Shapla Barua

শাপলা বড়ুয়া

ঘুরপথ
শাপলা বড়ুয়া

সেই কখন থেকে কাঠের চেয়ারে আনমনে বসে আছে নীলা। চোখের কোণে বিষন্নতার ছাপ লেপ্টে আছে যেনো! নিজের সাথে নিজেরই বোঝাপড়া যেনো ত্রিশোর্ধ এক রমনীর, ‘সুমন্তকে সবসময় এড়িয়েই গেছি আমি। আগ বাড়িয়ে সে-ই বন্ধুত্বে জড়িয়েছে। নানান ছুতোয সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে গেছে ও। যে সম্পর্ককে একদিন আমি তীব্রভাবে দূরে ঠেলে দিতে চেয়েছি, কিভাবে ওর সাথে বিয়েতে জড়িয়ে পড়লাম আমি !’ ভাবতে ভাবতে তীব্র যন্ত্রণা দলা পাকিয়ে পাকিয়ে বুকের মধ্যে এসে আটকে গেলো ওর। আজও বুঝে উঠতে পারে না, কিসের জোরে সুমন্তের সাথে ওর সম্পর্ক এখনো টিকে আছে!

মাত্র দুই মাসের পরিচয় থেকেই এক সাথে থাকার চিন্তা করেছিলো ওরা। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটে এর কিছুদিন পরেই। বিয়ের পর থেকেই একটা ঔদাসীন্য ভাব দেখতে পেয়েছিল সুমন্তের চোখেমুখে। কেমন যেনো খাপছাড়া আচরণ, ওর সাথে কোথাও ঘুরতে না যাওয়া এ বিষয়গুলো নীলাকে যেমন কষ্ট দিতো তেমনি অসহায় লাগতো নিজেকে। যতই দিন যাচ্ছিলো ধীরে ধীরে যেনো ওর আচরণেরও পরিবর্তন হতে লাগলো! এক কথায় দুই কথায় রূঢ় আচরণ করা, বাসার অন্য সকলের সামনে অপদস্থ করা, খবর না দিয়ে বাসায় না ফেরা এসব কান্ডকীর্তি যেনো ওর দিক থেকে এক অভ্যাসের বিষয় হয়ে গেলো একটা সময়।

নীলার শরীরে যখন অসুখ দানা বাঁধলো, এক একটি ঘটনাও যেন ঘটার জন্যই ওঁত পেতে থাকলো তখন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এর খেসারতও দিতে হলো নীলাকে। হঠাৎ একদিন যখন সুমন্ত বাসায় ফিরলো না তখন ওর অসুস্থ শরীরে যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো! ঠিক রাত দশটার মাথায় আসলো একটি এসএমএস, ‘আজ আমার আসতে দেরি হবে!’ এদিকে ঘুমও আসছে না! দশটা গড়িয়ে যখন সাড়ে বারোটা বাজলো শেষমেশ ফোন দিতেই হলো সুমন্তকে। একবার রিং হওয়ার পরই যখন ফোনটা বন্ধ হয়ে গেলো তখনই নানান খারাপ চিন্তা এসে মাথায় ভিড় করতে লাগলো, “ওর কোন বিপদ হয়নি তো, ছিনতাইকারীদের কবলে পড়লো না তো আবার! আজকাল ছিনতাইকারীরা কারো কাছ থেকে কিছু না পেলে মারধর করে, খুনও নাকি করে ফেলে!’

