
বি এস এফ ক্যাম্পে পনের ঘণ্টা – ১৫/০৮/২০০৬
পুলক মজুমদার
শ্রাবণ মাস হল শিবের পুজোর জন্য অতি পবিত্র মাস। বিশেষ করে প্রতি সোমবার পূজার সেরা সময়। আর তাই শিব মন্দিরগুলোতে বিশেষ এই দিনে ভক্ত পূর্ণাথীর ভিড় উপচে পড়ে।
দ্বাদশ জ্যোতিলিঙ্গের অন্যতম বৈদ্যনাথ ধাম যাত্রার জন্য গোরকপুর থেকে রয়েছে বিশেষ ট্রেন শাওনমেলা এক্সপ্রেস। যাত্রাপথে নিউ জলপাইগুঁড়ি হয়ে ট্রেন বৈদ্যনাথ ধামে পৌঁছায়।
দিন দুই হল নেপালের ভৈরবা সীমান্ত দিয়ে গোরকপুর এসেছি। শিলিগুড়িতে মেজ, সেজ ও ন কাকারা থাকেন। গোরকপুর থেকে নিউ জলপাইগুঁড়ির দূরত্ব সাতশ নয় কিলোমিটার। শিলিগুড়িতে কাকাদের বাড়ীতে কয়েকদিন কাটিয়ে নিউ জলপাইগুঁড়ি থেকে পাঁচশ ষাট কিলোমিটার পেরিয়ে হাওড়ার বামনগাছিতে মাসতুতো বোন নন্দিতাদির বাড়ীতে উঠলাম।
আমার পাসপোর্টের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ। তাই সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশ প্রবেশের অন্যতম অবলম্বন ব্রোকার। জামাইবাবু বাবুলদা অত্যন্ত সহ্নদয় ও আন্তরিক। উনার সহায়তায় ব্রোকারের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাট পৌঁছলাম। ব্রোকার বিশুদা ঈসমাইল নামে একজনের জিম্মায় আমায় রেখে লিলুয়া ফিরে গেল। এখান থেকে সীমান্ত মাত্র চার কিলোমিটার। সীমান্তে ভারতীয় অংশের নাম গোজাডাঙ্গা আর ওপারে বাংলাদেশ অংশের নাম ভোমরা।
বশিরহাট বাজারে আমায় একটা দোকানে বসিয়ে ঈসমাইল চলে গেল। ফিরে এল যখন ঘড়িঁর কাটায় তখন সকাল নয়টা।
-দাদা। অনেক আগেই আপনাকে সীমান্ত পার করিয়ে দিতাম। আসলে গত সপ্তাহ থেকে বর্ডার এলাকায় কড়া পাহাড়া বসিয়েছে বি এস এফ পেট্রোল।
-দেখুন দাদা। আমি বরং কোলকাতায় ফিরে যাই।
-আপনি টেনশন নিচ্ছেন কেন? লাইন ক্লিয়ার না থাকলে কোন ঝুঁকি নেবো না। আজ স্বাধীনতা দিবসতো রিলাক্সে পার হতে পারবেন। সোজা এগিয়ে যান। আমি পিছন পিছন আসছি।
-পিছনে কেন সাথে চলুন।
-আরে দাদা। কথা বলা আছে। কোন সমস্যা হবে না।
কথা বলতে বলতে হাঁটছিলাম। কয়েক মুহূর্তের বিরতিতে পিছন ফিরে দেখি ঈসমাইল হাওয়া। পনের ফুট চওড়া পিচ বাধাঁনো পথ। দুপাশে ধানক্ষেত। আশেপাশে কোন মানুষজন নেই। আমার ভাল মনে হল না। একবার ভাবলাম বশিরহাট হয়ে কোলকাতা ফিরে যাই। কিন্তু আমার নিয়তিই যেন আমায় সামনে ধাবিত করল।
আরো কিছুদূর এগোনোর পর ডানপাশে একটা কাঠের দোতলা বাড়ি নজরে এল। দশ-বারো বছরের এক কিশোর আপন মনে মোবাইল টিপছে। পায়ের শব্দ শুনে একবার মাত্র মুখ তুলে চাইল। তারপর আবার মগ্ন হয়ে গেল মোবাইলে। বাড়িটি পেরিয়ে আমি এগিয়ে চললাম।
-ও দাদা শুনুন।
ভারিক্কি গলার ডাক শুনে ভাল মনে হল না। না শোনার ভান করে যেমন হাঁটছিলাম তেমনই হাঁটতে লাগলাম।
-জরা রুখিয়ে তো।
হিন্দিতে প্রশ্ন শুনে বুঝতে পারলাম এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। মুখ ফিরাতেই নজরে পড়ল বিশ মিটার দূরত্বে যে লোকটা দাড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত আগেও তার অস্তিত্ব আমার অজানা ছিল। যেন ভোজবাজির মত উঠে এসেছে। তার দেহের গড়ন, দাড়ানোর ভঙ্গিমা বলে দিচ্ছিল তিনি ডিফেন্সের লোক।
-জরা ইধার আইয়ে তো।
প্রায় ছয় ফুট উচ্চতা, সুঠাম পেশীবহুল শরীর, স্যাণ্ডো গেঞ্জী ও ক্যাসুয়াল পেণ্ট পরিহিত অবয়বটি যে বি এস এফ তা বুঝতে কষ্ট হল না।
-কিধার যা রাহা থা?
