
সাহিত্যে কবিতা ও তার বিবর্তন প্রক্রিয়া
রণেশ রায়
উপস্থাপন:
কবিতায় কল্পকথা ও কল্পচিত্র
কবিতার বিবর্তন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনার আগে কবিতা নিয়ে আমার ভাবনাটা সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
কবি এই ব্রহ্মলোক ও সমাজকে প্রত্যক্ষ করলে তার সঙ্গে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় যুক্ত হলে তাঁর মনোজগতে তা প্রতিফলিত হয়, তা তাঁর কল্পনায় ভিন্ন মাত্রা পায়।এক উপলব্ধির জন্ম হয়।এই উপলব্ধিকে সংকেত ও উপমার সাহায্যে ব্যঞ্জনসিক্ত অর্থবহ করে তুলতে পারলে তাকে শব্দাবলীতে কথামালায় সাজিয়ে ছন্দময় করে তুলে তাল লয়ে ভরপুর করে তুলতে পারলে তাকে কবিতা বলা হয়।
কবিতার জন্য কবিতা লেখায় আমি বিশ্বাস করি না। কবির নিজের চেতনা অনুযায়ী ভাবনার ছন্দবদ্ধ কথামালায় রূপান্তরকে আমি কবিতা বলে মনে করি। জীবনকে সঠিক ভাবে বুঝে জীবনবোধকে কবিতায় রূপ দিতে চেষ্টা করা হয় কবিতায়। তাই জীবনের কোলাহল জীবন যুদ্ধ তাকে কেন্দ্র করে যে মনন তারই প্রতিফলন ঘটাবার অবিরাম প্রচেষ্টা দেখা যায় কবির লেখা কবিতায়। এ এমন কোন বিমূর্ত ভাবনার উপস্থাপন হতে পারে না যা কোন অর্থ বহন করে না। যাকে পাঠক যেভাবে বোঝে সেভাবে বুঝবে বলে দায় সারা হয়। বরং আমরা মনে করি কবির নিজের ভাবনা জীবন বোধের যেন ছান্দনিক বিচ্ছুরণ ঘটে কবিতায়। বিমূর্ত ভাবে উপমার সাহায্যে তা পরিবেশিত হলেও যেন তা কবির ভাবনা জীবন বোধ ধরে অর্থবাহক হয়ে ওঠে, কবিকে তাঁর ভাবনা নিয়ে উপস্থিত হতে দেখা যায় পাঠকের দরবারে। এখানে নিজের ভাবনাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করাকে মদত দেওয়া ঠিক নয়। সেটা করলে কবিতা ও কবি এক পলায়নবাদি ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়। কবিতায় নেহাত বিনোদন শেষ কথা হতে পারে না। সাহিত্যের আঙিনায় কবিতার একটা সামাজিক দায়িত্ব থাকে কারণ সাহিত্য সৃষ্টি করা প্রয়োজন সুস্থ্য সমাজ গড়ে তোলায় তার দায়িত্ব পালন করার জন্য।
আমি কবির কল্পকথাকে নেহাত কবির কল্পনার জালবোনা বলে মনে করি না। এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বিষয়টাকে সামগ্রিকতায় বিচার করা দরকার বলে মনে করি। এই সামগ্রিকতা হল এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড যাকে প্রকৃতি বলে জানি, মানব সমাজ আর তার সঙ্গে মানুষের মনোজগত। প্রকৃতি আর মানুষ নিয়ে বস্তুজগত। প্রকৃতিরই অংশ মানুষ তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাঁচে যা তার চেতনায় আলোকিত। সেটা তার মনোজগত। এই মনজগতকে কবি কথায় প্রকাশ করেন ভাষায় লিপিবদ্ধ করেন উপমার সাহায্যে তুলে ধরেন। প্রকৃতি ও মানুষ আন্তঃসম্পর্কে সম্পর্কিত। আবার মানুষে মানুষে সম্পর্ক নিয়ে এই সমাজ। প্রকৃতি মানুষকে নিয়ে এই বস্তু জগৎ বা ভৌত জগৎ। কবি তাঁর ইন্দ্রিয় দিয়ে