
ব্রজ রহস্য
সন্দীপ ঘোষাল
ব্রজ শব্দের অর্থ ব-রজ , রজহীন অর্থাৎ প্রকাশহীন বা বিরজার পার বুজতে হবে । ব্রজধাম ৮৪ ক্রোশ। তার বাইরে বিরজা । বৃন্দাবন ব্রজধামের অন্তর্গত । ব্রজে সানি নেই – শান্তি আছে ব্রজের বাইরে , ব্রজে সর্বদা আন্দোলন চলছে । এই আন্দোলন সংকোচ ও প্রসার নয় – এর মুলে আছে যোগমায়ার প্রভাব ।ব্রজধাম বস্তুতঃ মাধুর্য্যধাম, এখানে গেলে আর ফিরে আসে না ।বৈকুন্ঠ ও কৈলাশ ঐশ্বর্য্যস্থান- এই দুটি স্থান ব্রজের বাইরে । বৈকুন্ঠ ও কৈলাস থেকে ফিরে আসবার সম্ভাবনা থাকে ।কিন্তু ব্রজভূমিতে প্রবেশ করলে আর ফিরবার প্রশ্ন থাকে না ।ব্রজে যাবার একমাত্র উপায় শরণাগতি – এই স্থানে কেউই কর্ত্তা
নয় ।জ্ঞানীদের স্থান বৈকুন্ঠ ও কৈলাস , যাদের অধিষ্ঠাতা বিষ্ণু ও রুদ্র ।শান্তিধাম ব্রজলক , হলো নির্ব্বান পদ । নির্ব্বানে স্বভাব নেই , কিন্তু ব্রজে স্বভাবের প্রাধান্য ।বৃন্দাবনের অধিষ্ঠাত্রী বৃন্দাদেবী , তারমধ্যে বামে নিধুবন ও দক্ষিণে নিকুঞ্জবন ।নিধুবনের কর্ত্রী ললিতা ও নিকুঞ্জবনের কর্ত্রী বিশাখা ।বিশাখা মানে শাখাশূন্য এবং নিকুঞ্জবন কুঞ্জহীন অর্থাৎ অংশ বা অবয়বহীন ।
শান্তি চাইতে নেই । শান্তি ও অশান্তি উভয়ই ভাব , স্বভাব নয় ।প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি , করা ও না করা , সবই কর্তৃত্বমূলক।প্রার্থনাটি ত্যাগ করতে হবে ইচ্ছা বা কামনা থাকতে ব্রজে গমন হয় না ।ব্রজবাসীদের শান্তির প্রয়োজন হয় না , কারণ সেখানে স্বভাব আছে ।স্বভাবী ঈশ্বর, আত্মা , ভগবান ।।
দেহই ব্রজধাম
সন্দীপ ঘোষাল
স্থির বায়ুকে গোলক বলে , চঞ্চল বায়ুকে ময় বলে । চঞ্চলটি দ্বাদশ আঙ্গুল পর্যন্ত , তাই দ্বাদশ আদিত্যই জগৎ ।
এই দেহই ব্রজধাম । দেহ ৮৪ আঙ্গুল , ব্রজধাম ৮৪ ক্রোশ , এর মধ্যে ১৬ ক্রোশ মথুরা , ভিতরে পঞ্চ ক্রোশ বৃন্দাবন ।কেন্দ্রমধ্যে নিকুঞ্জ ভবন – নিকুঞ্জ মানে কুঞ্জরোহিত বা অংশহীন ।ব্রজে শান্ত ভাব নেই , এখানে শুধু দাস্য ,সখ্য , বাৎসল্য ও মাধুর্য্যের খেলা আছে ।একমাত্র শ্রীরাধাই সমস্ত ভাবের খনি ।সখীগণের দ্বারাই যোগমায়ার বলে রাধাকৃষ্ণের মিলন ও বিরহ সংগঠিত হয় ।
ব্রজে কারো কর্তৃত্ব নেই – রাধারও নেই , কৃষ্ণেরও নেই বা সখীদেরও নেই । যোগমায়ার প্রভাবে স্বভাবতই সব চলছে ।যেমন বায়ু বইলে গাছের পাতা বা কাপড় ইত্যাদি কম্পমান হয় ,সেখানেও তেমনি আপনি আপনিই সব স্বভাবের বলে হয়ে থাকে ।কর্তৃত্ব থাকলে অর্থাৎ অনুগত বা শরণাগত না হলে ব্রজে প্রবেশ করা যায় না ।শান্ত ভাবও ব্রজের বাইরে । ঐ স্থানে চতুঃসন অর্থাৎ সনক সনন্দন প্রভৃতি অবস্থান করেন ।সপ্ত ঋষিরও ঐ স্থান ।জ্ঞানবলে ঐ স্থান পর্য্যন্ত যাওয়া যায় । ঐ স্থানে অহংকার আছে , কারণ ঐখানকার বোধ প্রয়োজনের অভাববোধ ।অর্থাৎ ‘ আমার প্রয়োজন নেই ‘ এ প্রকারের বোধ ওখানে স্বাভাবিক ।
