নৈঃশব্দের শব্দেরা
প্রদীপ ভট্টাচার্য্য
পরষ্পর দুটি বস্তুর মুখোমুখি হঠাৎ সংঘর্ষে জন্ম আমার
জলের মতো আমার কোন আকার নেই নিশ্চিত
বহুরূপী লেবাসে আমারও হেরফের হয়।
আমি অন্তহীন নই তবে ক্রমবর্ধমান
বিশ্বের আদি সুর,অনন্ত রেওয়াজে থাকি।
সুরের সাতটি স্বরের মতো লালিত হইনা
যদিও সাতটি স্বরই পৃথিবীর বৈচিত্র্য রূপ—–
সর্বদাই একা ক্লান্তিহীন সৃষ্টির আধার।
আমি প্রতিনিয়তঃ চঞ্চল চপল একা থাকতে পারিনা
শত শত বস্তুর অণু-পরমাণু আমায় আন্দোলিত করে
সুরের ললনার মত ভাসিয়ে নিয়ে যায় সাগর পারে
ফেণীল উচ্ছাসের মত আমার দেহ মোহময় করে—-
বকুল ফুলের সাদা মালার ঘ্রাণ
লাস্যময়ির তকমায় উত্তেজিত করে রাতের জলসা।
দিন যায় রাত আসে চক্রব্যুহের এই অবিনাশি চাকা
মাঝে মধ্যে কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ে দেখি পৃথিবীর মানুষ,
বড্ড একা থেকে অনুভব করি আমি যৌগিক
তোমরাই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন,আমি
প্রাণহীন!তবু জীবন্তের মাঝে ;প্রাণময় শব্দ বিলীন।
একদিন ফুল হবে ফল হবে
প্রদীপ ভট্টাচার্য্য
চোখ থেকে উড়ে যাচ্ছে দৃশ্যগুলো সপাট
রাতজাগা শেয়ালের ডাক হুতোম পেঁচার শরীর
ফাগুনের হীমপ্রবাহে শ্রাবণের নদীগুলো দ্রুত।
জীবনের এলোমেলো পৃষ্ঠাগুলো জড় একপৃষ্ঠায়
সময় বয়ে যায় নিরন্তর রংগীলা মাঝির বৈঠায়
সাগরের বুকে এখন ষোল নম্বর ঝড়ের সিগন্যাল।
কে যেন বসে আছে উৎকণ্ঠায় অনন্ত প্রতীক্ষায়
আঁধার সরিয়ে একফালি চাঁদ হয়ে আসবে সে
অবুঝ পাখিটা এখনো যায়নি কেবল পাখায় উড়ছে।
সেখানে যেতে হলে হতে হয় সৌম্য পূতঃ পবিত্র
ভুলবশতঃ কখোন মাড়িয়ে এসেছে মৃতের কবর
সাথী সহচর কেউ দেখেনি পেছনে একবারো।
এখন চারচোখের প্রতিযোগীতায় মিশেল শরীর
একটি সুবোধ সকালের প্রতীক্ষায় জেগে থাকে
একদিন ভোর হবে ফুল হবে ফল হবে আগামী।
ঐ দালানটা ধূসর ছিল
প্রদীপ ভট্টাচার্য্য
বাগানের পাশে ঐ দালানটা ধূসর ছিল
একদিন গ্রামের সবাই মিলে লাল করে দিল
এখন সে শুধুমাত্র কালের স্যাঁতস্যাঁতে সাক্ষী।
ইলেকট্র্রিক পাখার বাতাসে এখন
সামন্তরাজের আধুনিক ছোঁয়া চক্ চকে
ফসলের মাঠে অধরা ঝিলিক।
রাজার মুকুটে চড়ে আসে রাতপরি
ফুরফুরে বাতাসে শোনায় ঘুঙ্গুর ধ্বনী
একদা সাধ ছিলো গোধূলী রাতে পরার।
দেখি এখন গ্রাম পুলিশের চোখ এড়িয়ে
