
নাসিম-এ-আলমের চোখে দিনান্তের শেষ সূর্য
তৈমুর খান
নয়ের দশকে বীরভূমে যে কয়জন কবি একইসঙ্গে সাহিত্যে যাত্রা শুরু করেছিলাম, তাঁদের মধ্যে অন্যতম নাসিম-এ-আলম ও আমি। বীরভূমের শেষপ্রান্তে আমি বসবাস করলেও বোলপুর সংলগ্ন কীর্ণাহারে নাসিমের বাড়িতে বারবার ছুটে গেছি। দুজনেই সমবয়সী। দুজনেই একই পড়াশুনো করা ছাত্র। আবার দুজনেই এই রাঙামাটির মানুষ। চাল চলনে, কথাবার্তায় তাই কোনো তফাত ছিল না। ঘরের ছেলের মতোই তাঁর মায়ের স্নেহ-ভালবাসা পেয়েছি। শুনেছি মাতামহ আব্দুর রহমানের অনেক কাহিনিও। দেখেছি বাড়িতে বিশাল লাইব্রেরি। বহু বইয়ের সমাবেশ। কবিতা নিয়ে, বীরভূমের সাহিত্যচর্চা নিয়েও বহু কথা হয়েছে নাসিমের সঙ্গে। সদ্য লেখা কবিতাও শুনে নিয়েছি।
নাসিম ইরিগেশন দপ্তরে চাকরি পেয়ে প্রথমেই কলকাতায় অবস্থান করে। সেই সুবাদেই বহু কবি-লেখক এর সঙ্গেই তাঁর পরিচয় ঘটে। নয়ের দশকেই ‘দেশ’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা ‘গাছ-বউ’ প্রকাশিত হয়। সেই কবিতা পড়ে চমকে উঠি। গাছের মধ্যেই রমণীয় আবেগের প্রাচুর্য যেভাবে সমন্বিত এবং ইচ্ছাশক্তির জাগরণ টের পেয়েছিলাম তাতে বাংলা কবিতা এক নতুনতর ব্যঞ্জনা নিয়ে তার অভিমুখ পাল্টাতে চলেছে তা বুঝতেও পেরেছিলাম। তারপর একে একে বহু কবিতা বেরিয়েছে। প্রতিটি কবিতাই পড়ার জন্য আমরা মুখিয়ে থাকতাম। ‘আইরিশ কলোনিতে সন্ধ্যা’, ‘চাঁদ সদাগর ফিরে আসবে’, ‘আবার বেদুঈন লিখিত’,’ধুলোর নির্জনে লেখা’ প্রভৃতি কাব্যগুলিও ততদিনে হাতের কাছে এসে গেছে। আবেগঘন উচ্চারণে নাসিম মোহিত করে রেখেছে। জীবনের এত রং রস, রহস্যময় অতীতের ঘোর, ভালোবাসার মৃদু সঞ্চরণ কবিতাগুলিতে এক অনাস্বাদিত জগতের ঠিকানা পেয়ে গেছি। বিশ্বচৈতন্যের প্রত্নজাগরণ টের পেতে শুরু করেছি। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই বিগত ইতিহাস। কবিও যেন বহু যুগ আগে থেকেই এই পৃথিবীতে বিচরণ করে চলেছেন। বহু জন্মান্তরের ভেতর দিয়ে তাঁর এই যাত্রা। বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন সম্প্রদায়, বিভিন্ন জীবিকার অংশভাগী হয়ে তিনি পৃথিবীতে কাটিয়েছেন। তাই তাঁর বহু অভিজ্ঞতা, বহু উপলব্ধি, জীবন চেতনার বহু স্তরে বিচরণ করার সুযোগও ঘটেছে। এই ইতিহাস চেতনা, প্রকৃতি চেতনার নান্দনিক প্রত্যয়নামা থেকেই নাসিম শাশ্বতকালের উত্তরণে শামিল হতে পেরেছেন।
১৪২৯ এর শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর কবিতা ‘মা ও মহাপ্রলয়ের সমাধি যাপন’ যেন মৃত্যুর দেশের কবিতা। মৃত্যুশয্যায় শায়িত কবির জীবনদীপ ধীরে ধীরে নিভে আসছে। সেই রোগ-যন্ত্রণার মধ্যে থেকেই এই কবিতার প্রতিটি শব্দ উচ্চারিত হয়েছে। কবিতাটি শুরু হয়েছে এভাবেই:
“গতকাল ছিল শেষ সূর্যাস্তের দিন
মুছে গেছে সাল, মাস, অযুত সময়
প্রস্তর যুগ এসে মিশে গেছে আজকের অমোঘ সময়ে
মাটিহীন পৃথিবীতে কেবল বরফ
গাছের পাতায় মৃত্যু, বরফ আলিঙ্গন।”
শেষ সূর্যাস্ত যে দিনের নয়, জীবনের; সময় ফুরানো সময়ে কবি উপস্থিত হয়েছেন তাই স্পষ্ট বোঝা যায়। যে মাটিতে এত রূপ রস রং মিশে আছে, সেই মাটি আর জীবনের উত্তাপে ঊর্বর হয়ে ওঠেনি, তা বরফে পরিণত হয়েছে। ঠাণ্ডা হিম বরফ। গাছের পাতায় পাতায় এই মৃত্যু, এই বরফ আলিঙ্গন। হয়তো অরণ্য আছে কোথাও, কিন্তু আলো নেই। নাসিম লিখেছেন:
“আছে দীপ,শিখা নেই;চিরস্থায়ী অন্ধকার চরাচরে।
ক’জন মানুষ প্রলয়ের ঘন্টা শুনব বলে বসে আছি।”
প্রলয়ের ঘন্টা অর্থাৎ মৃত্যুর অপেক্ষা। অন্যান্য রোগের রোগীরা বেঁচে থাকার আশ্বাস পায়, কিন্তু ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীরা জীবিত অবস্থাতেই মৃত্যুর ডাক শুনতে পায়। তাই অপেক্ষা করে মৃত্যুর জন্য। মৃত্যু কেমন?