এমন পরিস্থিতিতে কারো বোধ হয় মাথার ঠিক থাকে না যেমনটি ঘটলো ওর ক্ষেত্রেও। শুরুর দিকে সুমন্ত দু’টো নাম্বার দিয়ে রেখেছিল, ‘এই নাম্বার দু’টো নিয়ে রাখো তো। আমাদের যদি কোন বিপদ-আপদ আসে, ওরা অন্তত আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারবে।’ যেজন্য ওর এক বড় ভাই আর আপন ছোট ভাইয়ের নাম্বার নীলার মোবাইলে সেভ করা ছিল।

রাত দু’টো। কোনভাবে শরীরটাকে জোর করে টেনে টেনে নিজেকে বিছানা থেকে নামিয়ে আনলো নীলা। ব্যাথায় তলপেট শরীর থেকে আলাদা হয়ে যেতে চাইছে যেনো! তলপেটটাকে কোনভাবে চেপে ধরে হাতড়ে হাতড়ে বাতি জ্বালালো ও। ইনডেক্স থেকে ওর বড় ভাইয়ের নাম্বার বের করে ফোন করলো। না, ওর বড় ভাইকে ফোনে পাওয়া গেলো না। সেই কখন থেকে ফোনটা ব্যস্ত দেখিয়ে যাচ্ছে। এখন তাহলে ওর কী করা উচিত! সুমন্তকে আবার ফোন করলো। এবার ওকে ফোনে পাওয়া গেলো, ‘ হ্যালো, তুমি কোথায়? আমার কথা শুনতে পাচ্ছো? তোমার কথা ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে কেনো! নেট ওর্য়াকের মধ্যে আসো।’ উদ্বিগ্নতা ছড়িয়ে পড়লো ওর চোখেমুখে! এরপর সুমন্ত নিজে থেকেই ফোন করলো, ‘তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। চিন্তার কোন কারন নেই। আমি ভোর হলেই বাসায় চলে আসবো।’ ওর এই স্বাভাবিক কণ্ঠ হতবাক করে দিলো নীলাকে, ‘তুমি এখন কোথায়?

– আমার এক সহকর্মীর সাথে হাসপাতালে আছি। বললাম তো চিন্তা করো না। ভোর হলেই বাসায় ফিরবো।

– তুমি তোমার সহকর্মীকে নিয়ে যে হাসপাতালে গেছো সেটা তুমি আগে জানালেই পারতে! তুমি আমাকে দুঃশ্চিন্তায় ফেললে কেনো?’
সাথে সাথে ঐ প্রান্তের লাইনটা কেটে গেল!

ভীষণ অসহায লাগছিলো নিজেকে। কষ্টে যন্ত্রনায় নির্ঘুম একটি রাত কেটে গেলো নীলার! তারপর দিন সকালে স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বাসায় ফিরলো সুমন্ত। স্বাভাবিক আচরণ, ভাবখানা এমন, বাসায় এক মুমুর্ষূ রোগীকে একা ফেলে রেখে এক রাত বাইরে কাটানো এমন কোনো বিষয়ই নয়। বরঞ্চ নীলাকে একের পর এক মিথ্যা বলে নিজেকে আড়াল করতে চাইলো সুমন্ত।

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে সুমন্ত। মধ্যবয়স। চলনে বলনে একটা ঠাট আছে বলেই হয়তো অনেকের চোখে পড়ে যায় সহজে। এর আগেও বিবাহিত জীবন ছিল ওর। আগের স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ির প্রায় বছর দু’য়েক পরে অল্প সময়ের ব্যবধানে নীলার সাথে বিয়ে হয় সুমন্তের।
সবসময় অফিস নিয়েই থাকে। ওর জগৎ দুনিয়া বলতেই কেবল অফিস। এর মধ্যে ছুটির দিনগুলোতে রাজনৈতিক কর্মকান্ডও থাকে কালেভদ্রে। ইদানিং যেনো তা আরো বেড়েছে। আর বাকি সময়গুলোয় ঘুমিয়ে কাটায়। ঘুম থেকে ওঠেই আবার ব্যস্ত হয়ে পরে মোবাইলে। প্রতি পনেরো- বিশ দিন পর পর থাকে তার একান্ত নিজস্ব সময়। কারণ এই দিনটিতে বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে হয় বলে এটি তার নিজস্ব সময় বলে দাবি করে নীলাকে। এই সময় বেশ রাত করেই বাসায় ফেরে, ইচ্ছে হলে কোন কোনদিন বাসায়ই ফেরে না!

