গল্প : হারজিত -রণেশ রায়

রণেশ রায়

গল্প : হারজিত -রণেশ রায়

স্কুল শুরু হয়েছে অনেক্ষণ। টিফিনের পর এটা পঞ্চম ক্লাস। সুপ্রিয় অষ্টম শ্রেণীতে ভৌতবিদ্যার ক্লাস নিতে শুরু করেছেন। তিনি অত্যন্ত দক্ষ শিক্ষক। খুব বেশিদিন স্কুলে না এলেও অল্পদিনের মধ্যেই ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। আজ কিভাবে বাধের জল থেকে জলবিদ্যুত সৃষ্টি হয় তাই পড়াবেন। মূল বিষয়ে  যাওয়ার আগে আজ বিজ্ঞানের অগ্রগতির ওপর কিছুটা বলে নেন। তিনি বলেন যে আজ আর মানুষ প্রকৃতির দাস নয়। সে প্রকৃতিকে জয় করেছে । বাধ দিয়ে নদীর জলকে বেধেছে। বাধা জল থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করছে। আমাদের ঘরের অন্ধকার দূর হয়েছে, সেই বিদ্যুতে কারখানা চলছে, চাষিরা পাম্প চালায়, বাধ থেকে সেচের জল আসে।

বলতে বলতে উনি লক্ষ্য করেন কোণায় বিজয় বলে একটি ছাত্র বাইরের দিকে তাকিয়ে। যেন গ্রাহ্যের মধ্যেই নেই স্যার কি বলছেন। স্যার বিষয়টা দেখলেও তখন কিছু বলেন না। এরপর উনি বোর্ডে এঁকে সহজভাবে বুঝিয়ে দেন কিভাবে বিদ্যুত উৎপাদন  হয়। সবাই মনোযোগ দিয়ে শোনে আর বোর্ড থেকে লিখে নেয়। কারও কোথাও অসুবিধে হলে বুঝিয়ে দেন। কিন্তু লক্ষ্য করেন যে বিজয়ের সে দিকে মন নেই। সে খাতায় আঁকি ঝুঁকি করছে। সুপ্রিয়র কাছে এটা খুবই অস্বস্তিকর ঠেকে। ক্লাসে কাউকে তিনি সেরকম বকাঝকা করেন না। বরং বোঝার চেষ্টা করেন কেন কোন ছাত্র এমন বেআদপ হয়। তিনি ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন কাল যেন সবাই তৈরী হয়ে আসে তিনি পড়া ধরবেন।

 সুপ্রিয় একটু ব্যতিক্রমী শিক্ষকও বলা চলে। ক্লাসে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে আগে আত্মসমীক্ষায় বসেন। বোঝার চেষ্টা করেন তাঁর কোনো ত্রুটি আছে কিনা, কেন ছাত্র আকর্ষণ বোধ করছে  না । সেদিন বাড়িতে এসে আকাশ পাতাল ভেবেও নিজের ত্রুটি খুঁজে পান না। এ অবস্থায় তাঁর রাতের ঘুম চলে যায়। তিনি স্কুলের চাকুরিতে এসেছেন শিক্ষার মাধ্যমে দেশ ও দশের উপকার করবেন বলে। এখনো তিনি শহর থেকে দুঘন্টা বাসে চড়ে স্কুলে আসেন। ছাত্রদের সঙ্গে অল্পদিনের মধ্যেই একাত্ম হয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর ইচ্ছে গ্রামে থেকে গ্রামের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গ্রামবাসীদের  সেবা করবেন। কিন্তু ছাত্রদেরই তিনি যদি কাছে টানতে না পারেন তবে আরও বড় ব্যাপারে তিনি কি ভাবে সক্ষম হবেন! আজকের বিজয়ের ব্যাপারটা তাঁকে যন্ত্রনা দেয়। অথচ বিজয় মনযোগী ভালো ছাত্র. তিনি কিছুটা বিমর্ষ হয়েই রাতে ঘুমোতে যান।এর ফলে রাতের ঘুমে ব্যঘাত ঘটবে তিনি জানেন।শুধু শিক্ষকতার বিষয় নয় যে কোন দায়িত্বের ব্যাপারেই তাঁর এই আবেগটা কাজ করে।

