Rudra Kinshuk

রুদ্র কিংশুক

প্রচলিত রীতির কাব্যকলা থেকে দূরে একটি কাব্য সংগ্রহের অবিন্যস্তযাপন
তৈমুর খান 

আধুনিকতাবাদকে অস্বীকার করে অর্থাৎ প্রচলিত যুক্তি, বিজ্ঞানকে, মানবতাবাদ ও শৈল্পিক ধ্যানধারণার একমুখীনতাকে পুরোপুরি ত্যাগ করে যাঁরা অধুনান্তিক সাহিত্যের পথে নিজেকে চালিত করতে পারেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রুদ্র কিংশুক।দীর্ঘদিন সাহিত্য করেও এবং বিভিন্ন ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ কর্মে নিয়োজিত থাকলেও নিজেকে আড়ালে রাখতেই বেশি পছন্দ করেন তিনি। অথচ তাঁর সাহিত্য কর্মে এক মেধাবী উত্তরণ লক্ষ করা যায়। সম্প্রতি তাঁর ত্রয়ী কাব্যের তৃতীয় খণ্ড ‘ইশপাদেবতার সূর্যসন্ধান’(প্রথম প্রকাশ ২০২১) হাতে এসে পৌঁছেছে। এর পূর্বের দুটি খণ্ড ‘আয়নাপাখি’(২০১৩) এবং ‘অগ্নিদিদৃক্ষা’(২০১৯)।

 ‘ইশপাদেবতার সূর্যসন্ধান’ আগের দুটি কাব্যধারারই পরিপূরক। এটিতেও রুদ্র কিংশুক নতুন চিন্তা-চেতনার টেক্সট নির্মাণে পেইন্টিংয়ের মিউজিকের লোকায়ত সাহিত্য ও দর্শনের বিভিন্ন উপাদানের সম্মিলন ঘটিয়াছেন। তিনি বলেছেন : “মুথাঘাসীয় গঠনের এই টেক্সট কোনো নির্দিষ্ট মেটাফর বা অর্থকেন্দ্রিক নয়। নঞর্থকতার আলোর সন্ধানে ব্রতী এই টেক্সট, যার অবস্থান প্রথাগত ক্যাননের বাইরে।” একথা যে সর্বার্থেই সত্য হয়ে উঠেছে তা বলাই বাহুল্য। ‘মুথাঘাসীয়’ ব্যাপারটি হল তলায় তলায় এক শিকড় সংযোগ। কাব্যের বিচ্ছিন্ন দৃশ্য, টুকরো বাক্য, শূন্যতার বিন্যাস, অর্থহীনতার প্রজ্ঞা, নীরবতার স্পেস সবকিছুরই এক সমন্বিত আকর্ষণ যাকে আলাদা করে ভাববার অবকাশ নেই। পোস্টমডার্ন ভাবনার অন্যতম রূপকার জেমস রবার্ট জারমুশ (১৯৫৩) যিনি একজন আমেরিকান চলচ্চিত্র পরিচালক এবং চিত্রনাট্যকার, সর্বদা নিজেকে ব্যতিক্রমী জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তোলেন। শিল্পেও তার প্রকাশ ঘটান। তাঁরই এবিষয়ে একটি স্মরণীয় উক্তি হল:

“কিছুই আসল নয়। অনুপ্রেরণার সাথে অনুরণিত হয় বা আপনার কল্পনাকে জ্বালাতন করে এমন যেকোনো জায়গা থেকে চুরি করুন। পুরানো ফিল্ম, নতুন ফিল্ম, মিউজিক, বই, পেইন্টিং, ফটোগ্রাফ, কবিতা, স্বপ্ন, এলোমেলো কথোপকথন, স্থাপত্য, সেতু, রাস্তার চিহ্ন, গাছ, মেঘ, জলের দেহ, আলো এবং ছায়া গ্রাস করুন। আপনার আত্মার সাথে সরাসরি কথা বলে চুরি করার জন্য শুধুমাত্র জিনিসগুলি বেছে নিন। আপনি যদি এটি করেন তবে আপনার কাজ (এবং চুরি) খাঁটি হবে। সত্যতা অমূল্য; মৌলিকতা অস্তিত্বহীন। এবং আপনার চুরি গোপন করতে বিরক্ত করবেন না—আপনি যদি এটি পছন্দ করেন তবে এটি উদযাপন করুন। যাই হোক না কেন, জিন-লুক গডার্ড যা বলেছিলেন তা সর্বদা মনে রাখবেন: ‘আপনি যেখান থেকে জিনিসগুলি নিয়ে যাচ্ছেন তা নয়—এটিই আসল যেখানে আপনি সেগুলি নিয়ে যাবেন।'” 

[মুভিমেকার ম্যাগাজিন #৫৩—উইন্টার, জানুয়ারি ২২, ২০০৪]