এদিকে নীলাও আগে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো। এর আগে একটি বিবাহিত জীবন ছিল। তাই সেই সম্পর্ক ছাড়াছাড়ির পর বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির জন্ম দিবে না বলে একরকম সিন্ধান্তই নিয়ে নিয়েছিলো । তাই সুমন্তের সাথে পরিচয়ের পর থেকে ওর প্রতি সুমন্তের আগ্রহ গড়ে উঠলেও; ওকে নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিলো না নীলার। নানা অস্থিরতা ও পারিবারিক ঝামেলায় শেষমেশ সুমন্তের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে ও।

তবে অন্য সকল দম্পতিদের মতো এই দম্পতির শুরুর দিকটা তেমন ভালো যায় নি। গোলটা বাঁধে তখন, যখন ওর এক্স স্ত্রী বাসায় ফোন দেয়া শুরু করলো। হঠাৎই একদিন গভীর রাতে বিকট শব্দে বেজে উঠলো সুমন্তের মোবাইল। তড়িঘড়ি করে সে বিছানা ছেড়ে, ফোনটা ধরেই আবার রেখে দিলো। ঘ্যানঘ্যান করতে করতে বিছানায় উঠে আসতেই নীলা জানতে চাইলো,’কে ফোন করেছে। বাড়ি থেকে কোন ফোন এসেছে?’
– আরে না! ‘সে’ ফোন দিয়েছে।
– ‘সে’ ফোন দিয়েছে মানে? ‘সে’ কে?
– আমার ‘এক্স’
মুহুর্তের মধ্যে চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেলো নীলার!
– এ তো ভালো ব্যাপার নয়। সে জানে না যে, তুমি বিয়ে করেছো? আমার কাছে বিষয়টি মোটেও ভালো লাগছে না। যত তাড়াতাড়ি পারো এ বিষয়টি সুরাহা করে ফেলো।
ওপাশ থেকে চুপ হয়ে যায় সুমন্ত।
এ ব্যাপার কোন কথা না বাড়িয়ে পাশ ফিরেই থম মেরে যায় নীলা। কিছুতেই দু’চোখ এক করতে পারে না ও।

পুরোনো সংকট থেকে আরো একটি নতুন সংকটে জড়িয়ে পডলো যেনো নীলা। এ সংকট যখন দিন দিন বেড়ে চলেছে তখন অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো সুমন্তের সাথে এ বিষয় বসা দরকার। কিন্তু এ নিয়ে যতবারই বসতে চেয়েছে ততবারই হোঁচট খেয়েছে ও।

– দেখো আমারও একটি অতীত ছিলো! কিন্তু সেই অতীত আমাদের এই বাড়ি অব্দি এসে গড়াগড়ি খাচ্ছে না। কিন্তু তোমার এই অতীতের যন্ত্রণা কেন আমাকে নিতে হচ্ছে বারবার? চোখে চোখ রেখে কথা ক’টি বলে যায় নীলা।

– এটা কী আমার দোষ! সমস্যাটা সেই মানুষটির, আমার না। আর তাছাড়া সে তোমার বাড়ি পর্যন্ত তো এখনো আসে নি,তাই না। চোখমুখ কুঁচকে তাচ্ছিল্য সুরে বলে যায় সুমন্ত।

– এ কথা বলে কি বোঝাতে চাইলা তুমি? তোমার কথাবার্তার ভাবসাব মোটেও ভালো ঠেকছে না আমার! ঠিক আছে, আমার মনে হচ্ছে তুমি ইচ্ছে করে সম্পর্কটাকে খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছো। এ নিয়ে আমার আর কথা বলতেও ভালো লাগছে না।
ধুপধাপ শব্দ করে অন্য রুমে এসেই সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো‌ নীলা। নিজের রুমের দরজায় দোর দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ও। মনে মনে ভাবতে থাকে, এ আমি কিসের মধ্যে এসে পড়লাম। আমি তো এমন জীবন চাই নি। কেন এমন হয়ে গেলো আমার জীবনটা!

