Satyen Mondal

গল্প : সুধাময়ের কথা
সত্যেন মণ্ডল

শহরতলির এই পুরানো চারতলা বাড়ির পশ্চিমের জানলাটা সুধাময়ের বেশ পছন্দ। আজ এটাই তার একমাত্র বন্ধু । জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সুধাময় উপলব্ধি করতে পারে প্রকৃতির থেকে বড় বন্ধু আর নেই। মাথার উপর আকাশ দেখতে লাগে বেশ। অপূর্ব ! সেখানে সর্বদা চলে মেঘের লুকোচুরি। তার বুকে কত রঙের খেলা চলে । দূরের কৃষ্ণচূড়া বাবলা , পলাশ আর ঝাউ যেন কত কাছের , তাদের হৃদয়ে যেন উদারতার ঢেউ ,তারা যেন বড় আপন ।

” আপন” শব্দটা কেন যেন সুধাময়কে বিষণ্ণ করে দেয়। সারাজীবন কাকে না সে আপন ভেবেছে, স্ত্রী,পুত্র কন্যা, জামাই,পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি আর জনগণ ! যারা প্রত্যেকে স্বার্থ বুঝে নিয়ে সুধাময়কে ত্যাগ করেছে, একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে সুধাময়ের, সে ছিল এককালের ডাকসাইডের রাজনৈতিক নেতা । সমাজ সচেতন,নতুন ভারত গড়ার স্বপ্ন ছিল তার দু -চোখে। ছিল আদর্শ, আদর্শের জন্য সরব থেকে সব কিছু ত্যাগ করবেন এই স্বপ্নে তখন বিভোর হয়ে থাকতেন।

সুধাময় এখন আর পাঁচ জনের মতো সাধারণ মানুষ ,যে দলের জন্য সারাজীবন ত্যাগ করে এলেন ,সেই দল তাকে দুর্নীতির অভিযোগে একঘরে করে দল থেকে সাসপেন্ড করেছে। তার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির প্রশ্ন তুলে চেয়ার কেড়ে নিয়েছে। মানুষের জীবনে চেয়ার এর মূল্য অপরিসীম। এখন গণমাধ্যম গুলোও তাকে গুরুত্ব দেওয়া ভুলে গেছে , চেয়ারহীন নেতার মূল্য থাকে চেয়ারেই, এই সারসত্য এখন বুঝতে পারছে সুধাময় বয়সের ভারে সুধাময় এখন মনের দিক থেকে পঙ্গু।নিঃস্ব রিক্ত অসহায়, কেউ নেই তার খোঁজ খবর নেওয়ার, কেউ নেই যে তার সঙ্গে মনের দুটো কথা বলে সুধাময়, নিঃসঙ্গ জীবন ! নিঃসঙ্গ জীবনের যন্ত্রণার কথা ভুক্তভোগী ছাড়া কে বোঝে !

জানালার ধারে এখন সুধাময় একা বসে ,অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে চলেছে । পশ্চিমের আকাশে কাল মেঘ জমছে ; বেশ কিছুদিন বৃষ্টি হয়নি ।
সকাল ন’টা হতো চললো এখনও ঠিকে ঝি টা আসেনি, তাই চা খাওয়াও হয়নি । ঝি’টা যে কি করে—– সুধাময় শুনেছে ,ঝি’ টার নাকি দুবার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু দুই স্বামীই ওকে নিয়ে ঘর করেনি ,ছেলেমেয়েও হয়নি,বছর চুয়াল্লিশের ঝি’টা গায় গতরে এখনও বেশ তরতাজা,মুখে লালিত্যের ছাপ,বর নাই থাক ওর নতুন বরের অভাব নেই।

ঝি মল্লিকা এসে বাইরের দরজার কড়া নাড়া দেয়, বাবু,বাবু—- সুধাময়ের সম্বিত ফেরে,গিয়ে দরজা খোলে ; সামান্য ঐ টুকু পরিশ্রমেই হাঁপাতে থাকে,ক্লান্ত বোধ করে ।