নাসিম এ কথা ভেবেছেন। তাই এই কবিতাতেই লিখেছেন: “সমাধি জীবন, বরফ সমাধি”
আবারও বলেছেন:
“দেবতারা পাঠিয়েছে অশ্রুহীন কাফন, সমাধি সংগীত”
নিজেও শুনতে পেয়েছেন:
“সবার কণ্ঠে সমাপ্তি সঙ্গীত”
হয়তো এবার শান্তি। মৃত্যুর রাজ্যে মানুষ নেই; অতএব যুদ্ধ নেই। সাফল্য ব্যর্থতা নেই। কোলাহল নেই। পৃথিবীর সমবয়সী মা যেনো কবির আত্মা। সে শান্তিতে ঘুমাতে চায়। এই শান্তি মৃত্যুই দিতে পারে। মাদার টেরেসা বলেছেন: “Death is nothing else but going home to God, the bond of love will be unbroken for all eternity.”
অর্থাৎ মৃত্যু আর কিছুই নয়, ঈশ্বরের বাড়িতে যাওয়া, প্রেমের বন্ধন চিরকালের জন্য অটুট থাকবে। সুতরাং মৃত্যুকে ভয় পাওয়া নয়, মৃত্যুযন্ত্রণাকে ভয়, যে যন্ত্রণা তিল তিল করে ক্ষয় করে । আতঙ্ক তো তখনই। বিখ্যাত লেখক ও দার্শনিক মার্ক টোয়েন বলেছেন: “আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। আমি জন্মের আগে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে মৃত ছিলাম, এবং এর থেকে সামান্য অসুবিধাও ভোগ করিনি।” একথা সকলেই আমরাও চিন্তা করতে পারি। যখন এই পৃথিবীতে আমাদের জন্ম হয়নি, তখন আমরা তো মৃত ছিলাম। এই জীবনও আবার মৃত্যুতেই বিলীন হবে। যে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম, সেই শূন্যতেই পুনর্গমন হবে। একথা সহজ ভাবে ভেবে নিলেই নাথিংনেস্ তত্ত্বটিই সত্য বলে বিবেচিত হয়। নাসিম এই পথেই নিজেকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। তাই তাঁর জীবনের সময় সময়হীন অসীম প্রান্তর। শুধু পৃথিবীতে কিছু চিহ্ন থেকে যায় তা পার্থিব চিহ্নমাত্র। ‘আবার বেদুঈন লিখিত’ কাব্যে নাসিম এক জায়গায় লিখেছেন:
“আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ রাখি মায়াবী চাদরে
কোনো কথোপকথন নয় ঘুমোক আলাদীন
পিরামিডে লেখা থাকে নেফারতিতির জন্ম-মৃত্যু
দিন, মাস, শতাব্দীর হিসেব-নিকেশ।”
প্রত্যেক মানুষের জীবনই আলাদীন। এই জীবন ঘুমিয়ে যায়। পেছনে পড়ে থাকে পিরামিড, সেখানে জন্ম-মৃত্যুর সাল-তারিখের হিসেব। প্রতিদিন সূর্য ওঠে, প্রতিদিন সূর্য অস্ত যায়। আর এই পিরামিড জেগে থাকে। নাসিমও অনন্তের পথে যাত্রা শুরু করেন। এক সময় আমরাও ‘নাসিম’ হয়ে যাই।