Sader Ali

Sader Ali

ইংরেজি ও বাংলা ভাষার

বৃহৎ ছড়া গ্রন্থ:

জীবনবীক্ষারই পাঠ

🍁

তৈমুর খান

“আকাশ কোণে আলপনা রঙ

কে আঁকল ভাই

খালি খালি মেঘ গুড় গুড়

বৃষ্টির ফোঁটা নাই।

রামধনু রঙ করছে খেলা

ফুল পরিদের দল

খুশির জোয়ার দিকে দিকে

চারদিক ঝলমল।” (সূর্যরশ্মি)

এমন ছড়ার ইংরেজি অনুবাদ কী হবে?

কবি অনুদিত ছড়াটিও পাশাপাশি রেখে তা বুঝিয়ে দিলেন :

“The sky-comer is scarlet

Who one has painted that?

In the sky big clouds float in a row

No rain drop will fall now.

The flower nymphs play on

With rainbow colours vibrant

Toyous rapture every where

And everything is radiant.”

এভাবে একই সঙ্গে ইংরেজি ও বাংলায় সমান্তরাল ভাবে তুলে ধরেছেন গ্রন্থের ছড়াগুলি । কবি বাংলা ভাষায় গদ্য, কবিতা, কথাসাহিত্যের সব্যসাচী লেখক, যিনি শিশু-কিশোর থেকে বড়দের জন্যও তাঁর সৃষ্টিকে বিস্তৃত করেন । আমরা সেই স্রষ্টাকে কি সত্যিই চিনতে পেরেছি? হয়তো পারিনি বলেই তিনি আমাদের জগতে আরেকটি জগৎ নির্মাণ করে চলেছেন। সেই জগৎ-ও আমাদের বাল্য-কৈশোরের, আমাদের যৌবন-বার্ধক্যের, আমাদের মানবমহিমার স্বপ্ন-কল্পনার ভালোবাসার জগৎ। আমরা যেখানে আছি, আমরা প্রতিমুহূর্তে যা উপলব্ধি করি, আমাদের চেতনা যার দ্বারা প্রসারিত হয়, আমাদের জীবনদর্শন-মনন সূক্ষ্ম আলোড়ন তোলে—সেইসব জগতেরই দরজা খুলে দেন কবি । একজন আইরিশ ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, ছোটগল্পকার, মঞ্চ পরিচালক, কবি ও অনুবাদক স্যামুয়েল বার্কলি বেকেট (1906-89) বলেছেন: “Poets are the sense, philosophers the intelligence of humanity.”

অর্থাৎ কবিরা হলেন বোধ, দার্শনিকরা মানবতার বুদ্ধিমত্তা। এই দুইয়েরই সম্মেলনে তাঁর সৃষ্টি যুগোত্তীর্ণ মানুষের চেতনায় বিরাজ করে।

এতক্ষণ ধরে যাঁর কথা বলছি, তিনি মূলত সাতের দশকের কবি সাদের আলি।১৯৫০ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকল ব্লকের হিতানপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘ শিক্ষক জীবনের অবসান ঘটলেও লেখার জগতে তিনি সক্রিয়ভাবেই বিরাজ করছেন। ‘খুকির খুশি’ (প্রথম প্রকাশ কলকাতা বইমেলা ২০১৭) নামক একটি ছড়ার বই তিনি আমার হাতে তুলে দেন। বাংলা ভাষায় লেখা প্রতিটি ছড়ার ইংরেজি অনুবাদও করা হয়েছে। ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন অংশুমিতা চৌধুরী। বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে ৪২ টি করে ছড়া আছে বইটিতে। আবার প্রতিটি ছড়ার প্রাসঙ্গিক ভাবনায় ছবি বা অলংকরণও করা হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, কবি একাধারে ভাবুক, রুচিশীল, রোমান্টিক, পণ্ডিত ব্যক্তিও। ছড়াগুলিতে মানবজীবনের নানা বাঁক ও প্রাচুর্যের সম্মোহন আছে। আমরা যেমন আমাদের শৈশবকৈশারকে খুঁজে পাই, তেমনি আমাদের রূপকথার জগৎও চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়। শিশুমনের কষ্ট, অবহেলা, আনন্দযাপনের কথকতাও উঠে আসে ।যেমন : উড়োজাহাজ উড়তে দেখে শিশুমনের ভাবনা :

