Pulak Majumder 

পুলক মজুমদার (1)

চেনামুখ অচেনা পরিচয় – ১

পুলক মজুমদার

কদিনের টানা বর্ষণে শহর নগর গ্রাম তলিয়ে দিয়ে বৃষ্টির ফুরসৎ মিলল সাময়িক অবসরের। অবশ্য এখনো আকাশ কালো মেঘের আনাগোনায় বেশ সরব। লাগাতার বৃষ্টির প্রথম দিন অফিস থেকে বাড়ী ফিরতে গিয়ে জলে ভিজে একাকার। পরের দিন সকালে স্ত্রীর ডাকে ঘুম ভাঙ্গল।
-কিগো অফিস যাবে না।

স্ত্রীর কথা কানে গেলেও উত্তর দেওয়ার সামর্থ্য কুলাল না। গায়ে যেন লক্ষ ফোঁড়ার ব্যথা। সাড়া না পেয়ে মনিকা কাছে এসে আমার কপালে হাত দিতেই চমকে উঠল।
-সেকি! জ্বরে যে গা পুড়ে যাচ্ছে।

ডাক্তারের ব্যবস্থা মত ঔষধ সেবন করে এখন মোটামুটি সুস্থ। সকাল থেকে আর জ্বর আসেনি। তাছাড়া নিয়মিত পথ্য ও বিশ্রামে শরীরে খুব আরাম বোধ হচ্ছে। শেষ বিকেলের মরা আলোয় বাইরে বেরোবার উদ্যোগ নিচ্ছি ঠিক সেই সময় বেয়ারা এসে জানান দিল –
-বাবু। একজন লোক দেখা করতে এসেছে।
-কি নাম জিগ্যেস করেছ !
-আজ্ঞে। নাম বলল যতীন।
নাম শুনে প্রথমটায় চিনতে পারলাম না। মাথায় বাড়তি কোন চাপ না নিয়ে বেয়ারাকে বললাম –
-ড্রয়িং রুমে বসাও, আমি আসছি।

কে আবার এল এই বিকেলে ভাবতে ভাবতে খানিকবাদে ড্রয়িং রুমে এসে বিস্ময়ে আমার চোখ কপালে উঠল। আমার স্কুল জীবনের বন্ধু।
-আরে বীরেশ না! তবে যে বেয়ারা অন্য নাম বলল।
-আমিই তাকে ঐ নামটা বলেছি।
-কথায় আছে না স্বভাব যায় না মরলে। তোরও ঐ এক অবস্থা। মাঝে মাঝে এমন এক একটা কান্ড করে সবাইকে চমকে দেওয়ায় তোর স্বভাব ছিল। তা মানিক চাঁদ। এতদিন পর কোথা থেকে উদয় হলে।
-গত পরশু রাজধানীতে এসেছি। পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করলাম। জয়প্রকাশের কাছ থেকে তোর বর্তমান ঠিকানাটা নিয়ে সোজা দেখা করতে চলে এলাম।
বীরেশের কথা শেষ হওয়ার আগেই কলিং বেলটা বেজে উঠল। হাঁক দিয়ে বললাম –
-সুখেনদা। দেখতো আবার কে এল !

সুখেনদা চলে গেল দরজা খুলতে। বীরেশ তেমনি মুচকি মুচকি হাসঁছে।
-কিরে হাসছিস কেন ?
বীরেশ কোন জবাব দিল না। একটু বাদে বেয়ারার সাথে জয়প্রকাশ ও সৌরভ এসে পড়ল।
-ও তাহলে এই ব্যাপার! সবাই পরিকল্পনা করে এসেছ! শুধু একজন নেই। সৃজন।
-হ্যাঁরে। তার কথা মনে এলেই ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়। মৃত্যুর দুদিন আগে আমার দোকানে এসেছিল। খুব ভিড় ছিল তখন দোকানে। আমার দিকে চোখ পড়তেই বলল –
-জয়। একটু বাইরে আসবি। একটা কথা ছিল।
-দাড়া আসছি।
বলেছি বটে। তবে কাস্টমারের নানান প্রেসক্রিপশনের ভীড়ে সৃজনের কথা ভুলে গেলাম। যখন খেয়াল হল দেখি সৃজন চলে গেছে। আর এর দুদিন পরেই শুনলাম ও মারা গেছে। কি যে বলতে এসেছিল!
জয়প্রকাশের চেহারায় ফুটে উঠল বিষন্নতার ছাপ।
-তা সেওতো প্রায় বাইশ বছর হয়ে গেল। সত্যি খুব ভাল বন্ধু ছিল।
জীবিকার চাপে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ করার অবকাশ নেই বললেই চলে। জয়প্রকাশ ও সৌরভের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয় বটে। তবে বীরেশের সাথে দেখা হল প্রায় দুই যুগ পর।

শ্বশুরের হার্টের অসুখ ধরা পড়েছে। আর তাই মনিকা সকালেই বাপের বাড়ীতে গিয়েছে। ফিরবে কয়েকদিন পর।
রাত্রে আহারাদির পর বাগানের লাগানো বারান্দায় বসলাম। সুখেনদা কফি দিয়ে গেল। একজন জজ হিসেবে পেশাগত জগতে নানান রুচি ও পেশার লোক দেখতে দেখতে প্রায় জীবন সায়াহ্নে এসে পড়েছি। নানা কথার ফাঁকে লক্ষ্য করলাম বীরেশ কেমন যেন আনমনা। কিছু যেন বলতে চাইছে। কিন্তু মন স্থির করতে পারছে না। সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে দিতে বীরেশের দিকে ফিরতেই সে বলে উঠল –
-শঙ্কর। তোকে কিছু বলার ছিল।
-হ্যাঁ। বল বীরেশ।

-দেখ তোরা আমার খুব ভাল বন্ধু। যদিও নানান ব্যস্ততায় অনেকদিন দেখাশোনা নেই। কিন্তু একটা বড় সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে গিয়ে প্রথমেই তোদের কথা মনে পড়ল।
ব্যাপারটা গুরুতর বুঝতে পারছি। কিন্তু বেশ হালকা মেজাজে জিজ্ঞেস করলাম –
-নিসঙ্কোচে বল। পুরো রাত সামনে পড়ে আছে। বউ বাড়িতে নেই মানে আজ আর তাড়া দেওয়ার কেউ নেই।
-এতক্ষণ ধরে কত কথা আলাপ করেছি। কিন্তু কৈ একবার ওতো জিজ্ঞেস করলি না পরিবার নিয়ে কেমন আছি।
-আসলে হয়েছে কি জানিসতো। ছেলেবেলার নানান কথার ফাঁকে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। তা বল ভাই।
-ঘরোয়া নানান ঝামেলায় বিয়ে করেছি অনেক দেরীতে।

-ঝামেলা কেন বলছিস। শহরের উপর পৈত্রিক বাড়ী। যতদূর জানি তোরা দুই ভাই। আর বড় বোনদের সেই কবে ভাল সমন্ধ করে বিয়ে হয়ে গেছে।
-হ্যাঁ। চিত্রটা বাইরে থেকে তা বটে। তবে নিশ্চিত নিরাপত্তায় আমাদের জন্য কাল হল।
-মানে। কি বলছিস?
-শুন তাহলে।

(ক্রমশ)

Leave a Reply