রাতদুপুরে মধ্যবয়সীদের বিনোদনের আসর
গাঁজার কুণ্ডলীতে জেগে ওঠে আদিম ইচ্ছা।
রাত ঘুমিয়ে গেলে জমিহারা কৃষকের হাহাকার
হাতে তার জমির কাগজ উড়িয়ে দ্যায় দিগন্তে
ভাষাহীন হাওয়ায় মেলে শুধু আপনজনের আকুতি।
তবু একলা দাঁড়িয়ে দেখে সরলরেখায় বিস্তৃত মাঠ
চাঁদের আলোয় মাথা দোলায় সোনালী ধানের ডগা
দিনের আলোয় একসময় ভেসেওঠে জমির আইল।
বউয়ের স্বপ্নের নোলক ভাসে হারানোর জলে
অতলে পড়ে থাকে হীরকের সম্ভাব্য ঝিনুক
একদিন হারান জেলের জালে এলেও চিনতে পারেনি।
তারকাছে ঝিনুক শুধু ঝিনুকই চোখে পড়ে
ওপাড়ার তালুকদার আজকাল মাছের সাথে
ঝিনুক কিনে বাড়িয়েছে তার পসার।
হারানের চোখে সব ঝিনুকই যেন ধূসর
সাদা চোখে আর কোন পড়েনা ছায়া
অন্তহীন স্বপ্নের দেশে শুধু ঘুম পাড়ানির মেলা বসে
তার নাকডাকা শব্দে শান্তির রাত্রিটা বোবার
নির্লিপ্ত অভিশাপ ঘোচায় সময় সাক্ষী রেখে
একদিন রাত্রিও রাঙ্গাবে ধূসর দালানকে লাল রং এ।
কেউ হেঁটে আসছে
প্রদীপ ভট্টাচার্য্য
ভাদ্রের শেষে শিশিরের আনাগোনা।
একফোটা স্ফটিকের স্পর্শে
কচুপাতার শিহরণ
সীমার মাঝে বিচরন এক
জড়সড় শীত।
জলে হীমের গন্ধ তার আগমনী
হাত বাড়িয়ে খুঁজে নেয় উষ্ণ চাদর
সকালের প্রজাপতিটা উড়ে গেছে
খানিকক্ষণ আগে।
তার আর থাকা হলনা মানুষের কাছে।
সেই কবে সময়ের কথা বলে
বিতাড়িত হয়েছে পঞ্চমির চাঁদ।
বাড়ির পাশে শিউলি তলায় আজো
বসে আছে ধর্মগড়ের বোষ্টবী
কাঁধে তার আঁচল নিয়ে পথপানে
জানাবে গলগ্রহ প্রণাম।
কবে আসবে তার শ্যামপ্রসাদ।
অপেক্ষার দিনগোনা সপ্তমির দূর্গা
যাবে দশমিতে শ্বশুর বাড়ী।
সাগরের পাড়ে জনকোলাহল
পাশে পিচঢালা রাস্তা পায়ের শব্দে চঞ্চল
প্রকৃতি মুখরিত রাজনীতি সমাজনীতি নিয়ে
স্বাস্হ্যসেবা প্রতিদিন হাটে
সুখে দুঃখে কখনো হাসপাতালের বেডে
জীবন শুয়ে থাকে চোখের জলে।
সকালের হীমশিশিরে আজো কেউ
হেঁটে যাচছে হয়তো একাকীত্বের নাম বদলে
জীবন মানেই সুদীর্ঘ ইতিহাস
ছোট ছোট ঘটনা থেকে খুনসুটি।
একটি অচেনা কবিতা
প্রদীপ ভট্টাচার্য্য
একটি সরলরেখা বৃত্তের মাঝে ঘুরে ঘুরে
বড্ড অভিমানী হয়েছে বেশ
হয়েছে রহস্যময়ি নারী ও নদী, তাকে নিয়ে
যত কবি মেলায় মশগুল রচনা করে আনমনে
পৃথিবী থেকে শূণ্য মহাশূণ্যের ভেতর
অজানা দেশের কোন অগোচর গল্প।
পৃষ্ঠার টানা হ্যাঁচড়ায় জীবন কাহিনী এসে
কোথায় যেন থেমে যায়, তাকে কী বলে?