এই বস্তুজগতকে অবলোকন করেন তার বিবর্তন প্রক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করেন। তাঁর মনোজগতে প্রতিবিম্বিত হয় এই প্রকৃতি এই মানব সমাজ প্রকৃতিকে মানব সমাজকে অবলোকন করার সঙ্গে সঙ্গে। বস্তুজগতের প্রতিফলন ঘটে কবির স্নায়ুজগতে। তাঁর মনোজগৎ উদ্ভাসিত হয়। আবার মনোজগৎ এইভাবে যে বার্তা পায় সেটা তাঁকে উপলব্ধিতে সাহায্য করে। অতীত বর্তমানকালকে তিনি যেভাবে অবলোকন করেন তা তাঁকে জীবনটাকে বুঝতে সাহায্য করে। তাঁর জীবন বোধ তৈরি হয়। তা দিয়ে তিনি কল্পনার মালা গাঁথেন। ভবিষ্যতের দিক নির্দেশ করতে চাযন। এর থেকে সৃষ্টি হয় কল্প কথা যা কবিতার ভাষায় রূপ পায়। ছন্দ তাল লয়ে কবিতায় সেজে ওঠে। অর্থাৎ বস্তুজগত যেমন মনোজগতের ওপর ক্রিয়া করে তেমনি মনোজগৎ প্রকৃতি জগৎ মানব সমাজের দিক নির্দেশ করে তাকে বুঝতে সাহায্য করে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে হাসি কান্না প্রেম ভালোবাসা জীবন যুদ্ধকে বোঝার চেষ্টা করে। এসবই কবির কল্পকথা হয়ে কবিতায় রূপ পায়। সেখানে মনোজগতের প্রকৃতিজগতের ওপর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াটাও গুরুত্বপূর্ন। এখানেই বস্তু জগৎ ও মনোজগতের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটা তাৎপর্যপূর্ণ যা আর বস্তুজগতকে বাদ দিয়ে কল্প কথা থাকে না। কবিতায় উভয় জগতের বিষয়টা মূর্ত হয়ে ওঠে। তা বাস্তব অবস্থা থেকে উঠে এসে কবির কল্পজগতে এক কল্প চিত্র সৃষ্টি করে। কবি আবেগ তাড়িত হয়ে ওঠেন তাঁর ভাবের জগতে তার ভাবনা কবিতা হয়ে ওঠে তাঁর কল্পকথায়। এর সঙ্গে এক কল্প চিত্র সৃষ্টি হয় যা একান্তভাবে কবির সৃষ্টি। একে নেহাত ভাববাদ ভাবা ঠিক নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি কবিতা লেখায় বিশ্বাস করি।
কবিতার বিবর্তন প্রক্রিয়া:
যদি কবিতার বিবর্তন প্রক্রিয়াটা আমরা লক্ষ্য করি তবে দেখব আন্তর্জাতিক স্তরে কবিতা কাব্যনাট্য মহাকাব্য গীতিনাট্যর যুগ পরিক্রমা করে আধুনিক কবিতার কালে উত্তরণের পর আধুনিকোত্তর যুগে প্রবেশ করেছে আজকের কবিতা। বাংলা কবিতার বিবর্তনেও এটা ধরা পড়ে। প্রাচীন কালে সাহিত্যের প্রধান মাধ্যমই ছিল কবিতার ভাষা, সাহিত্যের আঙিনায় কবিতার ভাষাতেই কথা বলা হত। সমাজ জীবনের সুখ দুখ ধর্ম কর্ম রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে রাজত্ব বিস্তার যুদ্ধ বিদ্রোহ সব কিছুই ভাষা পেত কবিতার ভাষায়। রামায়ণ মহাভারত থেকে আরম্ভ করে হোমার রচিত ইলিয়ড ও ওডেসি সবের উপস্থাপিত রূপ হল কাব্য রূপ। প্রাচীন গ্রীসের যৌথ সমাজব্যবস্থার বিবরণ পাওয়া যায় এই লেখাগুলোতে। বাংলায় মধুসূধনের মেঘনাদ বধ লেখা হয়েছে কাব্য নাট্যে, মহাকাব্যের আদলে। জীবনচর্চার অভাবনীয় অনুকরনের প্রতিফলন ঘটত প্রাচীন রোমান সাহিত্যের নাটকে যা কাব্য রূপে লেখা। সেই সময়কালটাকে রোমের সাহিত্যের জগতের স্বর্ণযুগ বলা হয়। শেক্সপিয়ারের বিশ্বখ্যাত কালজয়ী বিভিন্ন্ নাটকও ছিল কাব্য রূপে লেখা। বাংলায় রবীন্দ্রনাথের লেখা গীতি নাট্যগুলি কাব্যগুনে ভরপুর।
