ছাতুছিরি
কবিতাকার
ঢেঁকির অবস্থা বাড়ির বাসিন্দাদের মতো ভঙ্গুর ও অবহেলিত। ঢেঁকিঘরের উপরের ছাউনি শুধু উধাও হয় নি, বেড়াও বেড়াতে গিয়েছে কোথাও বোধ হয়। ধরনি বা আড়ও কোন আড়ালে আবডালে পচছে তার ইয়ত্তা নেই।আষাঢ়ের বৃষ্টিতে নোডে পানি জমেছিল, দুদিন হলো সম্পূর্ণরূপে শুকিয়েছে। ঢেঁকির পিঠে পা রাখার মতো বাড়ির মানুষের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পেয়ে শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে বলা চলে।
তাই ঢেঁকিতে নিয়মিত পাড় পড়ে না।বৃদ্ধার বয়স সত্তরের আশেপাশে,লাঠি ছাড়া নড়াচড়া করতে পারেন না। পুত্রবধূর বয়স পঞ্চাশের এপাশে ঐপাশে হবে, ডায়েবিটিস রোগী–চোখে কম দেখেন,মেরুদণ্ডে ব্যথা–হাড় ক্ষয়ে যাচ্ছে। নাতনি সম্মান শ্রেণিতে পড়ে, নিজের সম্মান রক্ষা করে চলে। তবু তো অভ্যেস রেওয়াজ সামর্থ্যের গলায় সবসময় সামাজিক ছুরি চালায়। পুত্রবধূ, বাড়ির কর্ত্রী নাতি নাতনিদের জন্য খাবার পাঠানোর খোয়াবে বিভোর।
মাঝেমাঝেই তার অভিলাষ পূরণ করেন পাড়াপ্রতিবেশীদের সাহায্যে। সময়ে সময়ে তার অভিলাষ উপহাসে পরিণত হয়,তাতে তার কিছু আসে যায় না। তিনশত টাকায় বাজারে যে জিনিস পাওয়া যায়, সে জিনিস পাঠানোর জন্য বেমালুম পাঁচশত খরচ করেন;তারপরও ঝুঁকিঝামেলা তো সাথে আছেই।
বড় মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন বাড়ি থেকে তিনশত কিলোমিটার দূরে।জামাইয়ের চাকুরিসূত্রে দূরত্ব আরও দুইশত কিলোমিটার বেড়েছে। আবেগের পদ্মাসেতু হওয়ার পরেও তাদের সাক্ষাৎ ঘটে নি ঈদে। মোবাইল আছে বলেই মনের দূরত্বে এখনো আগের মতোই আছে।
জামাই কথা বেচে খায়।নিজে বাঁচে,পরিবারকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। জামাইয়ের দাঁতের দুনিয়ায় সহজে ধর্মঘট হয় না। সারাক্ষণ জিহ্বা দিয়ে দাঁতের যত্ন নেয়,দাঁতে বাতাস লাগানোই যেন তার কাজ। যখন কথার কাজ থাকে না,তখনও জামাই চোয়াল চালাতে পছন্দ করে অর্থাৎ ভাজাপোড়া তার পছন্দ। গতবার এসএ পরিবহণে জামাইয়ের জন্য গম ছোলা মসুর ডাল শিমের বিচি মাষকলাই চিনাবাদাম ও চাল ভাজা বোতলে পাঠিয়েছিলেন। আর নাতি নাতনিদের জন্য ওগুলোর ছাতু। সাথে আখের ঝোলা গুড় প্লাস্টিকের বোয়ামে ট্যাপের কফিনে মুড়িয়ে।
ছাতু মানে হরলিক্স খেয়ে নাতনি নানির ভক্ত হয়ে গিয়েছে। একথা বাতাসে ছড়ানোর সাথে সাথে নানির ঘুম হারাম হয়েছে। নানির মুখে গল্পের ঘুড়ি উড়ছে তো উড়ছেই,আর পড়ছে না। নাতনিকে আবার ছাতু না পাঠিয়ে তার স্বস্তি আসবে না কিছুইতে।
