Jayati Roy

বই আলোচনা – অমিতাভ সরকারের ‘পথ চলা’

সময়ের গল্প, আমাদের কথা
জয়তী রায়

‘পথ চলা’ একটি চার ফর্মার মুক্ত গদ্যের বই। প্রচ্ছদের ছবিটি ভারি সুন্দর। লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন সাহিত্যিক অর্ঘ্য রায় চৌধুরীকে। উৎসর্গের পাতায় একখানি সুন্দর কবিতা বইটি পড়ার প্রতি প্রথমেই একটি স্বতঃস্ফূর্ত মনোযোগ আকর্ষণ করতে আমার চিরকালীন পাঠকমনকে বাধ্য করল। বইয়ের ভূমিকাটি লেখক নিজেই লিখেছেন। ভূমিকাটিকেও একটি স্বতন্ত্র লেখা বললেও অত্যুক্তি হয় না, এতটুকুও।

বইয়ের শুরুতেই লেখক প্রথমেই আহ্বান জানিয়েছেন, ’চলো মন বেড়িয়ে আসি।’ সারা বইটি জুড়ে পথ চলারই এক অমোঘ আহ্বান প্রায় প্রতিটি রচনায় অসাধারণভাবে প্রতিফলিত করেছেন লেখক অমিতাভ সরকার। ভূমিকার শেষে কৃতজ্ঞতা স্বীকারে তিনি ‘লেখকের স্বাধীনতা’ নামক সাহিত্য সংগঠনের রুবানা ফারাহ্ আদিবা (ঊর্মি), লীনা রায় চৌধুরী,সমর পাল মহাশয়ের নাম উল্লেখ করেছেন। এখনকার বর্ণাঢ্য, দামী, মেদবহুল বিভিন্ন বিখ্যাত বইতেও এইরকম কৃতজ্ঞতা স্বীকার এর আগে খুব একটা চোখে পড়েছে বলে মনে পড়ে না। প্রকাশকের নিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, একটি লেখকের তৃতীয় গ্রন্থ।

পূর্বের কাব্যগ্রন্থ গুলি যথাক্রমে ‘অচেনা সময়ের কাব্য’ এবং ‘পথ’। প্রকাশকের নিবেদনে আলোচ্য বইটিকে একবার কাব্যগ্রন্থ এবং একবার মুক্ত গদ্যের বই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বুঝতে পারছিলাম না, এটা নিছকই ভুল না স্বতঃপ্রণোদিত। বেশ কৌতূহল নিয়ে লেখাগুলো পড়তে শুরু করলাম। সব লেখাই সময় এবং মানবমন নির্ভর, একাকীত্ব, অস্থিরতার জীবনরসে জারিত। প্রথম লেখাটি একটি দীর্ঘ গদ্য কবিতা ‘একটি রাতের কাহিনী এবং আমরা’। প্রথমেই লেখক বলছেন, ‘আমরা নিজেকে হত্যা করি প্রতিনিয়ত।/ হত্যা করে চলি নিজেদের সত্তাকে।/ আমাদের মন কুঁকুড়ে মরতে থাকে যন্ত্রণার ছুরিতে। আমরাও খুন হই নিজেদের কাছে।/অবশ্য তাতেও কি/ গল্প পাল্টায়?’ ব্যস, এখান থেকেই আমাদের সমাজের পথ চলার দৈনন্দিন গল্প শুরু করে দিলেন লেখক, এবং সেটা বেশ মুন্সিয়ানার সঙ্গেই।

পাঠক-পাঠিকারা পড়তে বসে নিজেদের জীবন ভাবনার সঙ্গে সংপৃক্ত হয়ে যাবেন আপনা হতেই। এখানেই লেখক অমিতাভ সরকারের স্বার্থকতা। অমিতাভ সম্ভাবনাময় লেখক।