এবার আসা যাক গীতিকাব্যে যা সুর ছন্দ লয়ে বাস্তবকে কবির মননের মাধ্যমে উপস্থিত করা হয়। একই সঙ্গে বিরহ মিলন সুখ দুঃখের কাহিনী পরিবেশিত হয় গীতিকাব্য পরিবেশনে যা পাঠকের মনকে সিক্ত করে তোলে তাকে রাঙিয়ে তোলে রোমাঞ্চিত করে। এমন কি কবির বিদ্রোহের মানসও প্রকাশ পায় গীতি কাব্যে। পাঠকের মনোরঞ্জন ঘটে যেমন তেমনি অবিচার নিপীড়নের কাহিনী তাকে ব্যথিত করে। নারী পুরুষের প্রেম কাহিনী তাকে কেন্দ্র করে বিরহ মিলন যে রোমান্টিকতার জন্ম দেয় তার সুললিত প্রকাশ ঘটে গীতিকাব্যে । যেমন রবীন্দ্রনাথের শ্যামা এ ধরনের একটি গীতি কাব্য যা নাচের মুদ্রায় গানের সুললিত সুরে প্রস্ফুটিত। প্রেম বিরহ তার ঘাত প্রতিঘাত এই নৃতিনাট্যে যথার্থ রূপ পেয়েছে। এক কথায় গীতিকাব্যে কোন ব্যক্তির মননের তার অনুভূতির এক স্বত:স্ফূর্ত প্রকাশ ঘটে যা কবির কবিতায় ভাষা পায়। কাব্যের এই আঙ্গিক একদিকে যেমন স্বাভাবিকতা আর সহজিকতায় প্রকাশ পায় তেমনি ছন্দের মাধুর্যে তা ভরপুর। ব্যক্তি-অনুভূতির স্বত:স্ফূর্ত প্রকাশ গীতিকবিতার প্রধান লক্ষণ। সাবলীলতা ও সহজতায় এই কাব্য-আঙ্গিক সর্বাপেক্ষা বৈচিত্র্যময় ও প্রভাবশালী। প্রাচীন গ্রিসে বীণাযন্ত্র সহযোগে যে সংগীত পরিবেশিত হতো তাকে বলা হতো লিরিক (Lyric)। এ থেকে বোঝা যায় Lyric বা গীতিকবিতার সঙ্গে সংগীত ধর্মের সম্পর্ক সুনিবিড়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের অনেক কবিতা একই সঙ্গে কবিতা ও গান। তবুও মনে রাখতে হবে সংগীত অপেক্ষা গীতিকবিতার ক্ষেত্র বহুবিচিত্র। মানবীয় অনুভূতির বহুমুখী সত্তা গীতিকবিতায় রূপ পায়। সংগীতে থাকে সুরের প্রাধান্য ও নিয়ন্ত্রণ, আর গীতিকবিতায় কথা ছন্দ ও সুরের সমন্বয়। ব্যক্তি অনুভূতির সূক্ষ্মতর প্রকাশ অনিবার্য শব্দ, ধ্বনি এবং ছন্দ বিন্যাসে গীতিকবিতায় রূপ পায় বলে আদিকাল থেকেই কবিতার এই রীতি সর্বাধিক চর্চিত সাহিত্যধারা। এ প্রসঙ্গে মহাকাব্যের সঙ্গে গীতিকবিতার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকগত পার্থক্যের স্বরূপ নির্দেশ করা প্রয়োজন। মহাকাব্যের বিষয় আঙ্গিক ও পূর্বনিরূপিত আর গীতিকবিতার বিষয়, রীতি ও রূপ সময়ের সঙ্গে সমাজ ও রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। মহাকাব্য বস্তুনিষ্ঠ (objective) আর গীতিকবিতা ভাবনিষ্ঠ (subjective) কবিতা বলে মনে করা হয়।