বর্ণনায় হয়তো বেসুরো দোয়েল চিনে নেবে
আপন ঘর অচেনা পাখির বৃক্ষ ও অরণ্যে।
প্রতিবারই প্রমাণ করতে হয় তার জীবন
পঙ্গু নয় দখিনের কপাট বন্ধ অন্ধ জানালা মাত্র
চলতে গিয়ে হোঁচট খায় এদিক ওদিক তারপর
মুখ গুজে নারীর মসৃন শরীরের লোমকূপে লুকায়।
বেগানা ইচ্ছে বরাবরই লম্পট সীমানা যেন
লাস্যময়ি রাতের নগরি,রং-বেরংগের পানশালা
উদ্দেশ্যহীন এক পথচারির মত উদভ্রান্ত বহর
নামগোত্র হীন পথের সফর দীনদুনিয়ার সরাইখানা
একসময়
জনশূণ্যে কেঁদে উঠে একসাথে পৃথিবীর সব নগরি
রাত ফুরোলে দিন লিখে যায় কোন পিরামিড মমীতে
ইতিহাসের ইতিবৃত্ত চোখের জল হতাশার চাদর
অথবা কোন নামবিহীন সড়কের জন্মান্তরের ইতিহাস
জীবন এক সময়ের অন্তরে সময় নিয়ে পথের অভিযান।
আমরা বর্ণিল বিপরিত
প্রদীপ ভট্টাচার্য্য
লিকলিকে লাল জিহ্বায় রাস্তা
বৃষ্টি হেঁটে যাচ্ছে কালো পথে
মাথায় ছাতা হাতে খসখসে জামা
চপ্পল পায়ে চলা পথিকের দল
অসহ্য গন্ধে দূষিত এক শহর।
গাড়ির হর্ণে কেবল আকুতি আগে
এখানে সবাই দায়ব্দ্ধ নয় একে অপরের কাছে
ইচ্ছে অনিচ্ছের কোন বালাইনেই একটুও
ট্রাফিক সিগন্যালটাই একমাত্র চালিকা শক্তি।
রোদের তেজ এখন তুঙ্গে যুদ্ধ করে আদিম ক্ষুধা
রাস্তার কুকুরগুলো ভদ্র কেমন শুয়ে আছে
অথচ শতাব্দীর কোলাহল মিশে গেছে রাস্তায়
একা দাঁড়িয়ে গাছটার ছায়ায় ওরা
কে যেন দুজন আড়ালে ঝিমুচ্ছে
বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে গাইছে দেহতত্ব।
একটু এগিয়ে যেতেই ওরা দুজন
একটু বেঁকিয়ে ঝুলে পড়ে সামনে
কেমন আছো বাবা
যেন কত দিনের চেনা কত আপন —-
আড়ষ্ঠ কণ্ঠে হাত বাড়িয়ে বললে
তোমায় অনেক দিন পর দেখলাম।
তুমিতো সেই কবি না —যে অশেষ ধৈর্যের বলে
অগ্নুৎপাতে দিব্যি হেঁটে চলো জনসমুদ্রে।
জানো সেদিন তোমাকে অভিনন্দন জানাইনি
কেন জানো প্রবল গোশশায়
আমার কল্কের শেষ টানে শেষ গালিটাই
দিয়েছি তোমাকে——
শালা আস্ত এক গাজাখোর।
পরিস্কার ছিল তোমার ভেগাস নার্ভ
স্বচ্ছ জলের মত সব সামনে আসে
কলমের ডগায় যা লিখে ফেলো কল্পনায়
সেতো শতাব্দীর ফানুস উঁকি দিয়ে যায়
এই যেমন আমি তোমায় দেখি আসমানে
তারপরে জেগে উঠলে দেখি উত্তাল রাস্তায়
আমরা পরষ্পর একমুখী বিপরীত রাস্তা।