সীমন্তিনী
জনা বন্দ্যোপাধ্যায়
“আপনার মেয়ে তো বেশ কালো। কিন্তু যে ছবিটা আপনারা পাঠিয়েছিলেন তাতে গায়ের রঙটা ঠিক বোঝা যায়নি!”
পাত্রের মা সীমন্তিনীর মাকে সোজাসুজি কথাটা বলেন। গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও চোখ মুখের গড়ন ভালো সীমন্তিনীর। সাইকোলজি অনার্স নিয়ে এম.এ.পাশ করেছে এক বছর আগে। ইতিমধ্যেই সে একটা চেম্বারে সপ্তাহে তিনদিন বসে। বিভিন্ন কেস নিয়ে কাউন্সেলিং করে, বেশ পরিণত মনের স্বাধীনচেতা মেয়ে সীমন্তিনী। প্রতিটি কেস বিবেচনা সহ বিশ্লেষণ করে। ভালো পরামর্শ দেয়। আজকাল বিভিন্ন বয়সের মানুষের নানান কারণে ডিপ্রেশন। এইসব মানুষদের মনের সমস্যা নিয়ে কাজ করতে করতে সীমন্তিনীর সমাজদর্শনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে।
ওদিকে সীমন্তিনীর দু চারটে সম্বন্ধ এসেছে বিয়ের। সীমন্তিনীর বাবা চাকরী থেকে পাঁচ বছর হল অবসর নিয়েছেন । সীমন্তিনীর মা চান একমাত্র মেয়ের বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক। এই সম্বন্ধটা সীমন্তিনীর বাবা মায়ের দুজনেরই খুব পছন্দ। একমাত্র ছেলে,সরকারি উচ্চ চাকুরে।
“শুনুন মিসেস মুখার্জী আমারও কোন ইচ্ছে নেই আপনার পুত্রবধূ হওয়ার। আপনি বরং একদিন আমার চেম্বারে আসুন। আপনার গায়ের রঙ নিয়ে ‘অবসেশন’টা আমি কাটাতে সাহায্য করব।”
খুব সহজ ভঙ্গিতে কথাটা বলে সীমন্তিনী। তার মা মেয়ের এরকম দৃঢ় কথার মাঝে বাধা দেবার চেষ্টা করেন, “কাকে কি বলছিস? চুপ কর।”
সীমন্তিনী মায়ের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলে, “ঠিকই বলেছি মা।”
“কি সব শিক্ষা দিয়েছেন মেয়েকে নিজেই দেখুন।”
মিসেস মুখার্জী কথা না বাড়িয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, ” চল বাবু। শুধু শুধু সময় নষ্ট। ঘটককে বলতে হবে প্রকৃত ফর্সা মেয়ে ছাড়া সম্বন্ধ না আনতে। “
মায়ের পাশে সুপুরুষ সরকারী চাকুরে অংশুমান বসে এতক্ষণ নীরবে সবই শুনছিল। ছোট থেকে রামকৃষ্ণমিশনের স্কুল ও হোস্টেলে মানুষ। প্রায় উনত্রিশ বছর বয়স, মহিলা কলিগ দু চারজন অফিসে থাকলেও কোনদিনই মহিলাদের সম্পর্কে বিশেষ অভিজ্ঞতা নেই অংশুমানের। বিয়েটা মা বাবার পছন্দমতোই করবে জানিয়েছে। সীমন্তিনীকে দেখতে অংশুমান, তার মা ও একজন মামাতো দাদাও এসেছেন। ওই মামাতো দাদাও সীমন্তিনীর কথা শুনে বেশ বিরক্ত সেটা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মিসেস মুখার্জী উঠতে যাবেন এমন সময় অংশুমান সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনি ভুল বুঝবেননা। আপনার গায়ের রঙ নিয়ে কথা বলায় আমি দু:খিত। তবে আমি আপনার মতো স্পষ্টবক্তা শিক্ষিতা মেয়েকেই নিজের জন্য যোগ্য মনে করি।”
ঘর শুদ্ধু সকলে অবাক হন অংশুমানের কথায়। তবে অংশুমানের সীমন্তিনীকে ভালো লেগেছে বোঝা যায়। ভালো লেগেছে সীমন্তিনীর বুদ্ধিমত্তা, সপ্রতিভ চেহারা ও স্বাধীন মতামত। অন্য মহিলাদের থেকে স্বতন্ত্র।
মিসেস মুখার্জীর ইচ্ছে না থাকলেও ছেলের সিদ্ধান্তে আপত্তি করতে পারেননি। বিয়ের পর সীমন্তিনীর চেম্বারে পসার আরো বাড়ে। মিসেস মুখার্জী এবার আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে পুত্রবধূর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আসলে মিসেস মুখার্জীকেও কম বয়সে শ্যামলা রঙের জন্য শাশুড়ির কাছে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল, অনেক হেনস্থা সহ্য করতে হয়েছিল। বাইরে দিয়ে মানুষটা রুক্ষ হৃদয় হয়ে গেছিলেন।
সীমন্তিনী কয়েক মাসের মধ্যেই শাশুড়ির মন থেকে বহু বছরের জমে থাকা বিষাদ মুছে এক সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করে। শ্বশুর শাশুড়ির কাছে সীমন্তিনী আজ পুত্রবধূ নয়, প্রকৃত অর্থেই কন্যা।
জনা বন্দ্যোপাধ্যায়