বহুবৈচিত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বহু রূপের গীতি কাব্যের সাহিত্যের প্রাঙ্গণে বিচরণ। গীতিকাব্য বা lyric সংগীত ধর্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। আমরা রবীন্দ্রনাথের শ্যামার কথা যেমন বললাম তেমনি নজরুল সুকান্তের অনেক কবিতা একই সঙ্গে গান। যেমন নজরুলের রুম ঝুম রুম ঝুম বা সুকান্তের রানার। নজরুলের গীতিকাব্যে যেমন রোমান্সের সুর তেমনি সেখানে বিদ্রোহের ঘোষণা। সুকান্তের রানার কবিতায় তিনি যখন লেখেন ঘরেতে অভাব পৃথিবীটা তাই কালো ধোঁয়া / পিঠেতে টাকার বোঝা তাও টাকা তো যাবে না ছোঁয়া’ বা ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’ তখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে দুঃখ বেদনা যেন তার বিনার তাঁরে বেজে ওঠে ঝঙ্কৃত হয়। বিদ্রোহের মানস জেগে ওঠে । আবার তিনি একই কবিতায় ভবিষ্যত অবলোকন করেন। দুঃখের শেষে নতুনের স্বপ্ন দেখেন। তার কবিতায় ভৈরর সুর। তাঁর রানার কবিতার কয়েকটা লাইনে তিনি গেয়ে ওঠেন :
“রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়,
আরো জোরে, আরো জোরে হে রানার দু্র্বার দুর্জয ।
তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে সরে যায় বন,
আরো পথ, আরো পথ – বুঝি লাল হয় ও – পূর্ব কোণ” ।
নজরুলের কবিতায় আমরা একই ধরনের গীতিকাব্য উপহার পাই তিনি যখন লেখেন:
”সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
নীচে আমি আমার একটা কবিতা তুলে ধরলাম স্বীকার করে নিতে যে রবীন্দ্র আঙ্গিকে বিষয় বস্তুতে আজও আমরা রবীন্দ্র ভাবধারার গীতিকবিতার বহুমুখী প্রভাব থেকে মুক্ত নই।
ঘৃণা আমার
২২/০১/২০২২
চোখের জল পাথর হয়
আর আসে না কান্না
সাগর জলে জাহাজ ভাসে
খুঁজে ফেরে পান্না।
নীল আকাশে ওড়ে ঘুড়ি
অচিন দেশে যাত্রা
মেঘ ভেঙে বর্ষা নামে
শোন গো তার বার্তা।
জানি না আমি পান্না কোথায়
সাগর কন্যা মেয়ে
ভাসব আমি তোর দরিয়ায়
জীবন খেয়া বেয়ে।
হালে আমি পাই না পানি
জল নেই যে সাগরে
চোখের জল শুকিয়ে গেছে
ঘৃণা আমার বাসরে।
কবিতার আধুনিক ও আধুনিকোত্তর যুগ
আমরা দেখলাম যে এ বিশ্বব্রহ্মান্ড সমাজজীবন ব্যক্তিমানসের কল্পলোক এসব নিয়ে সাহিত্যস্রষ্টার কৌতূহল বিস্ময় স্মৃতি কল্পনা সংবেদনশীলতার ছন্দবন্ধ রূপই হলো কবিতা। মানুষের মনোজগতের আবেগ অনুভূতি কল্পনাকে ছন্দবন্ধ আকারে লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে কাব্যের সৃষ্টি হয় বলে মনে করা হয় আজকের আনুষ্ঠানিক সাহিত্য জগতে। তবে আমরা মনে করি আনুষ্ঠানিক ভাবে লিপিবদ্ধ হওয়ার অনেক আগেই মুখে মুখে ছান্দনিক ভাষায় কথোপকথন কবিতায় রূপ পেত। আর শুধু মনোজগতের অনুভূতি নয় এই বস্তুজগতকে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে শ্রবণে দৃষ্টিতে ঘ্রানে স্বাদে অবলোকন করে তার সঙ্গে মনোলোকের সঙ্গম ঘটিয়ে অনুভূতি সংবেদনশীলতাকে ছন্দবদ্ধভাবে কবিতায় প্রকাশ করা হয়। তাই কবিতা সৃষ্টিতে ভৌতজগতের গুরুত্ব কম নয়। এই ভৌতজগতের মধ্যে পড়ে মহাকাশ চন্দ্র সূর্য তারা মন্ডলী এই পৃথিবী আকাশ বাতাস মনুষ্য সমাজ সবই। আর এই ভৌতজগৎ সমাজ জীবন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয় পরিবর্তিত হয়। এই বিবর্তন পরিবর্তনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় শিল্প সাহিত্যের সব বিভাগেই।