Shapla Barua

একটি গাছের অকাল প্রয়াণ
শাপলা বড়ুয়া

ময়লা আবর্জনা ফুঁড়ে মাথা তুলে কচি কচি বেশ কয়েকটি চারা গাছ বেরিয়েছে বেশ ক’দিন হলো। সার বানানো হবে বলে ময়লাগুলোকে জমানো হচ্ছিলো সেই কবে থেকে। আধ পঁচা সবজির খোসা থেকে তৈরি হওয়া সারের রস শুষে নিচ্ছে বলে অনেক চারা উপড়েও ফেলেছি এরই মধ্যে। মায়া লেগে গিয়েছিল বলে পাকা লেবু রাঙা কচি তিন-চারটি চারা গাছ রয়ে গিয়েছিল শেষপর্যন্ত। বাকিরা মরে গেছে, দুটোই কেবল টিকে গিয়েছিল শেষমেষ!

বৃষ্টির জল পেয়ে এরই মধ্যে চারা গাছ দুটো দেখি একটি দুটি পাতা করে তরতড়িয়ে‌ বড় হয়ে উঠছে। ওদের নিয়ে আমার তেমন একটা আগ্রহ ছিলো না আবার উপড়াতেও ভীষণ মায়া লাগছিল! বড় হচ্ছে যখন , তখন নিজের মতোই বড় হয়েই উঠুক। এমনই উন্নাসিক ভাব আমার। তাই অন্যদের নিয়ে যতটা ব্যস্ততা ছিলো,ওদের দিকে তাকাবার ফুসরতই ছিলো না আমার। পোকামাকড়ের জন্য সময়ে সময়ে ওষুধ ছিটিয়ে দেয়া, গাছের বাড়তি ডালপালা ছেঁটে দেয়া ইত্যকার কাজগুলো আমাকে করতেই হয় সবসময়।

নানা ঝামেলায় বেশ ক’দিন গাছগুলোকে‌ তেমন যত্নও করা যায়নি। বৃষ্টি হচ্ছিলো তাই পানি দিতে হতো না। একদিন ছাদে হাঁটতে হাঁটতে গাছগুলোকে ঘুরে ঘুরে দেখছি, হঠাৎ ময়লার সেই বালতিতে গিয়ে চোখ আটকে গেলো। কী নধরকান্তি, নরম, সবুজাভ পাতা মেলে দুটো শিশু গাছ লতিয়ে লতিয়ে উঠছে! অবলম্বন পাচ্ছে না বলে আবর্জনার মধ্যেই নিজেদের এলিয়ে দিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলেছে ওরা। গাছের পাতা দেখে বুঝতে পারলাম দুটোই মিষ্টি কুমড়ো গাছ।

যতই‌ দিন যাচ্ছে গাছ দুটিও বেশ বড়সড় হয়ে উঠছে। সবই তো আবর্জনা! মাটি ছাড়া কী খেয়ে যে বেড়ে উঠছে, তা আমার মাথায় ঠিক আসলো না! শিশু থেকে সবে কৈশরে পা দিয়েছে। এখন বিশেষ যত্নের প্রয়োজন ওদের। গোড়ায় কিছু মাটি দিলাম, সাথে লম্বা লাঠির ওপর চড়িয়ে দিলাম ওদের লতানো শরীর দুটিকে। একটি বালতিতে একটি গাছই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু অন্য গাছটিকে উপড়ে ফেলতে হবে ভেবে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। গাছ দুটো এখন একটি বালতিতে বড় হয়ে উঠছে। অবলম্বন পেয়ে তরতর করে উঠে পড়ছে ওরা।

প্রতিদিন ছাদে যাই আর সেই গাছ দুটোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। কী সবুজ নরম রসালো পাতা। যৌবনবতী হয়ে উঠছে যেন দিন দিন। লাঠি বেয়ে মাথা উঁচিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মাচা ছোঁয় নি এখনও। এখন ওরাও অন্য গাছেদের যত্নআত্তিতে সমান ভাগ বসিয়েছে। ওদের ওপর আমার যত্নের বহর দেখে অন্য গাছগুলোও যেনো মুষড়ে পড়ছে। আমারও আজকাল ওদের না দেখলে ভালো লাগে না। আমাকে দেখলে ওরাও কেমন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠে!