-এইসেহি ঘুমনে কে লিয়ে।
-ঘুমনে কে লিয়ে জিরো পয়েণ্ট পর।
-ইয়ে জিরো পয়েণ্ট হে! নয়া আদমী হু মুঝে পাতা নেহি থা।
-আপ কাহা সে আ রাহা হে?
-চৌরঙ্গী মোড় সে।
-কিসকী মকান পর?
-ঈসমাইল। মেরা দোস্ত।
-ক্যাসে ভেট হুয়া উসকি সাথ?
-ট্রেন মে।
কথা বলার ফাঁকে আমার ট্রাউজার, শার্টের পকেট চেক করছিল। সকালে মুখ ধুয়ে টুথব্রাশ ব্যাগে রাখতে ভূলে গিয়েছিলাম।
-আপ ব্রাশ লে কর ঘুমতা হে?
-ব্যাগ মে রাখনে কে লিয়ে ভূল গেয়া থা।
-আসলি ঘর কাহা হে?
-দমদম।
-কোই আইডি হে আপকি পাস?
-আইডি তো হে। লেকিন সাথ মে নেহি। আপকো জরুরত হো মাঙ্গাকে লে আ সেকতা।
খুব জোরে ব্রেক কষে একটা বাইক এসে দাড়াল।
-ক্যায়া হুয়া পরেশ?
-স্যার। ইয়ে আদমী বর্ডার কি তরফ যা রাহা থা। মুঝে ডাবট লাগ রাহা। আচ্ছাসে পুছপাস করনা হোগা।
-ক্যাম্প মে ভেজ দো।
আমার দিকে তাকিয়ে শর্ট পেণ্ট পরিহিত লোকটা বলল-
-আপ ইধার আয়ে তো। পিছে বেঠিয়ে।
-মুঝে কাহা লে যা রাহা আপ?
-ক্যাম্প মে।
-ইয়ে ক্যাসা মজাক হে স্যার? ইয়ে হামারা দেশ হে। যাহা পর মর্জি হাম ঘুম সেকতে হে।
-চুপচাপ বেঠিয়ে আপ।
প্রায় দুই কিলোমিটার পেরিয়ে খুব জোরে বাইক ব্রেক কষল। শুনশান জায়গা। কোথাও জনপ্রাণীর সাড়া নেই। দুজন সীপাহী পাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সেলাম ঠুকল।
-তিওয়ারী। ইনকো আভি ক্যাম্প মে লে যাও। ছোড়নে কা নেহী।
দুজন সীপাহী দুপাশ থেকে আমাকে বগলদাবা করে নিয়ে যেতে লাগল।
-ক্যাসে বাতে হে? আপনা দেশমে ভি ঘুমনেকো মানা হে ক্যায়া?