এর সঙ্গে মানুষের মনন প্রক্রিয়া অনুভূতি সংবেদনশীলতায় পরিবর্তন আসে। সেটা ধরে কবিতা গল্প প্রবন্ধের আঙ্গিকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসে। যেমন আগেকার দিনে পূজা চর্চা ধর্ম কর্ম রাজা রাজরাদের যুদ্ধ কাহিনী বীরত্বের কাহিনী রাজকুমার রাজকুমারীর প্রেম কাহিনী গুরুত্ব পেত। আজ সাহিত্যে সমাজের বিবর্তন প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষ তাদের অধিকার বোধ আত্মস্বার্থের সঙ্গে সমাজিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি বিশেষ গুরুত্ব পায়। আধুনিক কবিতায় এই প্রক্রিয়ায় যে বিবর্তন ঘটেছে তা সংক্ষেপে তুলে ধরব।
যারা কবিতাকে নেহাত কবির অনুভূতির ছন্দবন্ধ নান্দনিক উপস্থাপন বলে মনে করেন তাঁরা কবিতায় বিষয়বস্তুর দিকটা তেমন গুরুত্ব দেন না। অথচ কবিতায় গল্পের মত করে বিষয়বস্তুর শৈল্পিক উপস্থাপন কবিতাকে উচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরে। গীতিকাব্যই হোক আর আধুনিক গদ্য কবিতাই হোক সবেতেই বিষয়বস্তু ধরে তাকে তুলে ধরা কবিতার আঙ্গিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মধ্যযুগে মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, কবিকঙ্কন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কবি। বাংলা কাব্য সাহিত্যে মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের ‘ফুল্লরার বারমাস্যা’ই হোক আর বর্তমান যুগের অক্ষয় কুমার বড়ালের ‘মধ্যাহ্নে’ হোক বা রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য মেয়ে’ বা ‘হঠাৎ দেখা’ই হোক কবিতাগুলোতে বস্তুজগতের বিষয়কে তুলে ধরা হয়েছে। ফুল্লরার বারমাস্যা কবিতাটায় গ্রাম বাংলার এক গরীব পরিবারের দুর্দশা গ্রস্ত জীবন যেন এক রোজনামচা যা অদ্ভুত কাব্য নৈপূণ্যে তুলে ধরা হয়েছে সেই ত্রয়োদশ শতকের ষাটের দশকে যা আজও আমরা চাক্ষুষ দেখি এই বাংলার গ্রামে বা শহরের বস্তিতে। কবিতাটায় তিনি বলেন:
পাশেতে বসিয়া রামা কহে দুখোবানি।
ভাঙ্গা ক্যুইরা ঘর খানি পত্রের ছাউনী।।
ভেরেন্দার খাম আছে মধ্য ঘরে।
প্রথম বৈশাখ মাসে নিত্য ভাঙ্গে ঝড়ে।।
বর্তমান যুগের অক্ষয় কুমার ‘মধ্যাহ্নে ‘ কবিতায় কোন এক দুপুরে নদীপাড় থেকে নদীর অলসভাবে বয়ে চলার বর্ণনা দেন ।নদীর মত গ্রাম জীবনও বয়ে চলে সময়ের সঙ্গে সুখ দুঃখের তরী বেয়ে। রবীন্দ্রনাথ ‘ হঠাৎ দেখা ‘ বা ‘সামান্য মেয়ে‘ কবিতায় গল্পের ছলে প্রেমের বিরহ যন্ত্রণার সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটান রোমান্টিকতার। হঠাৎ দেখা কবিতায় একজায়গায় তিনি লেখেন :
আজ পরেছে কালো রেশমের কাপড়
আঁচল তুলেছে মাথায়
দোলনচাঁপার মতো চিকন গৌর মুখখানি ঘিরে
মনে হল, কালো রঙের একটা গভীর দূরত্ব