মল্লিকা ঢুকতে ঢুকতে বলতে থাকে,বাইরে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে দাঁইরে আছে,আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
সুধাময়ের মনে পড়ে ,কদিন আগে কারা যেন ফোন করে জানিয়েছিল, ওর ইন্টারভিউ নিতে চায় তারাই বোধহয় এসেছে। ঠিক তাই, এক তরুণ যুবক আর এক তরুণী ঘরে ঢোকে,পেশায় তারা সাংবাদিক, বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র থেকে তারা আসছে। তারা চেয়ারে বসে।

সুধাময় ওদের দিকে তাকায়, তরুণী বেশ সুন্দরী, জিন্সের প্যান্ট এর সঙ্গে মানানসই টপ পরার জন্য ভিতরের শরীরটা বেরিয়ে আসতে চাইছিল,তার সঙ্গে চড়া মেকআপে দৃশ্যতই ‘এপিল তুলছিল।

লিপস্টিক,গগলস,হাইহিল জুতার সঙ্গে মানানসই ডানহাতের সোনালী ফ্রেমের ঘড়িটা দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। মনে হচ্ছিল তরুণী এমন পোশাকেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে। তুলনায় তরুণের পোশাক সাদামাটা,কলারওলা হাফহাতা গেঞ্জি আর টেরিকডের ফুলপ্যান্ট, পায়ে খয়েরি রঙের বুট।
তরুণের রিস্ট ওয়াচ বিদেশী ব্যান্ডের, কাঁধে কাল রঙের সুদৃশ্য ব্যাগ আর একটা দামি ক্যামেরা ।

এসব দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সুধাময়, যুবতীটির কথায় ঘোর কাটে। সে বলে
এ প্রজন্মের ছেলেমেয়ে আমরা, চিন্তাভাবনা মানসিকতায় আপনার সঙ্গে আমাদের মিল হবেনা,তবু আপনার সম্পর্কে সবকিছু জেনেও কৌতূহল বশতঃ দু একটা প্রশ্ন করতে চাই।
সুধাময় তাকায়,যুবতীটি বলে,দেখুন রাজনীতিতে নেতার ভূমিকা অনস্বীকার্য কিন্তু যোগ্য নেতার সত্যিই অভাব যুগে যুগে লক্ষ করা গেছে বিশেষতঃ প্রতিনিধিত্ব মূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্হায়, এর কারণ কী ? স্বাধীনতা বা প্রগতিশীল বিভিন্ন আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়ে নেতা হয়েছিলেন তাদের সঙ্গে আজকের জনপ্রিয় নেতাদের মৌলিক পার্থক্য কী ? নেতা কি সবাই হতে পারে ?

সুধাময় বলে,দেখো নেতা হওয়া চাট্টিখানি কথা নয় ! নেতা হবার গুণ যোগ্যতা ক্ষমতা ব্যক্তিত্ব এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সবার থাকেনা।সবাই চাইলেই নেতা হতে পারেনা। প্রকৃত নেতা জনপ্রিয় হন,ঐটার মধ্যেই লুকিয়ে তার কৃতকর্মের পরিচয়,অতএব কে যোগ্য আর কে যোগ্য নয়, সেটা উপলব্ধি করতে পারছ ; শেষে বলি ,প্রকৃত নেতার যুগে যুগে মৌলিক পার্থক্য থাকেই, তবে আমি মনে করি সমসাময়িক কালে প্রকৃত নেতা হওয়া বড় কঠিন কাজ, আগে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতা সৃষ্টি করার অনুকূল পরিস্থিতি ছিল, এখন প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করতে হয় যা কঠিন চ্যালেঞ্জ ।

