
পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং তাঁর বন্ধু প্রীতি
নিখিলরঞ্জন গুহ,
২১ বছর বয়সে তিনি ফোর্ট ঊইলিয়াম কলেজে সংস্কৃত বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হলেন । সেখানে পাঁচ বছর শিক্ষকতা করার পর তিনি সংস্কৃত কলেজে্ সহ সম্পাদকের পদ অলঙ্কৃত করেন । মতানৈক্যর কারণে সেখান থেকে পদত্যাগ করে তিনি পুনরায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ফিরে যান । তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে ব্রিটিশ সরকার সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন সংঘাতের উল্লেখ পাওয়া যায় ।
কোথাও তাঁকে মাথা নত করতে দেখা যায়নি । এই বিরোধের কারণ ছিল প্রধানত সংস্কারমুক্ত সমাজ গঠন এবং শিক্ষাকে আধুনিক করার স্বার্থ । এদেশের পাঠক্রমে আধুনিক চিন্তনের প্রকাশ তাঁর হাত ধরেই । শিক্ষা বিস্তারে বিশেষত নারী শিক্ষার প্রশ্নে তাঁর অবদান ইতিহাসে স্বর্ণ অক্ষরে লেখা আছে । এই কথাগুলি যাকে নিয়ে বলা তিনি হলেন জগদ্দল পাথের মতো কুসংস্কারছন্ন সমাজ জীবনকে ঝাঁকি দেওয়া সেই মানুষ যাকে আমরা সকলেই পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিসেবে চিনি ।
পাশ্চাত্য ভাবনাচিন্তাকেও তিনি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন । পাঠক্রমের ব্যপক পরির্তনের মধ্যে তা প্রতিভাত হতে দেখা যায় । ভাষার প্রশ্নে বাংলা ভাষার উন্নতিতে তার ভূমিকা সর্বজন বিদিত । তাঁর বর্ণপরিচয় তখন বাংলার ঘরে ঘরে । যা আজও আমাদের সম্পদ । এমন ব্যতিক্রমী মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর বন্ধু প্রীতিও ছিল অনুসরণযোগ্য । তাঁর বহু বিস্তৃত কর্মজীবনে্র একটা ছোট ঘটনা এখানে উল্লেখ করা হল ।
তখন তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ(১৮৫১-১৮৫৮) । এই সময় তাঁকে চারটি জেলার(নদীয়া,হুগলী,বর্ধমান এবং মেদিনীপুর) সহকারী পরিদর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে । ২২শে আগস্ট,১৮৫৫ থেকে ১৪ জানুয়ারী ১৮৫৬ এর মধ্যে ২০টি মডেল স্কুল স্থাপন করলেন । অক্লান্ত চেষ্টায় নানা বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে তৎকালীন ছোটো লাট হ্যালি ডে সাহেবের মৌখিক প্রতিশ্রুতির উপর ভরসা করে ২৪ নভেম্বর ১৮৫৭ থেকে ১৫ই মে ১৮৫৮ সালের মধ্যে মেয়েদের জন্য ৩৫টি বিদ্যালয় স্থাপন করে ফেললেন তিনি ।