-হাম ভি মজবুর হু। আপকো ডেপুটি কমাণ্ডেণ্ট সাহাব নে লে আয়া।
-ইয়ে আপকা ইলাকা। আপকা পাস অটোমেটিক আর্মস ভি হে। আউর ইধারসে ভাগনে কা কৌশিশ করনা নাম উনকিন। জরা হল্কেসে পকড়ৌ।
-বফল মাত কিজিয়ে।
ঘুরপথে প্রায় শখানেক মিটার যেতেই নজরে এল বামপাশে একটা মাঠে বি এস এফ জওয়ানরা ভলিবল খেলছে। আর ডানপাশে চেকপোষ্ট।
লম্বা এক সেলাম ঠুকে সীপাহীদের একজন বলল-
-ডেপুটি কমাণ্ডেণ্ট সাহাব নে ভেজা হে। আউর ইনকো আভি ছোড়নে কে লিয়ে মানা কিয়া।
-ঠিক হে।
সীপাহী দুজন আবার সেলাম ঠুকে চলে গেল। এটা গোজাডাঙ্গা চেকপোস্ট। চার পাঁচজন বি এস এফ জওয়ান ভিতরে বসে আছে। ওদেরই একজন বলল-
-আও। আও। আপকে লিয়ে তো ইন্তেজার হে।
বুঝতে পারছি চরম ঝামেলায় পড়ে গিয়েছি। মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আপাতত সময় কাটাতে হবে। কারন তা না করলে শারীরিক আক্রমনের শিকার হওয়ার কোন বিকল্প নেই। কারন আইনের দৃষ্টিতে আমি ভারতে অবৈধ।
তবে মওকা বুঝে সত্যটা বলতেই হবে। এরা যা সন্দেহ করেছে তার উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত জেরা চলতেই থাকবে। আর সে সাথে যোগ হবে ভোগান্তি।
-ক্যায়া নাম হে আপকা?
-শঙ্কর।
-কাহা পর রহনে ওয়ালা?
-কোলকাতা।
-কোলকাতা মে কাহা?
-দমদম।
-এম এল এ কা নাম ক্যায়া হে?
-রেখা গোস্বামী।
ভাগ্য ভাল। নামটা জানা ছিল। দুদিন আগের আনন্দবাজারে পড়েছি।
-স্যার। আপ বুড়া না মানে তো এক বাত পুছু?
-পুছিয়ে।
-হাম ভারত কা নিবাসী হু। আউর বশিরহাট ভি ভারত কি বীচ মে। তো মুঝে ইয়াপর লে আনে কা জরুরত ক্যায়া থা?
-বাত এহী হে। আভি সীমা কা স্থিতি আচ্ছা নেহী। ইসিলিয়ে যো ভি জিরো পয়েণ্ট পর হোগা, সাথ মে আইডি জরুর রাখনা চাহিয়ে। মেরা সাথ আইয়ে।
চারপাশে উঁচু প্রাচীর দেওয়া চতুষ্কোণ একটা জায়গা। যার তিন পাশে টালির ঘর। মাঝখানে বড় একটা আঙ্গিনা। আঙ্গিনার ঠিক মাঝখানে বেশ বড় একটা শাল গাছ। গাছটার চারপাশে দশ ফুট চওড়া সিমেণ্ট পালিশ করা দুই ফুট উচ্চতার একটা বেদী। আমাকে সেই বেদীর উপর বসতে বলে টু স্টার লাগানো মিথিলেশ জয়সোয়াল সামনের একটা ঘরে প্রবেশ করল।
বেদীর এক পাশে একজন সেণ্ট্রি বছর পচিঁশেক লুঙ্গী পরিহিত এক যুবককে চেক করছে। আর হিন্দিতে সমানে প্রশ্ন করছে। ছেলেটার মনে হয় হিন্দি জানা নেই। আর তাই বোধগম্য না হওয়ায় বেশীর ভাগ প্রশ্নেরই এলোমেলো উত্তর দিচ্ছে। বারবার জিজ্ঞেশ করেও প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পেয়ে সেণ্ট্রি ছেলেটার গালে বেশ জোরে চড় কষাল। ছেলেটা চড় খাওয়া গালে হাত দিতেই অন্য গালে আরেক চড়। এবার ছেলেটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে উঠল-
-মারছেন কেন? আমি তো বলছি আত্মীয় বাড়ীতে বেড়াতে যাচ্ছিলাম।
বুঝতে পারছিলাম। ছেলেটা বেশ শক্ত ধাতের। সেণ্টিটা ওকে ছেড়ে বাইরে চলে গেল।
-কি নাম ভাই আপনার?
-বশির। আপনাকে কেন নিয়ে এসেছে?
