
রামপ্রসাদ সেন
হালিশহরের গঙ্গা। ঘাটের ধারে অসংখ্য মানুষ ঘিরে দাঁড়িয়েছেন তাঁকে। ভাসমান নৌকার মাঝি-মাল্লারাও অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছেন তাঁর দিকে। তিনি কিন্তু ভ্রুক্ষেপহীন। আপনভাবে তন্ময় হয়ে গেয়ে চলেছেন একের পর এক গান। চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে।
“এমন দিন কি হবে তারা
যবে তারা তারা তারা বলে
তারা বেয়ে পড়বে ধারা”।
শোনা যায়, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করবেন বলে নদীয়া যাত্রার পথে তিনি একবার বাঁশবেড়িয়ার কুখ্যাত বুধো ডাকাতের হাতে পড়েন। নরবলি দেওয়ার জন্য ডাকাত সর্দার যেই না তাঁকে হাঁড়িকাঠে ফেলে মাথার উপর খড়গ তুলে ধরেছেন অমনি তিনি গান ধরলেন-
“তিলেক দাঁড়া ওরে শমন
বদন ভরে মাকে ডাকি।
আমার বিপদকালে ব্রহ্মময়ী,
আসেন কিনা আসেন দেখি”।
এরকম অজস্র মিথ ছড়িয়ে রয়েছে যে মানুষটিকে ঘিরে,তিনি সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন।
কেবল আসার আশা ভবে আসা
আসা মাত্র হলো সার…
কবি ঈশ্বর গুপ্ত প্রদত্ত তথ্য অনুসারে,১৭২০-২১ খ্রিস্টাব্দে চব্বিশ পরগনার হালিশহরের কুমারহট্ট গ্রামে রামপ্রসাদ সেনের জন্ম। পিতা রামরাম সেন ছিলেন প্রসিদ্ধ বৈদ্য। কবি নিজেও ছিলেন চার সন্তানের জনক। শৈশব থেকেই তাঁর মধ্যে কাব্য রচনা ও ভাষা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ছিল। তান্ত্রিক যোগী ও পন্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের কাছে কবি তন্ত্রসাধনা ও শক্তিসাধনায় দীক্ষিত হন । এই দীক্ষাই তাকে সংসারে থেকেও নিরাসক্ত করে তোলে।১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে কালীপুজোর অমাবস্যায় নিজের হাতে প্রতিমা গড়ে পুজো অর্চনার পর দেবীকে গঙ্গায় বিসর্জনের সময় নিজেও প্রাণবায়ু ত্যাগ করেন।
এমন মানবজমিন রইল পতিত
আবাদ করলে ফলত সোনা…
অনটনের সংসার। রামপ্রসাদ মুহুরির কাজ নিলেন গরানহাটার জমিদার দুর্গাচরণ মিত্রের কাছে। কিন্তু হিসাবের খাতা জুড়ে শুধুই গান। জমিদার বাবুর কাছে খবর গেল। তিনি বুঝলেন রামপ্রসাদকে। মাসিক ৩০ টাকা বৃত্তির ব্যবস্থা করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন তাঁকে। শুরু হলো পঞ্চবটীর তলে পঞ্চমুন্ডির আসনে মাতৃসাধনা। মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদের বিশেষ গুণগ্রাহী ছিলেন। কবিরঞ্জন উপাধি তিনিই দান করেন। প্রায় ১০০ একর নিষ্কর ভূমি দান করেন কবিকে। বিদ্যাসুন্দর কাব্যটি কৃষ্ণচন্দ্রের অনুরোধেই কবিরঞ্জন রচনা করেন। এছাড়াও কালীকীর্তন, কৃষ্ণকীর্তন ও অসংখ্য শক্তিগীতি রামপ্রসাদ সেন বাঙালিকে দিয়ে গিয়েছেন।
মজিল মন-ভ্রমরা কালীপদ নীলকমলে…
