PULAK MAJUMDER

পুলক মজুমদার

বীর শিবাজী – ৩

পুলক মজুমদার

ভোরের আলো ফুটতেই মারাঠা সর্দাররা শিবাজীর সাথে গোপন বৈঠকে মিলিত হলেন। মা ভবানী স্বপ্নাদেশ দিয়েছে শুনে মারাঠারা সন্ধি নয়, যুদ্ধ করতে সহমত হলেন। ভরাট কণ্ঠে শিবাজী বলে উঠলেন –
-পেশোয়াজী। বড় একটা সৈণ্যদল নিয়ে আপনি প্রতাপপুর দুর্গের অদূরে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকবেন। আর নেতাজী পালেকর আর একটা বাহিনি নিয়ে জঙ্গলের অন্য পাশে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকবে। আফজল খানের সাথে সাক্ষাতের দিনে প্রতাপগড় দুর্গ শীর্ষ থেকে তোপধ্বনি শুনতে পেলে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে বিপক্ষ দলের যাকেই সামনে পাবেন হত্যা করবেন।

অভিযানে মৃত্যু হলে শিবাজীর পর দায়িত্ব কে নেবেন এবং তার করণীয় ঠিক কি হবে তা বিশদভাবে বোঝালেন শিবাজী। বিজাপুরের চারদিকে শিবাজীর ছদ্মবেশী গুপ্তচরেরা ছড়িয়ে পড়ল। তাদের কাছ থেকে শিবাজী খবর পেলেন সন্ধির জন্য দেখা করা বাহানা মাত্র। তাঁকে বন্দী করাই আফজাল খানের মূল উদ্দৈশ্য।


বাই নগর হতে আফজল খান সসৈণ্যে প্রতাপপুরের দুই কিলোমিটার দক্ষিণে নীচের সমতল ভূমিতে পার গ্রামে এসে ঘাঁটি গাড়ল। কয়না নদীর তীরে পার গ্রাম। তার সুদক্ষ সৈণ্যদের সবাই গভীর উপত্যকার চারপাশে আশ্রয় নিল।
পরদিন পন্তাজী গোপীনাথ শিবাজীর পক্ষ থেকে কৃষ্ণাজী ভাস্করের সাথে আফজাল খানের শিবিরে গেলেন।
-বল দূত। শিবাজী কি আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে রাজি হয়েছে?
-হুজুর। উনি সন্ধি করতে রাজি হয়েছেন। তবে!
-তবে কি?
-আপনার সাথে দেখা করতে ভয় পাচ্ছেন। যদি আপনি তাকে বন্দী করেন!
-সে আশংকা নেই। আমি তার কোন ক্ষতি করব না।
-যদি তাই হয় তাঁর দিক থেকে ও এর অন্যথা হবে না।


-শিবাজীকে বলো এক হাজার সৈণ্য নিয়ে প্রতাপপুর দুর্গের কাছের পাহাড়ে আমি হাজির থাকব।
-না হুজুর। অত সৈণ্য দেখলে শিবাজী ঘাবড়ে যাবে। আর সেক্ষেত্রে সে আপনার সামনে আসবে না। সৈণ্যদল এই পার গ্রামে রেখে অল্প দূরের ঐ পাহাড়ে শুধুমাত্র দুজন দক্ষ সৈণ্য নিয়ে আপনি আসুন। শিবাজী ও দুজন সৈণ্য নিয়ে হাজির হবেন।
শারীরিক গঠনে শিবাজীর উচ্চতা আফজাল খানের কাধেঁর সমান। একবার যদি দুহাতের বন্ধনে শিবাজীকে ধরা যায়, তবে তার আর বেঁচে ফেরা হবে না। মৃদু হেসে আফজল খান বলল –
-ঠিক আছে। শিবাজীকে বল তার প্রস্তাবে আমি রাজি।
১৬৫৯ সালের ১০ নভেম্বর আফজল খান ও শিবাজীর সাক্ষাতের দিন ঠিক করা হল।


এদিকে প্রতাপপুর দুর্গের গোপন কক্ষে সব সেরা বলিষ্ঠ পালোয়ানদের কয়েকজনকে আনানো হল। বলশালী বাহুর তীব্র পেষনে দম ধরে রাখার কৌশল আয়ত্ত করা শিবাজীর উদ্দৈশ্য। গভীর রাতে শুরু হল প্রশিক্ষণ। কয়েকদিন নিত্য অনুশীলনে কঠোর চাপে দম ধরে রাখার সক্ষমতা অর্জন করল শিবাজী।
প্রতাপপুর দুর্গ থেকে অল্প দূরত্বে অন্য একটি নাতি উচ্চ পর্বত শৃঙ্গে উভয়ের সাক্ষাতের আয়োজন করা হল। আফজল খান তার সৈণ্যদলের মধ্যে সেরা তলোয়ারবাজ সৈয়দ বান্দা ও তার মতই যুদ্ধ কাজে অতি নিপুন এক সৈনিক এবং কৃষ্ণাজী ভাস্করকে নিয়ে তৈরী হলেন। আর তাদের পথ দেখিয়ে পাহাড়ের উপর সাক্ষাতের জন্য নির্দিষ্ট তাবুতে নিয়ে গেলেন পন্তাজী।
তাবুর বিলাশ বহুল আড়ম্বর দেখে আফজল খা রেগে চেচিয়ে উঠল –
-সামান্য জায়গীরদারের ছেলের এত আড়ম্বর ?
-না হুজুর। এই বিলাশ সামগ্রী শিবাজীর নয়। এসব বহুমূল্য দ্রব্য বিজাপুরের সুলতানকে সন্ধির উপহার স্বরুপ দেওয়ার জন্য আনানো হয়েছে।

ওদিকে প্রতাপপুর দুর্গে শিবাজী লোহার জালির বর্ম গায়ে দিয়ে তার উপর পড়লেন মারাঠা সর্দারদের সুবিখ্যাত পোষাক। মাথার উপর ছোট ইস্পাতের কড়াই রেখে তার উপর পড়লেন পাগড়ী। বাম হাতের আঙ্গুলে তিনটি আংটি। উপরে দেখতে আংটির মত হলে ও এর উল্টো পিঠে রয়েছে তিনটি ধাতব বাঘ নখ। ডান হাতের আস্তিনের নীচে নিলেন বিছুয়া নামে বিষ মাখানো ছোরা। শিবাজীর শরীরে কোন অস্ত্র রয়েছে তা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। সাথে নিলেন ক্ষিপ্রহস্তে তলোয়ার চালনায় ও দ্বন্ধযুদ্ধে সুদক্ষ জীব মহালা ও শম্ভুজী কাবজীকে। দুজনেরই কোমরে দুটো করে তলোয়ার গোজা।
দুর্গ থেকে বেরোনোর সময় মার চরণ ছুঁয়ে অনুমতি চাইলেন শিবাজী। রক্তাম্বর বসনা মা ছেলের মাথায় হাত ছুঁইয়ে আশীর্বাদ করলেন –
-বিজয়ী ভব। তোমার জয় হোক।

(ক্রমশ)

Leave a Reply