-বিনা পাসপোর্টে বাংলাদেশ যাচ্ছিলাম। আপনি কি করেন?
-এখানকার পণ্য বাংলাদেশে পৌঁছে দিই। আর বাংলাদেশের পণ্য এখানে নিয়ে আসি। ধরেছে ঠিকই। তবে আজ সাথে কোন মালামাল নেই। প্রমাণ করতে পারবে না।
মিথিলেশ অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞেশ করল-
-আপ জরা ইধার আয়ে তো।
কাছে যেতেই আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন-
-সাচ বাতায়ে। আপ কাহাসে আ রাহা আউর কাহা যা রাহা থে?
-বাতা দেঙ্গে। লেকিন বুড়া মাত মানিয়েগা। হাম বাংলাদেশ কে নিবাসী। মেরে এক দোস্ত নোকরি দেনে কো সিলসিলা মে মুঝে নেপাল লে গ্যয়া। নোকরি তো দিয়া নেহী। মেরা সাথ যো রুপেয়া থা ব্যাগ লে কর ভাগ গ্যয়া। ব্যাগ মে মেরা পাসপোর্ট ভি থা। আভি আপনা দেশমে যানে কা কোই লিগ্যাল তরিকা নেহী। তো মে ক্যায়া করু?
মিথিলেশের হাবভাব দেখে মনে হল আমার কথা সে বিশ্বাস করেছে।
-ঠিক হে। উধার বেঠিয়ে।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে একে একে আরো তিনজনকে ধরে নিয়ে এল। বশির জানাল ওদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর যে লোকটা রয়েছে, সে সীমান্তে মানব পারাপার করে। বি এস এফকে সে গোলক নামে পরিচয় দিল। সে সত্য বলছে না। আর বি এস এফ ও তার কথা মানতে রাজি নয়। আর তাই খানিক পর পর জওয়ানরা এসে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগল। সে সাথে শারীরিক শাস্তি।
দুপুরের ঠিক আগে পরেশ ও ডেপুটি কমাণ্ডার রাকেশ সিং ক্যাম্পে এল। বেদীতে এক নজর বুলিয়ে যে যার রুমে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পর রাকেশ সিং বেরিয়ে এসে হাত ইশারায় আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেশ করল-
-মিথিলেশ। ইয়ে আদমী কুছ বাতায়া ক্যায়া –বাংগাল কি আদমী। বাংলাদেশ যা রাহা থা। বিস্ময়ে রাকেশ সিং য়ের ভ্রু কুঁচকে গেল। আক্রমনের ভঙ্গিতে আমাকে বলল- -ঝুট কিউ বোলা থা? -মাপ কিজিয়ে সাব। ডর গ্যায়া থা। পাশ থেকে পরেশ বলে উঠল- –মুঝে এক বাত সমঝ নেহী আ রাহা হে স্যার। ইতনা আচ্ছা হিন্দি ইয়ে ক্যাসে বোল রাহা হে? রাকেশ সিং বেদীর দিকে তাকিয়ে বলল- -বারিশ আ সেকতা। ইহা সে চার আদমী লে কর মন্দির মে তেরপাল লাগা দো। নেহী তো শ্যাম মে ভজন করনা মুশকিল হোগা। দুজন সেণ্ট্রি আমাদের পথ দেখিয়ে টালির ঘরগুলোর পেছনে নিয়ে গেল। সেখান থেকে তেরপাল, বাঁশ ও দড়ি নিয়ে বাউণ্ডারী ওয়ালের বাইরে মন্দিরে চলে এলাম। কালি মন্দির। বেশ সুন্দর মা কালীর প্রতিমা। মন্দির চাতালে এ্যাংগেলের উপর আড়াআড়ি ভাবে শক্ত করে বাঁশ বেধেঁ তার উপর তেরপাল লাগিয়ে দিলাম। দেবীর দিকে সঠান শুয়ে মুখে জয় মা কালি বলে মনে মনে ভক্তি ভরে বললাম –
-হে মা জগৎ জননী। এ যাত্রা উদ্ধার কর মা।
বিকেলের দিকে হঠাৎ বি এস এফ ক্যাম্পে সাজ সাজ রব উঠল। উপস্থিত জওয়ানরা পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম পরে তৈরী হয়ে রইল। অল্পক্ষণ পরে বাইরে একটা গাড়ি এসে দাড়াতেই সবাই তটস্থ হয়ে উঠল। বোঝায় যায় উধ্বতন পদস্থ কোন কর্মকর্তা এসেছেন। সেণ্ট্রিদের দিকে ফিরে মিথিলেশ বলে উঠল-
-মেজর সাহাব আ গ্যায়া। প্যারেড কা তৈয়ারী কর।
লাল গালিচার উপর ভারি পদ বিক্ষেপে মেজর সাহেব এগিয়ে এলেন। বি এস এফ কর্মকর্তারা সামরিক মর্যাদায় মেজরকে অভিবাদন জানাল। ওদের কথাবার্তায় জানতে পারলাম। কেন্দ্রের নির্দেশে সীমান্তে কড়া পাহাড়া বসিয়েছে বি এস এফ। এই তল্লাটে মোট বত্রিশটি চৌকি মেজর তদারকি করেন।
অফিসিয়াল কাজ শেষ। আমাদের দিকে ফিরে মেজর বলে উঠলেন –
-স্রিফ ছে আদমী। ক্যায়া হাল হে ইন লোগ কো?