লোক পাঠিয়ে বাজার থেকে ছাতু সামগ্রী কিনে এনেছেন। স্বামীর জন্য বসে থাকলে হবে না,স্বামী আসবেন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শুক্রবার। ছাতু সামগ্রী ধোয়ে রোদে শুকানোর কাজ চলছে। অসময়েও বৃষ্টির দেখা মিলে, তাই ঢেঁকিঘর পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো। পাশের পাড়ার বিধবা নসিমনকে ঢেঁকি পাড়ানোর জন্য চারশত টাকায় চুক্তিতে রাজি করানো হলো।
ঢেঁকির নোডে হাত দিতে গিয়ে পাড় লেগে সম্মান শ্রেণির ছাত্রীর ডানহাতের হাড় মচকে গেল,সামনে পরীক্ষা। গৃহকর্ত্রী স্বামীকে ছাতু পাঠানোর তাগিদ দিয়েই যাচ্ছেন বললেন, শনিবার বিকেলে অফিসে যাওয়ার পথে আগে এসএ পরিবহণে ছাতু পাঠিয়ে তারপর অফিসের দিকে মুখ করবা। বাধ্য হয়ে বেচারা চার কিলোমিটার কোলে চড়িয়ে ছাতুকে গন্তব্যগৃহে নিয়ে গেলো।
ভাড়া তো গেলই অতিরিক্ত, তারপর ঝাঁকুনিতে বস্তার ভেতরের পলিথিন ফেটে ছাতু শরীরের সর্বত্র শয্যা করে শুয়ে পড়েছেও। লোকটাকে ময়দা মিলের শ্রমিক বলে যে কারোরই ভুল হতে পারে।অবস্থা দেখে কুরিয়ার সার্ভিসের লোকজন কড়া ভাষায় কথা বলছে:বৃষ্টির দিন, বিশেষ ব্যবস্থায় পাঠাতে হবে, একশত টাকা বেশি দিতে হবে–দেখেন পাঠাবেন কিনা?
সকালে এসএ পরিবহণ থেকে ফোন এসেছিল।জামাই ঝামেলায় ভুলে গেছিল। বিকেলে শাশুড়ির ফোনের কারণে মনে পড়ল । ঐদিকে শাশুড়ি শ্বশুরকে বিনে তারে কুরিয়ারকে তাড়া দেয়ার জন্য নিয়মিত তাগিদ দিয়েই যাচ্ছেন। আকাশে মদপ মেঘের ঘনঘটা, মাঝেমধ্যে বৃষ্টির বাগড়া তো আছেই। জামাইকে ছাতা সঙ্গে নিতে হলো, বৃষ্টি না পড়লে জামাই প্রায়ই ছাতা রেখে খালি হাতে বাসায় ফিরে । কোথায় রেখে এসেছে,তাও মনে করতে পারে না। পরিবহণের লোক বস্তা সামনে ফেলার পরই ফস করে ছাতু জামাইকে সালাম দেয়ার নাকেমুখে প্রবেশ করল।
জামাইয়ের ডাস্ট এলার্জি থাকায় সাথে সাথে নাকের দরজা খুলে গেল। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে,রিক্সা পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই গাড়ির সন্ধানে বস্তা ঘাড়ে করে হলেও রাস্তা পার হতে হলো। জামাই যতই অধম হোক এটুকু বুঝতে পেরেছে যে,কোনকিছুর সাথে বস্তার সংঘর্ষ লাগলেই ছাতু বের আসে প্রতিবাদ করার নিমিত্তে। রাস্তা ভেজা, বস্তাকে রাস্তার উপরে রাখলে ভেজাবিক্রিয়া হবে। তাই পায়ের পরে বস্তা রেখে,পা উঁচু করে রেখে ছাতার ছায়াদানে সন্তুষ্ট করে রিক্সা ডাকতে থাকে জামাই। ফোন বেজেই যাচ্ছে,ধরার সুযোগ নেই। অবশেষে রিক্সা পাওয়া গেল।