‘মন মাঝি’, ‘মনের শহর’, ‘খোঁজে’, ‘জীবন মাপনী’, ‘আত্ম অন্বেষণ’, ‘বাঁশি’, ‘ছবির জন্ম’, ‘সেলফি সেলফি’ প্রভৃতি পঞ্চাশেরও অধিক রচনা এখানে ঘনসন্নিবিষ্ঠ। লেখাগুলিকে কখনো মনে হয়েছে গদ্য কবিতা, কখনো মনে হচ্ছে শুধুই কবিতা, কিন্তু তার মধ্যেই কবিতার সূক্ষ্ম অনুভূতি যেন রচনাগুলোর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে। ভাষাগুলোও সহজ সরল, কোনো একটি জায়গাও পড়তে গিয়ে দূর্বোধ্য ঠেকেনি।

’নিয়মের পর্দা ফাঁস’ রচনায় লেখক বলছেন, ‘আমি নিয়ম তৈরি করলাম। কিন্তু নিজে মানলাম না। অন্যকে মানতে বললাম। মানতে না চাইলে কথার চাপে দাবিয়ে রাখলাম, প্রভাব দিয়ে স্বার্থের প্রয়োজন মেটালাম।’ এই রচনারই শেষে লেখকের বাস্তব উপলব্ধি, ‘এখানে আসল হিসেবী চেহারাটা একবার চিনে ফেললেই মুস্কিল, তবে না চিনলে আর অসুবিধা কোথায়!’ কথাগুলো আমাদের প্রত্যেকদিনের জীবনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে জড়িত।

আরেকটি রচনা, ‘রাত্রির একাকী রোদ সংলাপ’। এখানে একেবারে শেষে বলা হয়েছে, ‘রাত্রিটা অনেক দীর্ঘ। আদৌ কি ভোর হবে?’। আবার ঠিক তার আগের লেখা ‘আত্ম-অন্বেষণ’। সেখানে অমিতাভ সরকারের উপলব্ধি, ‘কবির শহরে অ-কবিদের ভীড়। ‘ তার ঠিক পরের লাইনেই, অমিতাভ লিখছেন, ‘ঠিক আমার মতো।’ ভারি সুন্দর। কিছু বলার নেই।

অসাধারণ লাগলো ‘অসময়ের চালচিত্র’, ‘কবিতার দাম’, ‘পারাপারের নওবত’, ‘গল্পের জোৎস্নায়’, ‘সবুজ পাতার মেঠো সুরালাপ’, ‘অসুখ’, ‘সততা’, ‘ছবির দিনযাপনা’, ‘জলতরঙ্গের আয়না’ এবং সবশেষের লেখাটি ‘স্মরণের মেঘ আভাসে’। কিছু কিছু লেখা একটু ব্যক্তিগত মনে হলেও লেখাগুলো আন্তরিক, বাস্তবনিষ্ঠ, সময়কে চেনায়।

সমকালকে বুঝতে আমাদের দৈনন্দিন সমাজচিত্রকে নিবিড় ভাবে অনুভব করতে, নিজের মনকে ভাবাতে, চিন্তা করা অভ্যাস করতে এরকম অসাধারণ গদ্যকাব্য প্রত্যেক পাঠককে পড়তেই হবে। বইয়ের প্রচ্ছদ দেখেছেন প্রমিতা মন্ডল। বইটির দামও নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই। এ বই সমস্ত ধরনের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে নিবিড় আন্তরিকতার সাথে পরম সাদরে গৃহীত হবে, এই আশাই করি।

জয়তী রায়    টাকি, উত্তর ২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ

বইঃ পথ চলা
লেখকঃ অমিতাভ সরকার
প্রকাশকঃ ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি,
৯ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০৭৩, কলেজ স্ট্রিট, বইপাড়া,
প্রথম প্রকাশঃ কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলা ২০২২,
পৃষ্ঠসংখ্যাঃ ৬৪
মূল্যঃ ১০০ টাকা।

জয়তী রায়
টাকি, উত্তর ২৪ পরগণা, পশ্চিমবঙ্গ

Leave a Reply