“আকাশের পথে পথে

ওড়ে কত যান,

সাদা মেঘ কালো মেঘ

হয় খান খান।

বাপরে কী গর্জন

কানপাতা দায়,

কত লোক দেশ থেকে

দূর দেশে যায়।

কোথা থেকে আসে আর

যায় কোন দেশে

যখন সে পৌঁছায়

রাত্রির শেষে।”

শিশুমনের প্রশ্ন ও উদ্বেগ একইসঙ্গে প্রতিফলিত হয়েছে। আবার রূপকথার জগৎও কবির লেখায় কম নয়। সেখানেও শিশুমন মুক্তির আহ্বান শুনেছে। কল্পনার জগতে যেতে যেতে তার আত্মবিশ্বাস ও আত্মবিকাশের পথ প্রশস্ত হয়েছে। ‘রাজকন্যার খোঁজে’ তাই লিখেছেন :

“পাগড়ি পরে ঘোড়ায় চড়ে

বলল এসে খোকা,

তেপান্তরে যাবেই সে আজ

যায় না তাকে রোখা,

তির ধনুক বর্শা নিয়ে

সজ্জিত সৈনিক,

অন্যদিনের মতো সে নয়

দেখি যা দৈনিক।

রাক্ষসকে নিধন করে

রাজকন্যা নিয়ে

ফিরবে ঘরে পক্ষীরাজে

আকাশ পাড়ি দিয়ে।

দেখবে তখন খোকবাবু

নয়তো শুধু একা।

বীর খোকনের পাশেই পাবে-

রাজকন্যার দেখা।”

ছড়াটি পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটি মনে পড়তে পারে। তবু বলব আমাদের শিশুরাজ্য অনন্ত ও অসীম। সেখানে প্রতিটি শিশুই সৈনিকের বেশ ধারণ করে রূপকথার জগতে পৌঁছাতে চায়। রাজকন্যাকে উদ্ধার করার সংকল্প তার। আমাদের পরিবেশ পরিস্থিতি ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছে বলে আমাদের শিশু-কিশোরেরা তাদের এই জগৎকে হারিয়ে ফেলছে। একে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের,কবি এই কাজটিই করেছেন। ছড়ায় ছড়ায় তিনি বর্ষাকাল চিনিয়েছেন। গ্রাম চিনিয়েছেন। আকাশ সূর্য নক্ষত্র চিনিয়েছেন। মানুষকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন। ফেরিওলা, পায়রা, ক্রিকেট, রথের মেলা, পাখি, ট্রেন, গ্রীষ্ম, বর্ষা, বসন্ত চিনিয়েছেন।নান্দনিক জীবনযাপনের কত আলো-আঁধারির ছায়াপাতে যে বাস্তব ও কল্পনা এসে মিশেছে এবং তা ছন্দোবদ্ধ হয়েছে তা দেখলেই বোঝা যায়। তাতে কবির জীবনবীক্ষারই পরিচয় পাই। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষার অনুবাদ পড়তে পড়তেও পাঠক আকৃষ্ট হবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিটি সাবলীল অনুবাদ সহজ অথচ যথাযথ। অনুবাদককে ধন্যবাদ।

🍃

খুকির খুশি : সাদের আলি,

প্রগতি প্রকাশনী, বহরমপুর,

মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ,

ভারত।মূল্য ২০০ টাকা।

ছবিতে সাদের আলি

Sader Ali

সাদের আলি

আলোচক ড. তৈমুর খান

Leave a Reply