
রম্য রচনা : ছন্নছাড়া খেয়ালী সংঘের ভাবলুদা
( প্রথম পর্ব )
সত্যেন মণ্ডল
আমাদের পাড়ার ভাবলুদাকে সবাই একবাক্যে চেনে । ছোট বেলা থেকেই নাকি ন’কাকার সঙ্গে ভাবলুদার ভাব,আমাদের বাড়ি আসত, কিন্তু আমরা তেমন চিনতাম না। ভাবলুদার আসল নাম ভূদেব ভাদুড়ি কিন্তু তার আসল নাম ভুলে সবাই এখন তাকে ভাবলু বলে ডাকে । ন’কাকার সঙ্গে ভাবলুদার ভীষণ ভাব,তাই কারণ টা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ন’কাকা বলেছিলেন, ভূদেব সব কথা ভাবসম্প্রসারণ হবে এমন লাইন তুলে বা বাক্যে বলে ,সেজন্য আমরা ওকে মিষ্টি করে ভাবলু বলে ডাকি,অবশ্য সব সময় ঠিক পঙক্তি বা বাক্য বলে তা নয়, তবুও বলে ; শুনে আমার আঙ্কেল গুড়ুম ! বলে কি ! সব ভাবসম্প্রসারণ দিয়ে কথা বলে !
যে সমস্ত কথাই ভাবসম্প্রসারণ হতে পারে, এমন বাক্য বা পঙক্তির সাহায্যে বলে,তার কথা বলা কেমন ? কিভাবে বলে ? শুনতে নিশ্চয়ই মজা লাগবে ; বেশ কৌতূহল হল। শুনেছি,ভাবলুদা যেমন কথা বলে হাসাতে পারে, আবার নিজে মুখের ভাবটা গোপন রাখতেও পারে। ভাবলুদার কথা শুনতে চাই বলে ন’কাকার কাছে আবদার করলাম ; ন’কাকাকে হাত পা ম্যাসাজ করে দেবার পর অবশেষে ভাবলুদার কথা সরাসরি শোনার সুযোগ করে দেবেন জানালেন।
পরের দিন বিকালে ন’ কাকা বললেন, নে সাজুগুজু করে নে, এখুনি ক্লাবে যাবো। আমাদের ক্লাবে আজ সভা আছে ভাবলু আসবে, কিন্তু খবরদার চাঁদ ! তুমি যেমন বিচ্ছু, চুপচাপ আমার পাশে বিড়ালের মতো বসে থাকবে ,কথাটি বলবে না। কথা যদি বল ,কান ধরে হিড় হিড় করে ক্লাব থেকে বাইরে বার করে দেবো। অগত্যা —– যথা সময়ে পরের দিন ন’কাকাদের ক্লাব ” ছন্নছাড়া খেয়ালী সংঘে “উপস্থিত হলাম। ক্লাবের এমন নাম বাপের জন্মে শুনিনি, যত সব পাড়ার ছন্নছাড়াগুলো , খেয়াল খুশি মতো কালীপুজো,সরস্বতী পুজো এবং অন্যান্য পুজোর আগে মিলিত হয়ে,লোকের গ্যাঁট কেটে পূজা করার আছিলায় এবং টু প্রাইস পকেটে ফেলার ধান্দায় ক্লাব গড়ে তোলে ,তাই এমন নাম। নাম দেওয়ার পিছনে কার যে মাথা খেলেছিল কে জানে ? এ নিয়ে আমরা বন্ধুরা আড়ালে বেশ মজা করি, ওদের কাউকে দেখলেই আস্তে আস্তে বলি, ছন্নছাড়া ! একদিন হাসাহাসি করতে গিয়ে প্রায় ধরা পড়ে গিয়েছিলুম ; সেবার একটুর জন্য রক্ষা পাই, নইলে ভজা বলে এক সদস্যের কড়া চড় খেতুম।
ক্লাব ঘরে তখনও সব সদস্য আসেনি, মাত্র জনা চারেক সদস্য উপস্থিত ছিল, তাই সভাও শুরু হয়নি। আমি ন’কাকার পাশে একটা বেঞ্চে চুপচাপ বসে রইলাম, যে কজন ঘরের মধ্যে ছিল তারা কোন একটা বিষয়ে আলোচনা করছিল, মনে হল বেশ গরম আলোচনা,ওদের মধ্যে কে একজন বললো, দেখিস খগেন, ওদের একটাকেও আমি ছাড়বো না, আমার নামে কুৎসা রটনা ! শয়তানদের কেমন জব্দ করি—- বলতে বলতে ভাবলুদা ক্লাব ঘরে প্রবেশ করলো এবং চেয়ারে বসতে বসতে যে ঐ কথাগুলো বলছিল তার উদ্দেশ্যে বললো, “কুকুরের কাজ কুকুর করেছে কামড় দিয়েছে পায় /তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে মানুষের শোভা পায় ?”
দেখলাম বেশ লম্বাটে গড়ন ভাবলুদার, মাথায় ঘন বড় বড় একরাশ কালো চুল ,পরে রয়েছেন একটা পাঞ্জাবী আর ফুলপ্যান্ট, মুখের গড়ন বেশ মিষ্টি, হালকা দাড়ি, কণ্ঠস্বর বেশ গম্ভীর।
যার উদ্দেশ্যে ভাবলুদা কথা গুলো বললেন তার নাম হরেন, সে বলে ,তুমি জাননা ভাবলুদা,ওদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন, পীড়ন না করলে ওরা শায়েস্তা হবে না। ভাবলুদা মাথা নাড়তে নাড়তে ধীর স্বরে বললেন, “যুগের ধর্ম এই,পীড়ন করিলে / সে পীড়ন এসে পীড়া দেবে তোমাকেই। “
হরেন বলে, কিন্তু ভাবলুদা, ওদের বগাটা আমার নামে কুৎসা রটিয়ে যাচ্ছে,আমার অসহ্য লাগছে।
ভাবলুদা বলেন, “পেঁচা রাষ্ট্র করি দেয়, পেলে কোন ছুঁতা / জাননা সূর্যের সাথে আমার শত্রুতা !”
তাহলে কি ওদের অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করবনা ? ভাবলুদা বলেন, “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে / তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।”
এবার আর সহ্য করতে না পেরে হরেন চিৎকার করে ভাবলুদার উদ্দেশ্যে বলে, খুব তো বড় বড় কথা বলছো, জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছো, ওই শত্রুগুলোকে আমি ছেড়ে দেব ? ভাবলুদা ভারিক্কি চালে মাথা উপর নীচ করতে করতে বলেন, “সেই লড়াই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে লড়াই / যে যুদ্ধে ভাইকে মারে ভাই। “”একটু থেমে আবার বলেন, “জীবে প্রেম করে যেই জন / সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। ” ন’ কাকা ফোড়ন কেটে বলেন, আশাকরি বুঝতে পেরেছিস, ক্ষমা করতে শেখ, ক্ষমা পরম ধর্ম, গীতায় বলেছে—– তুই চুপ কর ; বলে , হরেন চেঁচিয়ে ওঠে।