মিথিলেশ নীচু স্বরে কিছু বলল। মেজর সোজা গোলকের দিকে হেটে গেলেন।
-নাম ক্যায়া হে তেরা?
-স্যার। গোলক।
-সাচ বাতা। তু দালাল হে ক্যায়া?
-না স্যার। বোনের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলাম।
-ইনকো মাত ছোড়ো। রাত মে থেরাপি দিজিয়েগা।
মেজর চলে গেলেন। সূর্য্য ও অস্তাচলে। খানিক পরে প্রকৃতির বুকে অন্ধকার নেমে এল।
বাম পাশে টালির ঘরগুলোর পেছনের বাঁশ ঝাড় থেকে লাফিয়েই যেন চাঁদটা বেরিয়ে এল। ওদিকে মন্দির প্রাঙ্গনে উচ্চ স্বরে ভজনের সাথে সাথে সারাদিনের কর্মক্লান্ত বি এস এফ জওয়ানদের মদিরা সহযোগে উদ্দাম নৃত্য শুরু হল।
ঘণ্টা খানেক পরে ভজন শেষ হতেই শিউচরণ নামে একজন জওয়ান এল। দু চোখের মণি টকটকে লাল। এক এক করে প্রত্যেকের নাম জিজ্ঞেশ করছে। আর নাম শুনে সপাটে চড়। বুঝলাম এবারে আর রক্ষে নেই।
পালা ঘুরে শিউচরণ আমার দিকে এল।
-নাম ক্যায়া হে তেরা?
-স্যার। ম্যা হিন্দু হু। মেরা নাম শঙ্কর।
-ইহাঁ কিউ আয়া?
-বিন পাসপোর্ট বাংলাদেশ যা রাহা থা।
জবাব শুনে ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করল।
-মাত মারো স্যার। ইতনা বড়া ঘুষা মারোগে তো বাচেগা নেহী।
স্মিত হেসে বলল –
-তু হিন্দু হে। তুযে নেহী মারেঙ্গে।
বশির ও নাম বলার পর চড় খেল। কিন্তু গোলকের কপালে দুঃখ আছে। চারজনের সেবা ও একাই নিল।
-বশির ভাই। আমাদের ভাগ্যে কি আছ কে জানে।
-মনে হয় রাত আরো গভীর হলে আড়ালে নিয়ে জানে মেরে দেবে।
-আচ্ছা যদি আমাদের ছেড়ে দেয়, বাংলাদেশ পৌঁছব কি করে?
