Satyen Mondal

কালো মেঘ
সত্যেন মণ্ডল

সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেল সুনন্দার,সারারাত একটা বিশ্রী স্বপ্ন ওর ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করেছে,তাই শরীরটা তেমন তরতাজা লাগছেনা ; মাথার চুল গুলো সব এলোমেলো হয়ে কপালের ঘামের সঙ্গে লেপ্টে জড়িয়ে রয়েছে,তাড়াতাড়ি নিজেকে প্রস্তুত করে দরজাটা খুলে পা বাড়ায় সুনন্দা।

সকালের এই শান্ত পরিবেশটা ওর ভালোই লাগে,চারদিকে পাখির কূজন,গাছের পল্লব থেকে শিশিরের ঝরে পড়ার টিপ টিপ শব্দ ,দেবদারুগাছের উপর বাদুরদের দোদুল্যমান ঝটপটানি ওকে নির্বাক করে দেয়।শরতের রূপের অন্য একটা বৈশিষ্ট্য আছে বলে ও মনে করে। আসলে সকালের এই শান্ত স্নিগ্ধ রূপটা

সকলের চোখে পড়েনা বলে তারা ঠিক এর সৌন্দর্য অনুভব করতে পারে না । এই বাড়িতে আজই বোধহয় সুনন্দা শেষ দিন কাটাচ্ছে ,জীবনে আর কখনও এখানে আসা সম্ভব হবে বলে সুনন্দা মনে করেনা। এই বট,পলাশ ,শিউলি আর পাখির কূজন আর দেখাও হবেনা ,শোনাও হবে না।

এই রাঙামাটির রাস্তা দিয়ে প্রিয় প্রেমিক অরিন্দম এর হাত ধরে ও চলে যাবে একেবারে, শুধু প্রেমের জন্য ! প্রেমের জন্য কি না করে মানুষ ! প্রেম হল মানসিক বৃত্তি, ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ লুপ্ত হলে তবেই তো সৃষ্টি হয় প্রকৃত প্রেমের ! আর তার জন্য মানুষ প্রেমাষ্পদকে পাবার জন্য সব ছাড়বে বৈকি !

অরিন্দম বলে,মানুষ যতই রূপবান হোক না কেন হৃদয়ে প্রেম না থাকলে সে অন্ধ ; আর মানুষ যতই অন্ধ হোক না কেন হৃদয়ে প্রেমের সঞ্চার ঘটলে সে চক্ষুমান বা চক্ষুমতী হয় । এখন সুনন্দা নিজেকে চক্ষুমতী ভাবে। তাই সে বাঁধ ভাঙ্গা স্বপ্নজাল বুনে চলেছে ।

অবাক হয়ে সুনন্দা পাখিদের দিকে তাকিয়ে ছিল,তারা এসে ডালে বসে গান করল,তারপর উড়ে যে কোথায় চলে গেল আর দেখতে পেলোনা হয়তো এ জায়গায় ওরা আর ফেরেনা, আবার অন্য কোথাও বাসা বাঁধে ; যাযাবর জীবনে দুঃখ আছে ঠিকই কিন্তু তার একটা নতুনত্বও আছে।

—কি রে সুনন্দা ,তোকে বাড়িতে খুঁজছিলাম আর তুই এখানে ? পিছন ফিরে সুনন্দা দেখে, ওর বন্ধু রূপা দাঁড়িয়ে, মুখে যেন যুদ্ধ জয়ের তৃপ্তির হাসি, অবাক চোখে রূপার দিকে তাকায়, ব্যাপার কি ? হঠাৎ সাত সকালে আমার কাছে ?

—না তোকে বলতে এলাম, আজ তো শেষ দেখা ! চলে যাচ্ছি বুঝলি—–
জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় সুনন্দা ।
কেন, তুই জানিস না ?

অরিন্দম এর সঙ্গে মুম্বাই যাচ্ছি । ওখানেই বিয়ের পর্ব টা সাঙ্গ করবো, আর কতদিন ফেলে রাখি বল ? এই দুবছর চলছে।
কার সঙ্গে যাচ্ছিস বললি ?– সুনন্দা চমকে ওঠে ।
আরে, অরিন্দমের সঙ্গে ; মাঝে করে তো ওর সঙ্গে বেশ লটর পটর করতিস ! আমি ভাবতাম তুই বোধহয় ওকে কেড়ে নিবি, না তুই পারলিনা ; ওকে পটানোর রূপ কি তোর আছে ? চলি, বাই দি বাই তোকে ফোন করবো ।

রূপা ওর উত্তেজক শরীরটা দু একটা মোচড় দিয়ে চৌষট্টি কলার দু একটা সুনন্দাকে দেখিয়েই চলে গেল। সুনন্দার ইচ্ছে যাচ্ছিল রূপার চুলের মুঠি ধরে জিজ্ঞেস করে, কে কাকে কেড়ে নিল ? তুই, তোর মা বাপ সবাই অরিন্দম কে কেড়ে নিলি, তোদের পয়সা,আর তোর পুরুষ ধরা রূপের কাছে অরিন্দম পুড়ে ধ্বংস হবার জন্য পা বাড়াল, নির্বোধ একটা–!

বোবা কান্নায় আর অব্যক্ত যন্ত্রণায় সুনন্দা আকাশের দিকে তাকাল। সকালের মনোরম পরিবেশটা ওর বড় করুণ বলে হল , অবচেতনে শুনতে পেল অরিন্দমের কণ্ঠস্বর, সুনন্দা তৈরি থেকো ,কাল তোমাকে নিয়ে মুম্বাই চলে যাবো !
চেতনা ফিরতে দেখলো আকাশটা ইতিমধ্যেই কালো মেঘে ঢেকে গেছে, ও খেয়ালই করেনি ।
আকাশ ভাঙা বৃষ্টি বোধহয় নামবে।

Leave a Reply