বিপত্তি দেখা দিল এতগুলি স্কুলের বিপুল ব্যয়ভার বহনকে কেন্দ্র ক’রে । যার ভরসায় তাঁর এই উদ্যোগ সেই ছোট লাট হ্যালি ডে সাহেব অবশেষে বেঁকে বসেছেন । তিনি জানিয়ে দিয়েছেন তিনি তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনে অক্ষম । সরকারের সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়ে তখন তিনি অথৈ জলে । কিন্তু তাই বলে এক রোখা, জেদি পুরুষ সিংহ বিদ্যাসাগর মহাশয় দমে পড়ার মানুষ নন । তাঁর মাথায় তখন সর্বসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের চিন্তা । বিশেষত নারী শিক্ষার বিস্তার নিয়ে তখন তিনি ব্যস্ত । ঠিক করলেন এই দায়িত্ব তিনি নিজেই নেবেন ।
এই উদ্দেশে তিনি তহবিল গঠনের জন্য উদ্যোগ নিলেন । এই সময় তিনি ভীষণ ভাবে আর্থিক সঙ্কটে পড়ে গেলেন । বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো তাঁর সামনে আর এক সমস্যা এসে উপস্থিত হল । সালটা ১৮৫৮ । কতৃপক্ষের সাথে মতবিরোধের ফলে তিনি কলেজ থেকে পদত্যাগ করলেন । অনেকের ধারণা এই বিরোধের একটা অন্যতম কারণ ছিল সরকারের মনোভাব ।
ফলে তাঁর আর্থিক সঙ্কট আরও বেড়ে গেল । যখন তিনি এই সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন তখন গ্রামের বাড়ির যাবতীয় ব্যয়ভারসহ কলকাতায় তাঁর বাসায় থাকা ভরণপোষণসহ কুড়িজন ছাত্রের পড়াশোনার সমস্ত দায়িত্ব তাঁর মাথায় । ইতিমধ্যে তিনি তাঁর পিতৃদেবকে চাকুরি ছাড়িয়ে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন । তাঁকে ঋণ করে প্রতিমাসে বাড়িতে পঞ্চাশ টাকা ক’রে পাঠাতে হচ্ছে ।
আর্থিক সংকটে জর্জরিত তাঁর এই অবস্থা দেখে তাঁর হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধু ময়েট সাহেব ক্যাপ্টেন ব্যাঙ্ক নামে এক সাহেবকে তাঁর কাছে কমাসে জন্য বাংলা এবং হিন্দি শেখানোর উদ্দেশে পাঠালেন । ক্যাপ্টেন ব্যাঙ্ক ছিলেন ময়েট সাহেবের বিশেষ বন্ধু । ময়েট সাহেব জানেন তাঁর পক্ষে বন্ধু বিদ্যসাগর মহাশয়কে অর্থ সাহায্যের প্রস্তাব দেওয়া সম্ভব নয় । তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে ।
অথচ বন্ধুর এই সংকট কালে কিছু না করলেও নয় । অগত্যা ঘুর পথে কিছু করা যায় কিনা এমন ভাবনা থেকেই তার এই ছোট্ট চেষ্টা । উদ্যোগ ছোট হলেও সেই সময় ৫০ টাকার মূল্য কম ছিল না । সেই সাহেব ছাত্র তাঁকে মাসিক পঞ্চাশ টাকা হিসেবে বেতন দিতে গেলে বিদ্যসাগর মহাশয় তা নিতে অস্বীকার করলেন । তিনি সেই ছাত্রকে বলেছিলেন,তিনি তার বন্ধুর অনুরোধে তাঁকে পড়িয়েছেন,তাই এই অর্থ তাঁর পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয় । কিছুতেই সেই সাহেব তাঁকে সেই গুরুদক্ষিণা নেওয়াতে পারেননি । তাঁর এই বন্ধুপ্রীতি নিঃসন্দেহে একটা বিড়ল দৃষ্টান্ত ।
তীব্র অভাব এবং অর্থসংকটও তাঁর বন্ধু প্রীতিতে এবং ঋজু ব্যক্তিত্বের ওপর সামান্যতম ছায়া ফেলতে পারেনি । বিশেষত বর্তমান আনুগত্য প্রিয় অমেরুদন্ডী মনুষ্যকুলে বিগত শতাব্দীতে এই বন্ধুত্ব সত্যিই বিস্ময়কর ।
প্রতীচীঅ্যাপার্টমেন্ট,ডাবগ্রাম-১,পোঃরবীন্দ্রসরণি,শিলিগুড়িঃ৭৩৪০০৬মোঃ ৯৪৩৪০৯৬৭৭৭.