‘এবার আমার উমা এলে/আর উমা পাঠাবো না’-মত কিছু কালজয়ী আগমনী-বিজয়া পর্বের গান উপহার দিলেও তাঁর প্রতিভা মূলত ভক্তের আকুতি পর্যায়ের শ্যামাসংগীত গুলোতে বেশি জ্বলে উঠেছে। তান্ত্রিক সাধকদের শ্মশানচারী শ্যামাকে বাঙালি মায়ের স্তরে নামিয়ে আনার মূল কৃতিত্ব রামপ্রসাদের। ইষ্টদেবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক যেন মাতা- পুত্রের। কখনো ঝগড়া, কখনো মান অভিমানের উষ্ণতায় সে সম্পর্ক জীবন্ত।
“ মা আমায় ঘুরাবি কত
কলুর চোখ বাঁধা বলদের মতো”।
মরলেম ভূতের বেগার খেটে…
অষ্টাদশ শতক বাংলার ইতিহাসে পালাবদলের যুগ। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, বর্গী হামলা, মুঘল রাজবংশের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণহীনতা-সব মিলিয়ে এক টালমাটাল অর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। সাধারণ মানুষের জীবন বৈষম্য ও যন্ত্রণাদীর্ণ। যুগের কবি ভারতচন্দ্র রায় গুনাকরের কবিতায় যেখানে উঠে এসেছে বাঙ্গালীর অন্নচিন্তা চমৎকারাদশা-‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে' রামপ্রসাদ সেখানে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার-
“কেউ যায় মা পাল্কি চড়ে,
কেউ তারে কাঁধে করে।
কেউ গায়ে দেয় শাল দোশালা
কেউ পায় না ছেঁড়া ট্যানা”।
ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়
মিছেই ভ্রম ভূমন্ডলে…
সহজ সরল আটপৌরে ভাষায় জীবনের গভীর উপলব্ধি জাত দর্শনকে ছেঁকে তুলে আনায় রামপ্রসাদ সেন অপ্রতিদ্বন্ধী। কীর্তন, বাউল, লোকসংগীত এবং মার্গ সঙ্গীতের মৃদুমিশেলে প্রসাদী সুর বাংলা সংগীত জগতে একটা নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেছে। পরবর্তী ৩০০ বছর ধরে যা অনুসৃত। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম ছুঁয়ে পান্নালাল ভট্টাচার্য, রামকুমার চট্টোপাধ্যায় হয়ে আজকের অনুরাধা পাড়োয়াল কিংবা অজয় চক্রবর্তী কেউ তাঁকে এড়িয়ে যেতে পারেননি।
সময় তো থাকবে না মাগো
কেবলমাত্র কথা রবে…
এক ভক্তের হৃদয় নিংড়ানো আকুতি বাঙালির নিজস্ব বাক্ রীতিতে প্রকাশ পেয়েছে প্রসাদী গানগুলিতে। 'কলুর বলদ’, ‘ভবের গাছ’, ‘তবিলদারি’, ‘নিমক হারাম' ডিক্রিজারি, কালেক্টর মত ইংরেজি, ফার্সি কিংবা খাঁটি দেশজ শব্দে ভরপুর তাঁর কবিতাগুলি যেন যুগচিহ্নকে ধারণ করে রয়েছে শরীরে। মায়ের কাছে সন্তান যেভাবে নিজের হৃদয়কে হাট করে তুলে ধরে, সেভাবেই নিজের অভাব অনুযোগের ঝাঁপি মেলে ধরতেই জীবনের টুকরো টুকরো চালচিত্র উঠে এসেছে। যা কেবল সাধক কবির গীতি কবিতা নয় বৃহদার্থে তা ‘মাস সঙ'। সেই জন্যই বোধ হয় কয়েক শতাব্দী পরেও প্রসাদী গানের সঙ্গে আমরা এত একাত্মতা অনুভব করি। সহজীয়া রসে জারিত করে তিনি যখন বলেন;‘এই সংসার ধোঁকার টাটি/ও ভাই, আনন্দ বাজারে লুটি’ তখন একবারও কি মনে হয় এই গান কোন বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাধন সঙ্গীত? নাকি এ আমার তোমার সবার কথা !!
১৪-১০-২০২২। স্বনন্দিনী।
তথ্যসূত্র: বাংলা সাহিত্য পরিচয়
ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়
উইকিপিডিয়া
Darun