-সে নিয়ে ভাববেন না। বাংলাদেশ সীমান্ত আমার ভাল জানা আছে। একবার যদি পৌঁছতে পারি
অসুবিধে হবে না।
রাত বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে সব শুনশান হয়ে পড়ল। শুধু মাঝে মাঝে সেণ্ট্রিদের হাঁকডাক ও বাঁশীর শব্দ শোনা যেতে লাগল। বি এস এফ অফিসের বাইরের ঘণ্টাটা রাত দশটার জানান দিল।
চন্দ্রালোকিত রাতের পূর্ণিমার আলোয় উঠোনের মাঝে বিছানো আরাম কেদারায় এসে মিথিলেশ জম্পেশ করে বসে পড়ল। সামনে ত্রিপয়ের উপর সেণ্ট্রি বোতল, বরফ ও চিকেনের প্লেট সাজিয়ে দিল। বোতলের ভিতরে সাদা রংয়ের পানীয় ভোদকা বলেই মনে হল।
সেই কোন সকালে প্রাতঃরাশ করেছি। তারপর থেকে পেটে কিছু পড়েনি। চিকেন দেখে পেট ক্ষিধেয় মোচড় দিয়ে উঠল। কিন্তু কিছু বলার সাহস পেলাম না। শুধু বিড়ালের মত আড়চোখে মিথিলেশের খাওয়া লক্ষ্য করতে লাগলাম।
খেতে খেতে সেণ্ট্রির সাথে মিথিলেশ আয়েশী ভঙ্গিতে নানা আলাপ করতে লাগল। আর মাঝে মাঝে চিকেনের প্লেট থেকে চিকেন নিয়ে সেণ্ট্রিকে দিতে লাগল।
ঠিক রাত বারোটায় মিথিলেশ উঠে দাড়াল।
-মেরা সাথ চলো।
বশির, শরীফ, নিজাম ও আমি মিথিলেশের পিছনে পথ চলা শুরু করলাম। ক্যাম্পের বাইরে পীচ বাধাঁনো পথ। এ পথটা নতুন। সকালে এই রাস্তায় আসিনি। পথ চলছিলাম। আর সুযোগ বুঝে নানা আলাপ করছিলাম মিথিলেশের সাথে। মদিরা ও ঠাণ্ডা হাওয়ায় তার মেজাজ তখন বেশ ফুরফুরে।
-স্যার। আগর হাম পাসপোর্ট মে আয়েঙ্গে তো কোই ধীক্কত তো নেহী?
-নেহী ইয়ার। আজ যো মেজর আয়া থা না উসকি পহেলা যো থা ও বহুত খতরনাক থা। আন অথোরাইজড আদমী কো জিরো পয়েণ্ট মে গোলি করনেকা অর্ডার দিয়া থা। হাম লোক ভি মজবুর। চেইন অব কমাণ্ড। অর্ডার মাননা পড়তা।
-ইয়ে মেজর সাহাব কো নাম ক্যায়া?
-গোবিন্দ সিং।
-আউর পহেলি ওয়ালা মেজর কা নাম?
-ইতনা শাওয়াল কিউ পুছতে হো? ক্যায়া করোগে নাম জান কে? ফির ভি উসকা নাম থা বিষেন সিং।
প্রায় মিনিট বিশেক শান বাধানো পথে চলার পর একটা বাঁকে এসে মিথিলেশ দাড়াল। কোমরে রাখা রিভলভারটা হাতে নিয়ে আমাদের দিকে চেয়ে বলল-
-বাঁয়া তরফ সিধা চলোগে তো বাংলাদেশ পৌঁছ যাওগে। চপ্পল হাত পে লো। বারিশ মে মিট্টি ভিগ গেয়ি। নেহী তো স্লিপ করোগে।
হাতে থাকা টর্চ একবার জ্বলেই নিভে গেল। আর তারপরই বজ্র গম্ভীর স্বরে বলে উঠল-
-মত রুখো। মু মোড়কে মাত দেখো। তুড়ন্ত চলা যাও। ওয়াপস আওগে তো সিধা শমশান।
চাঁদের আলোয় অল্প দূরে কাটা জাতীয় জঙ্গল নজরে এল। অস্পষ্ট স্বরে বশির বলল –
- এবার হয়ত গুলি চালাবে। সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
এদিককার পথঘাট বশির চেনে। তাই প্রথমে সে, তারপর আমি, শরীফ ও নিজাম পথ চলতে লাগলাম। মনের উত্তেজনায় প্রতি পল ঘণ্টা সম মনে হচ্ছে।
বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর বশির থামল। পিছন থেকে গুলির শব্দ শুনতে না পাওয়ায় বুঝলাম আমরা অক্ষত। বশির নীচু স্বরে বলল – - বি এস এফ বাংলাদেশ সীমান্তে আমাদের ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু বি ডি আর জানে না আমরা বাংলাদেশী। আর তাই ওদের চোখে পড়লে অনুপ্রবেশকারী মনে করে গুলি চালাবে।
- তাহলে আমরা বাংলাদেশ পৌঁছব কি করে?