সকাল থেকেই সুমন্তের মেজাজ আজ বেশ ফুরফুরে। ছুটির দিন। নাস্তার এক ফাঁকে জানালো, ‘আজ আমাদের রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ করেছে বাবলু ভাই।’

– তাহলে দুপুরে আর তেমন কিছু রান্না না করি, কি বল? – না, আজ আর ওতো ঝামেলা করতে যেয়ো না। ডাল আর আলু ভর্তা দিয়েই চালিয়ে দাও আজকের মতো।

বিয়ের আগে থেকেই বাবলু ভাইয়ের সাথে জানাশোনা নীলার। ওনার পুরো নাম বাবলু মুস্তাফিজ। এক সরকারি প্রতিষ্ঠানে আছেন। তবে ওনার পরিবারের সাথে এখনও পরিচয় হয়ে ওঠে নি ওর। এই প্রথম এই পরিবারকে দেখা। একটি সন্তান নিয়ে ছোটখাটো সংসার। বাবলু ভাইয়ের স্ত্রী বেশ সুন্দরী। তবে ওনার চাইতেও বয়সের ব্যবধানটা যেনো বেশিই মনে হলো নীলার। ছিপছিপে, লম্বা,চওড়া গড়ন। শরীরে মা মা ভাব নেই। যেন বিশ বছরের কোন তন্বি মেয়ে। শরীরজুড়ে ভরন্ত যৌবন। এর আগেও সুমন্ত কথায় কথায় বলেছিলো, ‘বাবলু ভাইয়ের এটা দ্বিতীয় বিয়ে। ওনার চাইতে প্রায় তেরো বছরের ছোট মেয়েকে বিয়ে করেছেন উনি। প্রথমে মেয়ে পক্ষ রাজি ছিলো না। পরে ছেলের সরকারি চাকরি আর ভালো রোজগারপাতি দেখে এই বিয়েতে রাজি হয়ে যায় মেয়েটি। তবে বাবলু ভাইয়ের বউটা কিন্তু বেশ সুন্দরী!’ এই বলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে সুমন্ত!

বেশ বড়সড় সরকারি কোয়ার্টার। সুমন্ত নিজে থেকেই ওনার পরিবারের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো নীলাকে। সাথে ওনার বাবা-মা ও ছিলেন। জানা গেলো, ওনারা এখানে থাকেন না। কালেভদ্রে ছেলের কাছে বেড়াতে আসেন মাত্র। ঐ পরিবারের সাথে সুমন্তের যে একটা সুসম্পর্ক আছে তা ওদের কথাবার্তায় বেশ বুঝে গেলো নীলা। পরিচয়ের পর থেকেই বাবলু ভাইয়ের স্ত্রী বেশ মেপে মেপে কথা বলছিলো।‌ টুকটাক কথাবার্তা ছাড়া বেশীরভাগটাই টেলিভিশন দেখে, ইচ্ছে করেই সময় পার করছিলো যেনো। নীলা নিজে থেকে দু’য়েকটা কথা বললেও পরে হাল ছেড়ে দিলো ও। কেমন যেনো অস্বস্তি লাগছিলো ওর।

যাক যথারীতি খাবারের আয়োজন শুরু হলো। চৌকোণো ডাইনিং রুম। টেবিলে খাবার দাবার সব আগে থেকে গোছানো ছিল। কিন্তু পরিবেশনের সময় যেনো কৌশলেই এড়িয়ে গেলো তার স্ত্রী। ‘এই তুমি ওদের খাবারটা উঠিয়ে দাও না, এদিকে আসো একবার।’ বাবলু ভাই ডাইনিং রুম থেকেই অনুরোধ করলো তার স্ত্রীকে। এক রকম বাধ্য হয়েই ডাইনিং রুমে আসলো সে। বাবলু ভাইয়ের পেছন থেকে মুখটা সামান্য বাড়িয়ে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য টেবিলের চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই সে বললো ‘ওরা নিজেরাই তো খাবার উঠিয়ে নিয়ে খেতে পারছে। পাতে খাবার তুলে দেবার দরকার আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।’ এই বলে দু’য়েকটা মাংসের টুকরো সুমন্তের পাতে দিয়ে আর ডিম ভূনাটা নীলার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে আবার টিভি রুমের দিকে চলে গেলেন তার স্ত্রী।