তাঁর এই সিনেমা শিল্পের নির্মাণের সঙ্গে রুদ্র কিংশুকের কবিতার নির্মাণেরও যথেষ্ট মিল আছে। রুদ্র কিংশুকও তাঁর সৃষ্টির মৌলিকতা দাবি করেন না। অথচ এক সত্যতার নিরীক্ষণ তাঁকে তাড়া করে। শূন্যতার স্পেস থেকেও তাঁর আত্মার উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। কাব্যের শুরুতে লেখেন : 

“বর্ষাস্মৃতি, চোখের ডানা, উড্ডীন সেতু, গাবতলা পার হই, যাদুবিন্দু গোঁসাইয়ের গান, হাতের তালুর ভেতর জাগে গান-ভিজে হাওয়া, তার আননান্তিক সংক্রমণ, হাত ক্রমাগত বৃষ্টির ভেতর, অতর্কিত মুথাঘাসের আলো, সুগন্ধি স্মৃতির জানালায় অকস্মাৎ জলপ্রপাত, থিরপারাপ্পু, কাজুর গাঢ় সূর্যাস্ত, তালপাতার আন্দোলন, মেঘের আলো-গান, বটের জটিল মেঘ, একাকী আঁধার, মনখারাপ খুব, আগামীকালের স্মৃতি নির্মাণ, নৌকা সারাইয়ের দৃশ্য, কেবল ভেঙে পড়া তেঁতুলফলের বেদনা, সরাল ওড়ে, তার ছায়া দেখি, ছায়ার রঙে ছায়াঘনতা, পাঁচলকি গ্রামের লালকাঁকর বৃষ্টিজল, যাদুবিন্দু গোঁসাই ডাকে, মাথার ওপর কম্পমান সরালহাঁস,” এলোমেলো কথাচর্চার ভেতর ক্রিয়াসংযোগের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে। কোথাও একমুখীনতা নেই। বিষয় ধরে চলা নেই। অথচ কিছু-না-কিছু থেকে গেছে, যে থাকা শূন্যতার মধ্যেও এক দিক নির্দেশের পরিভাষা হয়ে যায়। তাই কাব্যের শেষ অংশেও লিখলেন:”শূন্যতার ভেতরের যত রং তুলে আবার শূন্যতার ভেতর বপন করা, এইযে বাগানচর্চা, এইযে পাখিচর্চা, ভেতরে কোথাও কি কোনো ইঙ্গিত আছে? লেবু গাছটিকে বলি: ঈশ্বরের কথা বলো। তার ডালে ডালে ফুল উচ্ছলিত। ভাবনার ঝড় ওঠে, ডাল ভেঙে পড়ে, একটা মর্মর আওয়াজ। লাফিয়ে পড়া আবার সবকিছু ভুলে গিয়ে অক্ষরের কাছে ফেরা। জলের কাছে ফেরা, শেকড়ের কাছে ফেরা। কিন্তু ভেবে দেখো ফেরা ততটা সহজ নয়। আসলে প্রতিমুহূর্তে রাস্তার জ্যামিতি বদলে যাচ্ছে। ভাবনার ভেতরের ভারকেন্দ্র বদলে যাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। বজ্রপাতের আলোর তীব্রতা বদলে যাচ্ছে। পায়ের কাছে দূর্বাঘাস, মনের কাছে গন্ধরাজ ফুল ফুটে আছে। তাদের কাছে শূন্যতার কি কোনো কোনো অর্থ হয়? শূন্যতা একটা নির্মাণ, শূন্যতা আত্মজাত রঙের ভুবন….”

 শূন্যতার রং তুলে শূন্যতার ভেতরেই বপন করা আর এভাবেই বাগানচর্চা। পাখিচর্চা।কাব্যভুবনের এই পথেই কবির বোধ জেগে উঠেছে। কেন্দ্রবিন্দুর দিকে ঝুঁকেছে। দেশী-বিদেশী উপকথারাও ছায়া ফেলেছে। সোনালি গমের গানের সঙ্গে, আন্দ্রে জিদের লেখার সঙ্গে, দেবদূতের চোখের দৃষ্টির সঙ্গে, অতল হ্রদের ছায়ার সঙ্গে, গুহার গভীর আঁধারের সঙ্গে কবির সত্তা বিদীর্ণ ও বিস্তৃত। কিন্তু কোথাও পূর্ণতার অবিমিশ্র চিহ্ন নেই। ছায়া পুকুর মেঘ স্মৃতি কাজুবাদাম লোহালক্কর শেয়ালকাঁটা বর্ষা নদী টিয়াপাখি অ্যালবাম কানন কানচটা মৃৎপাত্র নাভিফুল লৌকিকতা  রং মাটি পাথর ছড়ানো আছে। দীর্ঘকবিতার কাব্যটির একটি অংশ কেটে নিয়ে যদি এভাবে সাজাই:

“রুদ্রাক্ষের গাছের কাছে একদিন দাঁড়াব,

 মাথায় রহুতা দিনের নীল ভরে উঠবে অতর্কিতে,

টিয়া-ঝাঁক ভাষাতীত শূন্যতা,

তার ভেতরে ঘূর্ণমান সেতু,

আমি প্রতিটি পাঠের শেষে উঠে দাঁড়াই…”