সামনে বাজারের চিরাচরিত জ্যাম। বেঁকে ভাঙা রাস্তায় যেতে হবে। রিক্সা ভেজা,নিচে বস্তা রাখা যাচ্ছে না।আগে বিয়ের দিনে বর যেমন বউকে কোলে করে নিয়ে যেত,তেমনি জামাই বস্তাকে কোলে বসতে দিয়েছে।বৃষ্টি পড়ছে,ছাতা সামনে ধরতে হল। গাড়িওলার পলিথিন নেই, বিপদ। রিক্সাওলা ভাঙা রাস্তা দেখে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে যাচ্ছে,আর বিড়বিড় করছে:ভাঙা বলে এ রাস্তায় আসি না। ঘুরে আসলাম ভাড়া বেশি দিতে হবে,রাস্তার কাজ ভালোভাবে করে না,সব চোর–।বৃষ্টিতে রাস্তার ইট বের হয়ে গেছে।
মনে হচ্ছে রাস্তার মজ্জায় রক্ত লেগে আছে।জামাই না দেখেও টের পাচ্ছে।জামাইয়ের মনে হচ্ছে কোলে করে সে হাতি নিয়ে যাচ্ছে। জায়গায় জায়গায় রাস্তা খালে কিংবা ড্রেনে নেমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে,গাড়িকেও ডাকে।হাড়ে হাড়ে ঠকাঠকি লাগছে। একটা জায়গায় রাস্তার চামড়া সরে যেতে যেতে গলাছিলা মুরগির মতো সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। বৃষ্টিটা একটু থেমেছে। ছাতাটা বগলে নিয়ে বস্তা কষে ধরে জামাই কী যেন ভাবছিল। তার মনে হলো দুর্গন্ধযুক্ত ডোবা থেকে লোকজন তাকে টেনে তুলছে।একজন উদ্ধারকারী বললো, সাথে কি কিছু ছিল,কোথায় পড়েছে? ময়লামমি মুখ থেকে কুলিকায়দায় বের করে দিয়ে বললো, ওয়াক থু!ছাতু।
এ যাত্রায় জামাই রক্ষা পেয়েছে। যেমনটা ভাবছিল, তেমনটা হতে পারত। কিন্তু হয় নি। লাফিয়ে নেমে রিক্সা টেনে ধরেছে,চালকও চালু করে নেমে উল্টোভাবে দাঁড়িয়ে বুক দিয়ে ঠেকিয়েছে। গাড়ি বাঁচাতে গিয়ে হাতের চামড়ার সৌন্দর্য রক্ষা করতে পারে নি।চামড়া উঠে গেছে দুই জায়গায়। জামাইয়ের বস্তা রাস্তায় অনাদরে শুয়ে রয়েছে। তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে বস্তা রক্ষা করতে পারে নি,যেমন পারে নি নিজের জামা অক্ষত রাখতে।
লোহালক্কড়ের সংঘর্ষে জামার মান গেছে,বুকে বগলে দুই জায়গায় ঘা হয়েছে মাত্র।বস্তা রক্তাক্ত, প্যান্টও তার প্রমাণ দিচ্ছে। বোয়ামে মমিকৃত গুড় বোধ হয় মুক্তি পেয়ে ছাতুর সৌন্দর্য অবলোকন করছে। কবি হলে জামাই বলতেন, গুড় ছাতুর সাথে সংসার গড়েছে। যাত্রী চালক দুইজনই দুই যন্ত্রণায় ভুগছে। জ্বলন্ত দুই খণ্ড আগুন কেউ কাউকে সহায়তা ও সান্ত্বনা দিতে পারে না। যার যার মতো সে সে জ্বলে। যাত্রী জামাই ছাতুছিরি চেহারা দেখতে দেখতে অবশেষে বললো, ভাই চলেন যাই।