ঘনিয়ে নিয়েছে নিজের চারদিকে,
যে দূরত্ব সর্ষেখেতের শেষ সীমানায়
শালবনের নীলাঞ্জনে।
এ বিরহ যন্ত্রণার এক প্রতীক যা নারী পুরুষের প্রেমে নৈমিত্তিক ঘটনা। আবার কবিতার শেষে তিনি হয়ে উঠেছেন রোমান্টিক দেহাতিত প্রেমের পূজারী যখন লেখেন, ‘ রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে ‘। সামান্য মেয়ে কবিতায় গ্রাম বাংলার একটি মেয়ের আসা আকাঙ্খা প্রেম ভালোবাসার এক বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় যা বাংলার মেয়েদের বারমাস্যা।
উপমার সাহায্যে কবি বলেন দেহাতীত প্রেম অমর। তার এ ধরনের কবিতা হলো ‘ক্যামেলিয়া‘ ‘সাধারণ মেয়ে‘ প্রভৃতি। গীতিকাব্যকার রবীন্দ্রনাথ আধুনিক গদ্য কবিতার উত্তরসুরী হয়ে ওঠেন। সুতরাং কবিতায় বাস্তবতার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না । তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিমূর্ত ভাবনার গুরুত্ব আধুনিক কবিতায় বেড়েছে। আমাদের জীবনে যে একাকীত্ব আত্মকেন্দ্রিকতা বা একধরনের নৈরাজ্য দেখা দিয়েছে তার প্রতিফলন দেখা যায় উত্তর আধুনিক কবিতার জগতে আজ। তবে আমরা একই সঙ্গে জয় গোস্বামীকে পাই যিনি গল্পের ছলে বেণীমাধবের জীবন চরিত বর্ণনা করেন এক অদ্ভুত উপকল্পের মাধ্যমে। আবার শঙ্খ ঘোষের মত কবি আছেন যিনি সমাজের বৈষম্য তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের দিকটা তুলে ধরেন।
এই প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ দাশের কথা না বললে নয় যিনি আধুনিক কবিতার একজন অগ্রদূত। আধুনিক কবিতায় ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ গল্পের ঢংয়ে তাকে উপস্থাপন করার বদলে অনুভূতিকে চিত্র কল্পের ছোঁয়ায় বিমূর্ত ভাবে উপস্থাপনের ওপর নজর দেওয়া হয় যার কল্পরূপের স্রষ্টা হিসেবে আমরা জীবনানন্দ দাশকে পাই। আবার যেমন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তীর কলকাতার যীশু কবিতায় তিনি লেখেন:
“ঝাঁকামুটে, ফিরিওয়ালা, দোকানি ও খরিদ্দার— / এখন তারাও যেন স্থির চিত্রটির মতো শিল্পীর ইজেলে/ লগ্ন হয়ে আছে।/ স্তব্ধ হয়ে সবাই দেখছে, টালমাটাল পায়ে/ রাস্তার এক-পার থেকে অন্য পারে হেঁটে চলে যায়/ সম্পূর্ণ উলঙ্গ এক শিশু।”
বলনে বিস্তার নেই, যেন এক খন্ড মুহূর্তের চমকপ্রদ উপস্থাপন। খুলে বলা নয়। যেন নীরব স্থির চিত্র পরিবেশিত হয়েছে। এক মননের অনুভূতির বিমূর্ত উপস্থাপন। কম বলেও অনেক বলা। আমরা জীবনানন্দের কবিতায় এক ধরনের ঝটকা উপস্থাপন পাই যেখানে তাঁর অনুভূতিকে বুঝে নিতে হয়, বুঝিয়ে দেওয়ার দায় থাকে না কবির। জীবানন্দ দাশের কবিতার একটা কথা, আজ পৃথিবীর গভীর অসুখ।কোন বিস্তৃত বিবরণ নেই কিন্তু এর মধ্যে কত গভীর কথা বলে দেওয়া।। বা ‘বনলতা সেন ‘ কবিতায় , ‘‘ চুল তার কবেকার বিদিশার নিশা মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’ —- কবির ইঙ্গিতে বুঝে নিতে হয় তাঁর ভাবনা।