কেমন ?ধরো ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে সমস্ত নেতারা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছেন তারা প্রত্যেকেই পরাধীন ভারতবাসীর প্রত্যক্ষ এবং নৈতিক সমর্থন পেয়েছেন, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই, নেতা হবার অনুকূল পরিস্থিতি ছিল, এখন সব মানুষের মধ্যে কি সমর্থনের প্রশ্নে ঐ পরিস্থিতি আসবে ? না।স্বাভাবিক কারণে আমার মত আজকের সময়ে প্রকৃত জনপ্রিয় নেতা হওয়া বড় কঠিন। তাই সবাই সফল হতে পারছেনা। তাছাড়া কি জান ? রাজনীতির মোদ্দা কথা ত্যাগ এর মানসিকতা,সেটার বড় অভাব।

এ সময় মল্লিকা চা নিয়ে আসে,আড়চোখে যুবতীটির দিকে তাকায় ,তারপর সবাইকে চা দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে যায়।

এরপর যুবকটি বলে, দেখুন দেশ দশের জন্য যিনি সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত রাজনীতিতে তার প্রয়োজন আছে অস্বীকার করছিনা,কিন্তু ব্যক্তি স্বার্থ ত্যাগ করে মা মাটি এবং মানুষের জন্য সবাই কীভাবে রাজনীতি করবে ? স্বার্থ চিন্তাই তো রাজনীতিতে ক্ষমতায়ণ আর দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে, এটা আপনি অস্বীকার করেন কিরূপে ?

সুধাময় বুঝতে পারে এরা আসলে কোন দিকে ইঙ্গিত করতে চাইছে ! এই যে আপনার রাজনৈতিক দল ,এমন অভিযোগ এনে আপনাকে কাঠগড়ায় তুলেছে,এসম্পর্কে আপনার মতামত কী ?
আপনি এ বিষয়ে চুপ থাকেন কেন ?
সুধাময় ঠিক করে, গোপন সত্যটি আজ পাবলিক করার মস্ত সুযোগ এসেছে তা আজ সে আর গোপন রাখবেনা,
দেখো,দেশ গড়ার স্বপ্ন এবং দেশের মানুষের সাধারণ ভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন পূরণের জন্য রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় আমার আগমন ঘটে
দীর্ঘদিন আগে,মনে করতাম মহত কিছু করার ব্রত নিয়েছি ; যদিও জানতাম এই ক্ষমতা সর্বস্ব দলীয় রাজনীতি, মানুষকে একটু কম,একটু বেশি রিলিফ দিতে পারবে মাত্র, মৌলিক সমস্যার কিছু করতে পারবে না ,তবু রাজনীতিতে যাই,তারপর সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে শুধু ওঠা ,জনগণ কখনও আমাকে যা ভাবেনি ,তাই দল ভাবতে থাকে ! এটা আমার রাজনৈতিক জীবনের কলঙ্ক হয়ে ক্রমে ক্রমে আমাকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে চলেছে ; হায় !
এতক্ষণ সুধাময় এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকে। অসুস্থ বোধ করে ।
হঠাৎ ঝি মল্লিকা এসে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে,বাবু অসুস্থ, আপনারা আসুন, বড় বড় কথা শোনেন আর লেখেন, তা কে পড়ে ? পরে সুধাময়ের দিকে চেয়ে বলে,আপনাকেও বলি,যাদের জন্য এতকিছু করেছেন তারা তো কেউ আপনার দিকে ফিরে তাকায় না ! দেশ,দেশের মানুষ ! আত্মীয় পরিজন ! যাদের আপন ভেবে এতকিছু করেছিলেন, তারা কেউ আপন ? আপন বলে কিছু আছে ?
সুধাময় দীর্ঘশ্বাস ফেলেন,উদাস চোখে জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন এক ঝাঁক সাদা পায়রা উড়তে উড়তে কোন দিগন্তে হারিয়ে গেল। ইতিমধ্যে পশ্চিম আকাশের মেঘটা আরও গাঢ় হয়েছে।

Leave a Reply