     পরের দিন আবার ক্লাসে আসেন। ছাত্রদের পড়া ধরার পালা। সবছাত্রের সঙ্গে বিজয়কেও প্রশ্ন করেন। বিজয় প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেয়। অনেকেই উত্তর দিতে গিয়ে আটকে গেলেও বিজয়কে অনেক সপ্রতিভ বলে মনে হয়। বিষয়টা ভালই আত্মস্থ  করেছে। সারাক্ষণ অস্বস্তির মধ্যে কাটিয়ে ঘন্টা পড়তেই সুপ্রিয়বাবু ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। তাঁর কাছে এটা পরাজয় বলেই মনে হয়। বিজয় পড়া না পারলে তার ক্লাস করাটা কতটা জরুরি প্রমান হত। আর বিজয়ের মনোযোগ ফেরাতে তিনি উপদেশ দিতে পারতেন। সুপ্রিয় বাবুর নিজের ওপরই বিদ্বেষ তৈরী হয়। তাঁর জেদ চেপে যায় ব্যাপারটার গভীরে যাওয়ার। মনে হয় বিজয় যদি বেয়াড়াই হত তবে এভাবে পরিশ্রম করে পড়া তৈরী করে আসত না। তাতে স্যারের এই যন্ত্রনার অনুভুতিটা হত না।   

      এর পরের ক্লাসেও বিজয় একই রকম অন্য মনস্ক। মনে হয় যেন স্যারকে অসন্মান করার জন্যই তার এই আচরণ। সুপ্রিযর  মনে হয় ওর বাড়ির পয়সা আছে তাই কয়েক গন্ডা শিক্ষকের কাছে বাড়িতে পড়ে, ক্লাসের পড়াকে তোয়াক্কা করে না। আর বুদ্ধির অভাব নেই বলে ওভাবে অবলীলায় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। সুপ্রিযর  কাছে এই পয়সা আর বুদ্ধির মিলনে যে অহংকার তা অসহ্য। তিনি মনে মনে বিজয়ের ওপর ভয়ানক অসন্তুষ্ট হন। এর একটা বিহিত দরকার বলে মনে করেন। বিজয় তাঁর কাছে এক প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। বরং বিজয় যদি আর পাঁচজনে ক্লাসে পড়া না করা ছেলের মত দুষ্টু ছেলে হত তবে তা সুপ্রিযর  যন্ত্রনার কারণ হত না । তাদের রুটিন মত শাস্তি দিলেই হয়ে যেত। এরকম কর্তব্যের বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হত না। তার পড়ানোয় কোন ত্রুটি আছে এই যন্ত্রনায় তাকে ভুগতে হত না। তিনি ঠিক করেন যে করেই হোক বিজয়কে বশ করবেন।

        স্যার তাঁর কয়েকজন প্রিয় ছাত্রের  কাছে জানতে পারেন যে বিজয় খুবই গরিব ঘরের ছেলে। বাড়িতে মাষ্টার রাখা দূরের কথা   কম পয়সায় কোচিং-এ যাবার সামর্থ তার নেই। এটা জেনে সুপ্ৰিয়বাবুর মনে হয় তাঁর দায়িত্ব বেড়ে গেল। মনে হলো ছেলেটি খুবই মেধাবী একই সঙ্গে অহংকারী। এই অহংকার-ই  ছেলেটির সর্বনাশ্ করবে । গরিব ঘরের ছেলের এই অহংকার মেনে নেওয়া যায় না। এরপর জীবনে কঠিন পরিস্থিতির সন্মুখীন হতে হবে। তখন শুধু মেধা দিয়ে জেতা যাবে না। পরিশ্রম করতে হবে। অষ্টম শ্রেণীতে ক্লাস নিতে গেলেই সুপ্রিযৰ মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। একদিকে ওই একরত্তির ছেলেটার কাছে পরাজয় আর অন্যদিকে তার প্রতি কর্তব্য। কখনো মনে হয় ওকে প্রশ্রয় না দিয়ে ওর প্রতি কঠিন হওয়া দরকার। পরক্ষনেই তিনি ভেবে লজ্জা পান যে এটা তাঁর প্রতিহিংসা পরায়নতা। না, সহানুভূতির  সঙ্গে ওর ত্রুটিটা ধরিয়ে দিয়ে ওকে সাহায্য করা দরকার। বয়স কম। ঠিক মত ওর শুশ্রুষা না করলে হিতে বিপরীত হবে। সুপ্রিয়বাবু ওকে আলাদা করে ডেকে ওর সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করবেন বলে ঠিক করেন।

