PULAK MAJUMDER

চেনামুখ অচেনা পরিচয় – ২

পুলক মজুমদার

পুলক মজুমদার

-কাঠমান্ডু থেকে ছুটিতে বাড়ি এসেছি। এক মাস পর আবার ফিরে যাব নিজ কর্মস্থল কাঠমান্ডু এ্যাপারেলস’য়ে।
-ওখানে কোন পদে ছিলি ?
-আসলে আমি চট্টগ্রামের সিইপিজেড রিজেন্সী গার্মেন্টসয়ে জুনিয়র মর্চেনডাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ওখানেই এক বিদেশী বায়িং হাউসের মাধ্যমে কাঠমান্ডুর কাঠমান্ডু এ্যাপারেলস’য়ে মর্চেনডাইজারের চাকরীর অফার পেয়ে ফিরাতে পারলাম না। দুই বছর দায়িত্ব পালন করার পর এক মাসের ছুটিতে দেশে ফিরে আসি।

মা দেহ রেখেছেন তাও বছর পাঁচেক হয়ে গেল। দেশে ফেরার পর বাবার অবস্থা দেখলাম একেবারে জবুথবু। বার্ধক্যের নানান ব্যাধিতে আক্রান্ত। আর তার সুযোগ নিয়ে আমার বড় ভাই একটা কথিত দানপ্ত্র সৃজন করে পুরো সম্পত্তির একক মালিকানা তার নিজ নামে করে নেয়। বাবার অবস্থা একেবারেই স্বাভাবিক নয়। তিনি বরাবরের মত স্মৃতি হারিয়েছেন।

আপন সহোদরের এই অন্যায় অনুচিত কাণ্ডে মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। তাকে নানা মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্ঠা করলাম। কিন্তু তার এক কথা। বাবা তাকে জেনেবুঝে সবকিছু লিখে দিয়েছে। সে শর্ত দিল বাবা যতদিন বেঁচে আছে ভবনে আমি বা আমার পরিবারের থাকতে বাঁধা নেই। কাঠমান্ডু আর ফিরে যাওয়া হল না। এর বছর খানেকের মাথায় বাবা চিরকালের মত বিদায় নিলেন। বাবার মৃত্যুর পর বড় ভাইয়ের আসল চেহারা আরো পরিষ্কার হল। তার নতুন নির্দেশ পৈত্রিক বাড়ীতে থাকতে হলে তাকে ভাড়া গুণে দিয়ে থাকতে হবে।

মার এক ছোট বোন ছিলেন। তাঁর পরামর্শে স্বত্ত্বের মামলা আদালতে রুজু করলাম। আর তাতেই বড় ভাই ভীষণ ক্ষেপে গেল। প্রথমেই কেটে দিল গ্যাস সংযোগ। এর পরের দিন জলের লাইন কেটে দেওয়ার জন্য যখন সে এল সঙ্গত কারনেই আমি বাঁধা দিলাম। কথা কাটাকাটি মারামারির পর্যায়ে চলে গেল। তার হাতে ক্রিকেট স্ট্যাম্প ছিল। খুব মার খেলাম। তবে এক ফাঁকে তার কাছ থেকে স্ট্যাম্প কেড়ে নিয়ে মাথায় আঘাত করলাম। চোট তেমন গভীর নয়। মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে দেখে বিভ্রান্ত হয়ে বসে পড়ল।

ঘটনার রেশ ওখানেই থামল না। চট্টগ্রাম মেডিকেলের আউটডোরের ডাক্তারকে কনভিন্সড করে লিখিয়ে নিল ধারাল কোন কিছু দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হয়েছে।
আমার বড় তিন ভগ্নীপতি ও আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে ওয়ারেন্ট ইস্যু করল। ভগ্নিপতিরা সব সম্ভ্রান্ত বংশীয়। নানা উঁচু পদে চাকরী করে। একটা সময় জামিন নিয়ে চার্জশীট থেকে ওদের নাম কাটিয়ে নিল।
একমাত্র আসামী হিসেবে আমার বিরুদ্ধে মামলা চলতে লাগল।
স্বাক্ষী হিসেবে আমার বিরুদ্ধে দাড় করানো হল ষাটোদ্ধ এক প্রতিবেশী আবু বকর সিদ্দিক। সদ্য হজ্ব করে এসেছে। সে কোর্টে দাড়িয়ে সোজা বলে দিল ধারাল রক্তাক্ত কিরীচ হাতে সে আমাকে আঘাত করতে দেখেছে। পরিষ্কার বাংলা ভাষা সে বলতে পারে না। কিন্তু এক অনন্য মুন্সিয়ানায় তার জবানবন্দী ইংরেজীতে লিপিবদ্ধ করা হল।

দেখতে দেখতে মামলার রায়ের দিন এসে গেল। আমার উকিল ছিলেন চট্টগ্রাম বার-এট-লর সিনিয়র লয়ার এ্যাডভোকেট চন্দন বিশ্বাস। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের পেশকারকে ফোন করে জেনে নিল রায়ে আমার দুবছরের সাজা হয়েছে। শান্ত কণ্ঠে আমাকে বললেন –
-বীরেশ বাবু। রায়ের সার্টিফায়েড কপি তুলে নিই। আদালতে আপনার এখনই হাজির হওয়ার দরকার নেই। কয়েকটা দিন গা ঢাকা দিন। আমি বললে সারেন্ডার করবেন। তিনদিনের মধ্যে জর্জ কোর্ট থেকে জামিন করিয়ে নেব।

কথা রেখেছিলেন বিশ্বাস বাবু। মামলা নতুন নাম্বার নিয়ে জর্জ কোর্টে চলতে লাগল। বার-এট-লর প্রাক্তন সভাপতি এ্যাডভোকেট চন্দন দাশকে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দিলাম। পাঁচ বছর মামলা চলার পর জর্জ কোর্ট সাজা কমিয়ে এক বছরের সাজা বহাল রাখল। আপীল করলাম হাইকোর্টে। সাত দিনের মাথায় জামিন নিয়ে বেরিয়ে এলাম বটে তবে মামলা চলল আরো চার বছর।
হাইকোর্টের রায়ে সাজা বহাল থাকল। আর আবেদন করার কোন সুযোগ আমার থাকল না। এক বছরের সাজা ভোগ করে যখন নিজ বাড়ীতে এলাম। আমায় ঢুকতে দেওয়া হল না। বাড়ির মালিকানা হস্তান্তর হয়ে গেছে।
-সেকি! কিভাবে?
এতক্ষণ সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত বীরেশের কথা শুনছিল। শঙ্করের আচমকা প্রশ্নে যেন সম্বিৎ ফিরে পেল।

(ক্রমশ)

https://bangla-sahitya.com/post/

Leave a Reply