আনোয়ার সাহেবের।সামাদ চাচা এমন করে বলছেন কেন?
তবে কি কোন অঘটন? কোনো দুঃসংবাদ।
তাড়াতাড়ি চা শেষ করে বিল মিটিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আনোয়ার।সামাদ জমাদার বললেন আমিও যাবো তোমার সংগে।
আনোয়ার সাহেবের ভেতরটা খচখচ করে উঠলো।তার পা দুটো ভাড়ী হয়ে আসলো।বাড়ীর দিকে যতোই অগ্রসর হচ্ছেন ততোই অবশ হয়ে আসছে যেন তার চেতনা।অনেক মানুষের আনাগোনা তার বাড়ীতে।কি হয়েছে তবে?
অবশেষে আসল কারনটা জানতে পারলেন।আজ মাঝরাতে ঘুম থেকে জেগে চিৎকার চেচামেচি শুরু করে মুনিয়া।কে যেন তার গলা টিপে ধরছে বারবার।দম বন্ধ হয়ে আসছে তার।
বাড়ীর সবাই হাঙ্গামা শুনে ছুটে আসে।মুনিয়ার এক কথা।এক সুন্দরী মহিলা ক্ষণে ক্ষণে তার গলা টিপে ধরছে।তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
সে হয়তো আর বাঁচবে না।সবাই ভাবছে মুনিয়ার মতিভ্রম হয়েছে।তাকে সাহস দিচ্ছে কেউ কেউ।কই কিছুই তো দেখছি না।তুমি মিথ্যা কথা বলছ।কেউ কেউ বলাবলি করছে স্বামীর ভালবাসা পায় নি আজ পর্যন্ত মেয়েটি।কত আর সহ্য করা যায় স্বামীর এমন অবহেলা।
মুনিয়ার চিৎকার,হাত পা ছোড়া বেড়ে যায়।এতো রাতে ডাক্তার পাবে কোথায়।করিমপুরে কোন গ্রাম ডাক্তার নেই।ছলিমগঞ্জের জব্বার ডাক্তারকে আনা দরকার।এতোদূর থেকে এখন আনা সম্ভব নয়।সকালে আনতে হবে।একটা সময়ে নিথর হয়ে যায় মুনিয়া।নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়।সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয় মুনিয়াকে।
তবে কি ঘুমের মধ্যে স্বপ্নঘোরে উদ্যানে দেখা হওয়া সেই শিলা কামরুল আনোয়ার সাহেবকে একটা ফুল দিয়ে অদৃশ্য হয়ে মুনিয়াকে মেরে ফেলতে এখানেই ছুটে এসেছিল?
আনোয়ার সাহেব শিলার কথাই ভাবতে লাগলেন।তার ধারণা শিলা এসে মুনিয়াকে মেরে ফেলেছে।
হঠাৎ চাচাত ভাই মনোয়ারের ডাকে সন্বিত ফিরে পেলেন কামরুল আনোয়ার সাহেব।
-যা হওয়ার তো হয়েই গেছে।এখন লাশ দাফনের আয়োজন করা দরকার।
কামরুল আনোয়ার সাহেবের মগজে দীর্ঘদিন ধরেই গেঁথে আছে শিলা।
কামরুল সাহেব চিৎকার করে কেঁদে উঠলেনঃ
তুমি এমন নিঠুর হলে কেমন করে শিলা?
শিলা তুমি এমন করতে পারলে?
লোকজন একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলো।তারা কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না।
জালাল উদ্দিন লস্কর
শিক্ষক ও সাংবাদিক
মাধবপুর, হবিগঞ্জ