 তখন কবিসত্তাকে চিনতে আমাদের ভুল হয় না। মহাবিশ্বের স্থির বস্তুবাদকে উপেক্ষা করে যে সৌন্দর্য নন্দনতত্ত্বকে তিনি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন, তা অনাদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচয়। চক্রহীন উন্মুক্তির নৈরাজ্য। নিস্পন্দন নীরবতার ব্যাখ্যাহীন যুক্তিহীন শৃঙ্খলাহীন পর্যায়। তাই ভাষাতীত শূন্যতা, ঘূর্ণমান সেতু। কাব্যের আরেক জায়গায় লিখেছেন:

“শব্দ গেঁথে গেঁথে, অথবা ভাবনা গেঁথে গেঁথে আমি যে নৈরাজ্য তৈরি করি, তারও নীলিমা আছে, যা নীরবতায় স্পষ্ট হয়, পাঠযোগ্য হয়ে ওঠে, তার মুথাঘাসের ছেতরানো সবুজ, পরিব্যাপ্ত শিকড়, বিস্তীর্ণতা, বিশৃঙ্খলের শরীরে গভীর এক উড়ান রাখি,” তখনই বোঝা যায় যুক্তির শাসনহীনতা কতখানি সক্রিয় হলে এই গতি সঞ্চার হয়। ‘উড়ান’ শব্দটিতেই কবি স্থিরতাকে ভেঙে দেন। আধুনিকতাবাদকেও পরিহার করে নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক দার্শনিক চেতনায় চালিত হন। এখানে বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞানের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়।

     এভাবেই প্রচলিত রীতির কাব্যকলা থেকে দূরে একটি কাব্য সংগ্রহের অবিন্যস্তযাপন এই গ্রন্থে ধরা পড়েছে। চির অভ্যস্ত কবিতা পাঠকের কাছে এই কাব্য দুর্বোধ্য ও অপাঠ্য বলে বিবেচিত হবে। কেননা অবিন্যস্ত প্রসঙ্গক্রম, বিষয়হীনতা, বিচ্ছিন্নতা, ছন্দোহীনতা, বহুরৈখিক প্রতিস্পর্শী জ্ঞাপনের মাধ্যমে বিশেষণের স্বাভাবিকতাকে অস্বীকার করে জোড়শব্দের বিনির্মাণে যে ধারার প্রবাহ তাতে পদে পদে টক্কর খেতে হয়। বিষয় খুঁজতে গিয়েও হতাশ হতে হয়। তেমনি লক্ষ্যভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত হন। তবে অন্বয়গত সাদৃশ্য না থাকলেও, একটা ব্যক্তির যাপনক্রিয়ার ব্যাপ্তিকে মান্যতা দিতেই হয়। সেখানে বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, আঞ্চলিকতা, প্রাচীন ও নবীনের সমাবেশ কার্যত কালসীমাহীন এক জাদুকরের মিউজিয়ামে পরিণত করে। সেখানে যেমন সময়কে ছুঁতে পারি, তেমনি বস্তুকে, বস্তুর আকৃতিকে অর্থাৎ জ্যামিতিকেও। তেমনি ইতিহাস ও দর্শনেও সঞ্চারিত হতে পারি। ‘ইশপাদেবতা’র বাস্তবতা নিয়ে বিচার করার প্রয়োজন হয় না। তা ধারণাতেই স্থিত। আবার ধারণাকে ভেদ করলে লৌকিক ক্রিয়ায় তার উদ্ভবের বাস্তবতাকেও অনুধাবন করা যায়। ভাবনাকে বাস্তবতা দান করা, আবার ভাবনাকে অলৌকিকতায় পর্যবসিত করা সবই সম্ভব। সেই কারণেই কার্যকারণের উল্লঙ্ঘন ঘটালেও তা স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। বিনির্মাণে সবকিছু পাল্টে যেতে পারে। বাড়ি নির্মাণে ইট কাঠ পাথরের পরিবর্তে জীবন অর্থাৎ জীবনেরই দরকার হয়। জীবনের জানালা, জীবনের দরজা মোক্ষম হয়ে ওঠে। এই সচলতা, এই পাল্টানোর নিরীক্ষা ও গতিবিধি থেকেই পোস্টমডার্ন কাব্য চেতনা অবধারিত হয়ে ওঠে। সমগ্র কাব্য জুড়ে তাই একটাই কবিতা মুথাঘাসীয় সংযোগে আকীর্ণ হয়ে আছে।

🍂

ইশপাদেবতার সূর্যসন্ধান :রুদ্র কিংশুক, বার্ণিক প্রকাশন, কৈয়ড়, পূর্ব বর্ধমান-৭১৩৪২৩, প্রচ্ছদ: সম্পিতা সাহা, মূল্য ৫০ টাকা। 

রুদ্র কিংশুক
রুদ্র কিংশুক

Leave a Reply