         শনিবার অর্ধ দিবস। সেদিন স্কুল ছুটির পর বিজয়কে আলাদা করে  ডেকে নেন। বিজয়কে বলেন

—–তোমার সমস্যাটা কি বলত

—– না স্যার, কিছু নয়

—– তুমি ক্লাসে এত অমনোযোগী থাক কেন? আমার পড়ানো বুঝতে কি অসুবিধে হয় ?  

—– কি বলেন স্যার। আপনি এত ভালো পড়ান

—– তাই যদি হয় তবে মনোযোগ দেও না কেন

—— না স্যার ভালো লাগে না

—— শুনেছি তোমাদের অভাবের সংসার। সেটাই কি তোমাকে সবসময় কষ্ট দেয়, তাই তোমার এই অমনোযোগ

—— না স্যার।

—— তবে কি? কারনটাতো  খুঁজে পেয়ে তা দূর করতে হবে। আর তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। ভবিষ্যতটা গড়ে তুলতে চাও না সেটাকে নষ্ট করবে

—— সবার মত আমিও তো  বড় হতে চাই । কিন্তু মেলাতে পারি না

—— কি মেলাতে পার না?

—– যা দেখি শুনি আর যা পড়ি তার মধ্যে

—– ক্লাসে পড়ার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক?

—– এইতো  স্যার আপনারা বলছেন মানুষ এখন আর প্রকৃতির দাস নয়। সে প্রকৃতিকে জয় করেছে। আপনি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন বাধের জল থেকে কিভাবে বিদ্যুত উৎপাদন  হয়। কিন্তু বাধের জল ছেড়েইতো আমাদের গ্রামে বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়। এই বাধ-ইতো বৃষ্টির কাছে হার মানে তাই জল ছাড়তে হয়। তবে কি করে বলা চলে যে মানুষ প্রকৃতিকে জয় করেছে ? বাধের জলে বিদ্যুত হয় কিন্তু আমাদের গ্রামে বিদ্যুত নেই। এতবড় সুনামি হয়ে গেল। মানুষ অসহায। তবে প্রকৃতি জয় হলো কোথায়?  মানুষের এই অহংকারটা যে মেনে নিতে পারি না।

          সুপ্রিয় অদ্ভুতভাবে নিরব হয়ে যান। তিনি বলেন

—— তুমি যাও। পরে তোমার সঙ্গে কথা হবে।

          সুপ্রিয় স্যার ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে আসেন। এতদিন তিনি ভেবে নিয়েছিলেন যে বিজয় অহংকারী, তা নয় আমরাই অহংকারী । সেটা আমাদের শিক্ষার অহংকার সভ্যতার অহংকার। তিনি ভেবেছিলেন বিজয়ের কাছে তিনি হেরে গিয়েছিলেন । না তা নয় । আজ-ই তিনি হারলেন। হারলেন ওই একরত্তি ছেলের কাছে নয় নিজের মধ্যে যে মুর্খটা আছে তার কাছে হারলেন।

লেখকের পরিচয় :

বসবাস: কলকাতা পর্নশী নিবাসী

জীবিকা: অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

বয়স: ৭৪

Leave a Reply