- ওদের চেকপোষ্ট গুলো আমি চিনি। গাছের উপর মাচান বানিয়ে পাহাড়া দেয়। দুয়েকজন অফিসারের সাথে আমার আলাপ আছে। দিনের বেলায় হলে সমস্যা ছিল না। রাতের বেলা তো। ওদের চোখ এড়িয়ে যেতে হবে। কোন অবস্থাতেই আওয়াজ করো না। চুপচাপ আমার পিছন পিছন এসো।
মিনিট পাঁচেক এগিয়ে বশির থামল। সামনে বিশ পঁচিশ গজ খোলা প্রান্তর। তার ওদিকে আবার ঘন জঙ্গল। চাঁদের আলোয় প্রান্তর ধুঁ ধুঁ করছে। বশিরের গলা ভেসে এল –
-প্রান্তর পেরিয়ে নিরাপদ সীমা মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরত্বে।
-থামলে কেন? চল পেরিয়ে যাই। - সাবধানে! বা পাশে দেখ।
গাছের আড়াল থেকে লক্ষ্য করলাম বিশ তিরিশ গজ দূরত্বে গাছের উপর মাচান বানিয়ে হ্যালোজেনের আলোয় কয়েকজন বি ডি আর জওয়ান তাস খেলছে। - এ পথে গেলে ধরা পড়ে যাব। সোজা গুলি চালিয়ে দেবে।
- তাহলে উপায়! যাবার অন্য কোন পথ কি নেই?
- আবার পিছন ফিরে ঘুরপথে দুই কিলোমিটার মত যেতে হবে।
কয়েক গজ পিছনে গিয়ে শুরু হল জঙ্গলের মধ্যে পথচলা। কিছুদূর যেতেই দুপাশে দুটো জলাশয়। জলাশয় দুটোর মাঝখানে ফুট খানেকের মত একটা আল রয়েছে।
এদিকটায় মনে হয় ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। চাঁদের আলোয় বুঝতে পারছিলাম আলটা কাদাঁয় প্যাঁচ প্যাঁচ করছে। বশিরের গলা ভেসে এল – - জলাশয় গুলো খুব গভীর। বড় বড় আফ্রিকান মাগুরের চাষ হয় ওখানে। পা হড়কিয়ে যদি একবার পড়ে যাও পাঁড়ে উঠার আগে ঘায়েল হয়ে যাবে।
জলাশয় পেরিয়ে যেতেই আবার সেই জঙ্গল। ঘন গাছপালার কারনে চাঁদের আলো এখানে ম্লান। বেশ কিছুক্ষণ হাটার পর জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে জ্যোৎস্না প্লাবিত পীচ রাস্তা নজরে এল। হাত ইশারায় থামতে বলে নীচু স্বরে বশির বলল – - ওই রাস্তাটা পেরোলে বর্ডার এলাকা শেষ। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। বি ডি আর এর টহল টিম রয়েছে কিনা নিশ্চিত না হয়ে পার হওয়া যাবে না।
মিনিট দশেক কোন সাড়া শব্দ নেই। একটু পরে সার্চ লাইটের আলোয় চারপাশ সতর্ক নজরে দেখতে দেখতে একটা জিপ আমাদের সামনের রাস্তায় পেরিয়ে গেল। গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যেতেই আবার বশিরের গলা ভেসে এল – - বি ডি আর এর টহল টিম। চল এগিয়ে যাই।
জঙ্গলের আড়াল ছেড়ে রাস্তায় এসে দুদিকে তাকালাম। চারপাশ একেবারে নীরব নিস্তব্ধ। হঠাৎ বশির রাস্তার অন্য পারে দৌড় দিল। বশিরের পেছন পেছন আমরা তিনজনই প্রাণপণ দৌড় দিলাম।
আমাদের দৌড়তে দেখে রাত পাহাড়ার কুকুর দল ঘেউ ঘেউ শব্দে তেড়ে এল। রাস্তা পেরিয়ে অন্য প্রান্তে ঘন গাছ গাছালির মধ্যে গিয়ে থামলাম। বশির বলে উঠল – - বর্ডার এলাকার এখানেই শেষ। আর কোন ভয় নেই।
সমাপ্ত