জীবদেহে নিত্য লীলার অথবা নিত্য রূপের দর্শন হয় না ।যা দর্শন হয় তা ভূতের ছায়া – স্বপ্নদর্শন মাত্র ।যতক্ষণ বিক্ষিপ্ত ভাব থাকে ততক্ষন জীবভাব আছে জানতে হবে ।অনন্যচেতা হলে জীবভাব থাকে না , তা শিবভাবে পরিণত হয় ।ঐ অনন্যচেতার দেহ জীবদেহ নয় ।ঐ দেহের মৃত্যু নেই ,তিরোভাব আছে মাত্র ।নিত্যরূপ চিন্মরূপ । তার দর্শন হলে আর তাঁর থেকে চক্ষু ফিরিয়ে নেওয়া যায় না । বজ্রপাত হলে যেমন তড়িৎ প্রবাহ আমাদের তড়িৎকে টেনে নেয় , তেমনি নিত্যস্বরূপ আবির্ভূত হলে আমাদের আকর্ষণ করে নেয় ।অন্যদিকে যাবার সামর্থ্য থাকে না , একেবারে তাঁর নিজের করে নেয় ।
মন বুদ্ধি ও প্রাণ যখন এক হইয়া যায় , তখন বুদ্ধি থাকে না বলে বিচার থাকে না ! তাই তাঁহাকে পেলে ” আমি পেয়েছি ” এই প্রকার বোধ থাকে না ! চিনি তো চিনির আস্বাদন জানে না !
সে রাজ্যে কাম গন্ধ নেই – কাম থাকতে সে রাজ্যে গমন হয় না ! যখনি কামের উদয় হয় তখনি যোগমায়ার প্রভাবে পতন হয় , কারণ কাম উৎপন্ন হয়ে সেখানে থাকতেপারে না , নেমে পড়ে ,কিন্তু সব ভাবই সেখানে উঠে তাতে সন্দেহ নেই ! কাম বলতে নিজের তৃপ্তির জন্য ইচ্ছাকে বোঝায় !
সেখানে কাম -বীজ আছে , অর্থাৎ ইচ্ছা অবগুন্ঠিত হয়েছে ।। ইচ্ছার দুটি অবস্থা – একটি সংকোচ , অপরটি প্রসার । এই সংকোচ কে কামবীজ বলে । ” শ্রীকৃষ্ণের যা ইচ্ছে তাই হোক ” এই ইচ্ছেকে কাম বলে না ।। তাই একে কাম বীজ বা অপ্রাকৃত কাম বলে । এর প্রসার হলে শাখাপ্রশাখাদি ভেদ- পরিনাম হয় -এটাই সংসার ।বস্তুতঃ শ্রীকৃষ্ণেরও ইচ্ছে নেই – যোগমায়ার প্রভাবে তা জন্মায় মাত্র ।সঙ্গে সঙ্গে শ্রীরাধাতে ইচ্ছার উদয় হয় , সখীগণ তাই ধরে দেয়।
প্রতি ভাবই অনন্ত বুজতে হবে ।দাস্য অনন্ত প্রকার , সখ্য অনন্ত প্রকার ইত্যাদি ।অনুগত হলে অণুর গতি অথবা সূক্ষ্মগতি হয় ।নিজে অণু হলে কর্তৃত্ব থাকে না – দাস্যভাব জেগে ওঠে । চৈতন্যকণা অনন্ত চৈতন্য সাগরে প্রবেশ করে ,- সবই চৈতন্যময় হয়ে যায় ।কিন্তু ভাবটি থাকে ,সেটা তখন স্বভাবে পরিণত হয় ।। তখন সকল অভাব মিটে যায় । কারণ পূর্ণের মধ্যে সবই পূর্ণ – প্রতি ভাবই যেখানে স্বভাব সেখানে প্রতি ভাবই পূর্ণ । সেইজন্য সেখানে কাম আর জাগে না । অপূর্ণভাবে স্বভাবে স্থিতি হয় না বলেই এতো ছোটাছুটি ।নিরংশ বস্তুর অংশ কল্পিত । প্রতি অংশই পূর্ণ – যেমন আকাশ । গৃহাবিচ্ছিন্ন আকাশ জেম পূর্ণ গৃহস্থ ঘটাবছিন্ন আকাশও তেমনি পূর্ণ ।।