প্রকাশের ভাবটা বিমূর্ত কিন্তু মূর্ত হয়ে ওঠে জীবন ভাবনা। জীবনানন্দের অধিকাংশ কবিতায় দেখা যায় তাঁর মানস পটে যেন তিনি চিত্র শিল্পী। ছবি হয়ে প্রানবন্ত হয়ে ওঠেন।কবিমানস থেকে পাঠক মানসে রূপান্তরিত হয় সে ছবি। যেন একটা মুহূর্তের আচমকা ছবি। পড়েই মনে হয় সেগুলির চিত্রকলায় রূপান্তর করার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। যেমন, “কচি লেবু পাতার মত নরম সবুজ আলোয়/ পৃথিবী ভরে গিয়েছে এই ভোরের বেলা;/ কাঁচা বাতাবির মত সবুজ ঘাস — তেমনি সুঘ্রাণ— / হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে!” (ঘাস, বনলতা সেন)। এই লাইনগুলির জন্মই হয়েছে শিল্পীর কবি মানসে স্থান পাবার জন্য। জীবনানন্দর কবিতার ওপর অনেক বিখ্যাত চিত্রশিল্পীই ছবির সিরিজ এঁকেছেন বলে জানা যায়।
তবে এটাও মনে রাখতে হয় আধুনিক কবিতার শেষ পর্যায়ে আর আধুনিকোত্তর যুগে কবিতাকে নেহাতই অনুভূতির বিমূর্ত উপস্থাপন বলে অনেকে দেখেন যার সঙ্গে জীবনের বাস্তবতার মিল থাকে না। কবিতার ভেতরে তাৎপর্য স্পষ্ট থাকে না। হয়ে ওঠে দুরুহ যা আমজনতার দুয়ারে পৌঁছোয় না, শিক্ষিত সমাজে যা বিমূর্ত আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।অনেক সময় কবিতায় ছন্দ লয় গুরুত্ব পায় না। এই ধরনের কবিতায় সাহিত্যিকের জীবনবোধ সমাজের প্রতি তাঁর কর্তব্য বোধকে অস্বীকার করা হয়। এরই মধ্যে আমরা শঙ্খ ঘোষ নীরেন চক্রবর্তী বা বীরেন চট্টোপাধ্যায়কে পাই যাঁরা আধুনিক কবিতার আঙ্গিকে সমাজের নিপীড়ন শোষণ তার থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন।এছাড়া আছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় সুনীল গাঙ্গুলী যারা দুয়ের মধ্যে মিল ঘটাতে চেয়েছেন।তবে কবিতার আঙ্গিক তার ছন্দের ধরন বিষয় বস্তু নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার বিবর্তন ঘটে চলেছে।
আমরা বলেছি সাহিত্যে সময়টাকে ধরার চেষ্টা করা হয়। আমি এরকম একটা কবিতা উপস্থাপন করলাম যাতে আজকে করোনা সংকট ও সমাজের ওপর তার প্রভাবটাকে বোঝার চেষ্টা হয়েছে।
তবু কত কাছে
এখন বিকেল পাঁচটা সাতে
কেউ নেই পার্কে,
বাচ্চারা আসে না খেলতে
নেই কিশোর কিশোরীর চোখের ইশারা,
স্পন্দনহীন এ প্রাণে
যেন এক প্রেমহীন সাহারা,
শ্বাপদ কি যেন খোঁজে শ্মশানে,
আমার এ গোধূলি বেলায়
সরব বিকেলে নিরবের দংশন
আমি বসে নিরালায়।
আমার লেখা ‘নীলাঞ্জনা’ কবিতাটা বর্তমানের ধর্মীয় বিভেধকে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষের বিভেদ সৃষ্টির বিষয়টা তুলে ধরার চেষ্টা করে। অনুভূতিটা গল্পের ছলে নয় ইংগিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। খেয়াল রেখেছি দুরুহ বিমূর্ত যেন না হয়। সহজ উপমা ব্যবহার করা হয়েছে। আমার চেষ্টায় আমি কতটা সফল তা পাঠকের বিচারাধীন।
কিন্তু নীলাঞ্জনা, আজ !