সেদিন সন্ধ্যায় ছাদে এক চক্কর হেঁটে এসে যখন ওদের ঘর বরাবর গেছি, একজন দেখি গোমরামুখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে! আমি বললাম,’এই, কি হয়েছে তোমার? আজ এমন গোমড়ামুখ কেনো?’
বেশ অভিযোগের সুরেই জানালো, ‘আজকাল পোকারা আমাদের বিরক্ত করে মারছে। দেখো বেশ কয়েকটি কচি পাতাও খেয়ে ফেলেছে। আর কাঁহাতক এমন যন্ত্রণা সওয়া যায়, বলো!’
-ওহ, এই কথা! হুম কিছু পোকা তোমাদের শরীরে বাসা বেঁধেছে দেখছি। ওষুধ দিতে হবে। চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ আশ্বস্ত করলাম আমি।
-ঠিক হয়ে গেলেই বাঁচি। এ যন্ত্রণা যে আর ভালো লাগে না! কাল সন্ধ্যায় দেখতেও তো আসলে না। প্রতিদিন দুই বার তোমার দেখা না পেলে যে আমাদের ভালো লাগে না, তা তো ভালোই জানো! ওপাশ থেকে অনুযোগ করলো আরেকজন।
‘-এবার থেকে প্রতিদিন দু’বারই আসবো। কাল সন্ধ্যায় একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল বলে আসা হয়নি। এবার আর অন্যথা হবে না, দেখে নিও। এভাবেই প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা যায় আমাদের।

এদিকে চাল,ডাল ধোয়া পানি, সরষে পঁচা জল পেয়ে দিন দিন আরো হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠেছে ওরা। কে বলবে, বালতি থেকে বড় হয়ে ওঠা গাছ! ছোট ছোট কলিও আসা শুরু করেছে। ছোট মাচাতেও আর হচ্ছে না,ওরা নিজেরাই এখন তরতর করে বড় নিম গাছটার গা বেয়ে ওঠে পড়েছে।

দুই-তিনটে ছানাপোনাও এসেছে এরই মধ্যে। আমারও আনন্দে আর ধরে না! যত্নটাও বাড়িয়ে দিলাম আরো এক ধাপ। কিছুদিন পর দেখি, দুটো শিশু কুমড়োয় হলুদ রঙ ছড়িয়ে পড়েছে, কেমন রুগ্ন, শুষ্ক দেখাচ্ছে ওদের! মনটা ভীষণ খারাপ করে দিয়ে, রুগ্ন শিশু দুটি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো একদিন ! আমার আর কিছু ভালো লাগে না। কাজেও তেমন আর আনন্দ খুঁজে পাই না। ওদের মৃত্যু শোক কাটিয়ে উঠলাম ঠিকই কিন্তু একটা চিনচিনে কষ্ট রেখে গেলো ওরা!

সবে ধন নীল মণি সেই একটি কুমড়োই বেশ বড় হয়ে উঠছে দিনকে দিন। ওর কালো কুচকুচে শরীর আরো চকচক করছে যেনো। আমার যৌবনবতী গাছটিরও আগের সেই জৌলুস কোথায় হারিয়ে গেলো যেনো! কথায় কথায় বলা হয়নি, ওকে একা করে দিয়ে ওর সঙ্গীটাও এরই মধ্যে চলে গিয়েছে! একটি ধকল সইতে না সইতে আরো একটি ধকল গেলো আমার ওপর দিয়ে।

এদিকে আমার হৃষ্টপুষ্ট তিন সন্তানের কুমড়ো জননীর শরীরে এখন কিছুটা বয়সের ছোপ ও পড়েছে।‌ পোকামাকড়রাও ছেঁকে ধরেছে ওকে। এত এত ওষুধ দিচ্ছি এরপরও কিছুতেই কিছু হয়না। সপ্তাহখানেকের জন্য কোথায় চলে গিয়েই আবার ফিরে এসে ফের সাঁড়াশি আক্রমণ। হাত দিয়ে চেপে মারি , না সেই একই অবস্থা! জাব, মিলিবাগ চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। ওকে বাঁচানোর জন্য এক মহা যুদ্ধে নেমেছি যেনো আমি!

হঠাৎ একদিন সব স্বপ্ন আর ভালোবাসাকে জলাঞ্জলি দিয়ে, এক সন্তানকে বুকে নিয়ে; মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো আমার হৃষ্টপুষ্ট কুমড়ো গাছটি! এখনও পাঁচ-ছয়টি হলদে ফুল বাতাসে হেলছে, দুলছে, খেলা করছে। ওরা হয়তো জানে না ওদের ছেড়ে চলে গেছে ওদের মা!

Leave a Reply