খাওয়া শেষে, বাবলু ভাই আর সুমন্তের সাথে নীলাও ওদের সঙ্গে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। যদিও বাবলু ভাই ওকে তার স্ত্রীর সাথেই থাকতে বলেছিলো; কিন্তু তার এই খাপছাড়া আচরণ ভালো লাগেনি বলে একরকম এড়িয়ে গেলো সে। সুমন্ত আর বাবলু ভাই বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলো। আর এদিকে নীলা বারান্দার সাথে লাগানো হাঁটাপথটিতে ঘুরে ঘুরে দেখে যাচ্ছিলো বাড়ির আশপাশ। হঠাৎ বারান্দার দরজার গিয়ে চোখ আটকে গেলো ওর। মনে হলো, দরজার গা ঘেঁষে বাবলু ভাইয়ের স্ত্রী, বাবলু ভাই আর সুমন্তের কথা আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করছে!

একটু একটু করে যে মেঘ জমেছিলো তা ধীরে ধীরে যেনো আরো গাঢ় হতে লাগলো; কোন একদিন ঝড় হয়ে ভাঙাচোরা এক সংসারে আছড়ে পড়বে বলে।
নীলার শরীরে যখন অসুখ দানা বাঁধলো ঘরের পরিস্থিতিও পাল্টে যেতে লাগলো তখন। সুমন্তের এক একটি বেপোরোয়া আচবণে ভীষণরকম ধাক্কা খেলো নীলা!
রান্নার নানান খুঁত ধরা, যখন তখন মুখ খিঁচিয়ে কথা বলা, দু’সপ্তাহ পর পর, না বলে কোথাও উধাও হয়ে যাওয়া নিত্য নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো এ সংসারের জন্য! এর মধ্যে বাঁধলো আরেক বিপত্তি!
কথাকাটাকাটি সূত্রপাত সুমন্ত নিজেই করলো, ‘তুমি যে কত ভালো মানুষ তা সবাই জানে। কে তোমাকে পছন্দ করে? একটা বাজে মেয়েমানুষ কোথাকার! আর সেজন্যই তো তোমাকে দেখার জন্য হাসপাতাল অব্দি কেউ দেখতেও যায় নি।’
– আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না। আমাকে কেউ দেখতে পারেনা এই কথার মানে কি!’ থতমত খেয়ে গেলো নীলা।
– যা সত্যি তাই বলেছি। বিথীকা তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু না? সে-ই তো আমাকে বললো মানসিক দিক দিয়ে তুমি যথেষ্ঠ অসুস্থ একজন মানুষ। হাসপাতালে তাকে আমি তোমার সাথে থাকার জন্য অনুরোধ করেছিলাম! সে আমাকে সরাসরি হাসপাতালে আসবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।‌ আমার কথা বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করো তাকে?
– আমার সাথে কথা না বলে তুমি তাকে ফোন করেছো কেন? চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো নীলা।
– আমার মাথায় কাজ করছিলো না বলেই তাকে ফোন করেছি। ও তো তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তুমি তার বাড়ি অব্দি বেড়াতে গেছো। সেজন্যই ফোন করেছি। আরও একটি কথা কান খুলে শুনে রাখো, আমার একান্তই নিজস্ব সময়গুলোতে আমাকে কোনরকম বিরক্ত করা যাবে না।
– তোমার একান্ত সময় মানে? বুঝলাম না। এমনিতেই তোমার সাথে কতটা সময় কাটে আমার! এই কথা বলার সময় লজ্জা করলো না তোমার?
– এই যেমন, বৃহস্পতিবার আমি যদি কোন কারণে ঘরে না ফিরতে পারি, এই নিয়ে কোন প্রশ্ন করা যাবে না।