জল আর পানির বিবাদ বেলায়
তুমি ছেড়ে গেলে আমায়
ধরে রাখতে পারি নি
আমিও ভুলেছি তোমায়
বিরহের কান্না সে বাসর শয্যায়।
আমরা দেখলাম যে কোন ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বিষয়কে নিজের উপলব্ধিতে শব্দরাশির সাহায্যে ছন্দবদ্ধ রূপে মেলে ধরাকে কবিতা বলা যায়। কবির মননের স্বতস্ফূর্ত বাহ্যিক প্রবাহকে অনেকে কবিতা বলে মনে করেন।বলা চলে মনের অন্তস্থলের সুপ্ত চিন্তা-ভাবনা, আবেগ ও অনুভূতিগুলো ছন্দবদ্ধ আকারে। ভাষায় প্রকাশ করা হলে তাকে কবিতা বলা চলে। মনোজগতে বস্তুজগতের ঘটনাবলীর নির্যাসকে ছন্দবদ্ধ ভাবে শব্দের বিন্যাসের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারলে কাব্যের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ আবেগ অনুভূতি উপলব্ধি ও চিন্তার থেকে নিংরে নিয়ে শব্দের ছান্দসিক বিন্যাস তথা মালা গাঁথাই হল কবিতা।কাঠামো দিয়ে বিচার করলে কবিতা নানা রকম হতে পারে । বিভিন্ন যুগে কবিতার বৈশিষ্ট্য ও কাঠামোতে পরিবর্তন এসেছে। কবিতায় ভাব প্রবণতা ডানা মেলে। মানুষের আবেগকে মেলে ধরে। এর হৃদয় গ্রহীতা অনেক বেশি স্পর্শকাতর। ছন্দ সুর লয় মিলে কবিতা যেন পাখা মেলে, পাঠকের আবেগের মুর্চ্ছনায় তার প্রকাশ। শব্দের ঝংকার যেন সেতারের বাজনা। বাচিক শিল্পীর সুললিত কণ্ঠে সে ভিন্ন মাত্রা পায় যা অনুভবের দরজায় টোকা মারে, শ্রবণ যন্ত্রে যেন মধু ঢেলে দেয়। মিল কবিতা হোক অমিল কবিতা হোক হোক ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার মিলের কবিতা, অন্তর্নিহিত ছন্দের মূর্ছনা তার সঙ্গে সুর ও লয়ের সমাহার কবিতাকে হৃদয় গ্রাহী করে তোলে। যুক্তির ইন্দ্রিয় তার খেলাঘর নয় হৃদয়ের অলিন্দে সে মুর্ত হয়ে ওঠে। আবেগকে তাড়না করে। নিচের কবিতায় আমি কবিতার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার চেষ্টা করলাম যা থেকে সাহিত্যে কবিতার স্থান কোথায় বুঝতে পারি।
কবিতা আমার
কবিতা আমার জীবন স্পন্দন
সে আমার মিলন বন্ধন
ছন্দ সুর লয়ে সে আমার ঝঙ্কার
কবিতা আমার বিরহ ক্রন্দন
সে আমার সাথী প্রতিক্ষণ,
কবিতা আমার বারমাস্যা
কবিতা আমার জীবনের ভাষা।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো আধুনিক কবিতার নামে বিমূর্ত দুরূহ অস্পষ্ট কবিতায় সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজের সেবা করার দিকটা উপেক্ষিত হয়। আধুনিক গদ্য কবিতা খুব উচ্চ মানের হতে পারে। ছন্দ সুর লয়ে ভরপুর হতে পারে। এমন অর্থ বহন করতে পারে যা মানুষের মূল্যবোধকে মর্যাদা দেয়। কিন্তু যান্ত্রিক বস্তুবাদের দর্শন আধুনিক কবিতার বিকৃতি ঘটায় যা কোন বার্তা বহন করে না। সুর ও ছন্দ নিয়ে গবেষণা সাপেক্ষে আধুনিক কবিতা খুবই উচ্চমানের হয়। হাসি ঠাট্টা তামাশাও তার মধ্যে থাকে। কিন্তু বিমূর্ত ভাবে অর্থহীন হয়ে ওঠা বা বিকৃত রুচির প্রকাশকে সত্যিকারের আধুনিক কবিতা সমর্থন করে না। আরও বলা হয় যে কবি কবিতায় নিজের ভাবনাকে অনুন্মচিত রাখবেন। পাঠক তাঁর মনন দিয়ে যে যার মত করে বুঝে নেবে। তা হবে কেন? কবি যেটা বলতে চান সেটাই যেন পাঠকের কাছে মূর্ত হয়ে ওঠে সেটাই আমরা চাই। তা না হলে কবির সঙ্গে পাঠক একাত্ম হতে পারেন না। কবি যেটা বলতে চান পাঠকের মননে তা বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর কবির মননে যে জীবন বোধ সেটা নিয়ে লুকোচুরি কেন? আমি মনে করি এতে সাহিত্যিকের দায়বদ্ধতা অস্বীকার করা হয়।