মুহূর্তের মধ্যে হতভম্ব হয়ে গেলো নীলা! কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলো ও।
– ঠিক আছে, এ নিয়ে পরে কথা বলা যাবে! বিথীকাকে নিয়ে কথা হচ্ছিলো আমাদের মধ্যে। শোনো, সে আমার কোন কাছের বন্ধু না। তাছাড়া কারো বাড়ি বেড়াতে গেলে যে, সে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয় ; এই কথাটি আমার আগে জানা ছিল না! আমি তোমার কাছ থেকে এই প্রথম শুনলাম! রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকে ও।
রুম থেকে বেরিয়ে, সাথে সাথে বিথীকাকে ফোন করে বসে নীলা।
– হ্যালো। কি খবর আপনার?
– কেমন আছেন আপনি? আচ্ছা, আমার স্বামীকে, আপনি কেন আমার সম্পর্কে নোংরা কথা বলেছেন? আপনি আমাকে হাসপাতালে দেখতে আসতে চাননি, এটা আপনার ব্যক্তিগত বিষয়; কিন্তু আমার বিরুদ্ধে বাজে কথা বলে সংসারে ঝামেলা পাকালেন কেনো!’ কোন ভান ভনিতা ছাড়াই কথা ক’টি এক নিঃশ্বাসে বলে যায় নীলা।
– আমি ওনাকে ফোন করিনি, উনিই আমাকে ফোন দিয়েছেন।‌ আর বলেছি, বেশ করেছি। আপনাদের সংসার জীবন কখন ভালো ছিলো, এ্যা? পারলে আরো বলবো, বুঝতে পেরেছেন!
– আপনি পারলে আরও কি বলবেন; রীতিমতো সংসারে ঝামেলা পাকিয়ে দিয়ে বসে আছেন আপনি! আমার স্বামীর সাথে বিয়ে বসবেন নাকি আপনি, এ্যা!’
আরো কিছু বাকবিতন্ডার পর লাইন কেটে দিলো নীলা!
সুমন্তের দিকে চোখমুখ কঠিন করে মুখ ফেরালো ও।
– বিথীকার সাথে কতদিনের সম্পর্ক তোমার? ঠোঁটে কামড়ে স্থির দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করল নীলা।
– আমার সাথে সম্পর্ক হতে যাবে কেনো? সে তো তোমার বন্ধু। কী আশ্চর্য।
– না, এর মধ্যে অন্য কিছুর গন্ধ পাচ্ছি আমি।‌ সে আমাকে যে ভাষায় কথা বলেছে, সেখানে কোন স্বার্থ জড়িয়ে না থাকলে, কেউ এভাবে কথা বলে না। যাই হোক, দিনের পর দিন, তুমি মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছো,এটা মনে রেখো।’
এই বলে চোখ মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো নীলা।

মুহুর্তেই ঘরের পরিস্থিতি পুরোপুরি বদলে গেলো যেনো! এক চাপা বিষন্নতা ছড়িয়ে পড়েলো ঘরজুড়ে, যার ছোপ পড়লো দরজায় দোর দেয়া ওপ্রান্তের এক নারীর জীবনেও। জীবন তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে গেলেও; সময় ঠিকই তার তীক্ষ্ম ঘা লাগানোর জন্য ওৎ পেতে ছিলো যেনো এতদিন! যার প্রবল ঝাপটা এসে পড়লো এই সংসারে আরো একবার! কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ক্ষত সেরে উঠতে না উঠতেই আরো একটি ঘটনা এসে উপস্থিত হলো মাস দু’য়েক পর! সুমন্তের মোবাইলে পাঠানো দশ বছর আগের একটি এসএমএস পুনরায় এসে; তছনছ করে দিলো আবার এ সংসারটিকে। একটু একটু করে সুমন্ত জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে ধরা দিলো নীলার কাছে। বিষয়টা আরো পরিষ্কার হলো যখন নীলা, বাবলু ভাইয়ের বাসায় গেলো তখন।

Leave a Reply