Shapla Barua

স্মৃতির অতলে ডুবে থাকা এক টুকরো ভালোবাসা
প্রথম পর্ব

শাপলা বড়ুয়া

এই ইট পাথুরে নগরীতে নির্জীবতার ছোপ পড়েছে প্রকৃতিতেও। কাক, চড়ুইরা এখানকার নির্জীবতার সাথে মানিয়ে নিলেও অন্যরা যেনো বড্ড যন্ত্রণা নিয়ে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে দূরে-বহুদূরে।

কিন্তু কড়া রোদ্দুরকে দূরে সরিয়ে একটু একটু করে যখন ছোপ ছোপ মেঘেদের দল‌ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে আর তার ঠিক কিছুক্ষণ পর যখন চলতে থাকে দাপুটে বৃষ্টির রাজত্ব তখন গ্রামের সেই সোঁদা গন্ধ, ধানি জমির মাঝখানে এঁকে বেঁকে যাওয়া আল আর বুনো স্বপ্নেরা এসে ভীড় করতে থাকে আমার রাজত্বে। গ্রামের জন্য ভীষণ মন পুড়ে তখন। অনন্তকাল ধরে নিজের অজান্তে পুষে রাখা গ্রামকে আগলে ধরে থাকতে ইচ্ছে করে তখন।

যদিও আমার বেড়ে ওঠা গ্রামে হয়নি। এরপরও যতটুকু গ্রামকে দেখেছি, গ্রামের প্রকৃতি ও সহজ-সরল মানুষগুলোকে দেখেছি, সেই স্মৃতিগুলো কখনোই ভুলবার নয়! ।ছেলেবেলায় গ্রাম বলতেই জেনেছি আমার মামার বাড়িকে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর চর ঘেঁষে নিস্তরঙ্গ প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা আমার এক টুকরো ভালোবাসা!
সেই শান্ত, স্নিগ্ধ প্রকৃতি, কর্ণফুলী নদী, দিগন্তবিস্তৃত চর, উঠোনের কোণে সটান দাঁড়িয়ে থাকা সেই বরই গাছ, পুকুরে ভেসে বেড়ানো দাড়িকাণা মাছ, পুকুরের পাড় ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সেই রহস্যময় বেতঝাড় এখনো আমার স্বপ্নময় জগতে এসে উঁকি দিয়ে যায়! এক এক রূতুতে একেক রূপে সেজে ওঠে আমার গ্রামটি। উঠোনের কোণে বিছিয়ে থাকা সেই বরইয়ের মতোই স্মৃতিগুলোও যেনো টুটটাপ করে ঝরে পড়তে থাকে তখন।

এই তো সেদিনের কথা, সদা হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাদু ধবধবে সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবি পরে এ ঘর থেকে ও ঘরে চলে গেলো আমার পাশ দিয়ে। মাসিদেরকে বারবার হাঁক দিচ্ছে, হাটে যেতে হবে, তাড়তাড়ি বাজারের ফর্দটা যেনো নিয়ে আসে। ফর্দ আসলেই দাদু চলে যেতেন হাটে কিন্তু আমার প্রতীক্ষার যে শেষ হতে চাইছে না! দাদু আসার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে সবার আগে গিয়ে দাঁড়াতাম আমি। আর দাদুর হাতে ধরে থাকা সেই ব্যাগটায় গিয়ে চোখ আটকে যেতো আমার। আমার এই ভাবগতিক বুঝতে পেরেই বোধ হয় ব্যাগের কোন এক ঘুপচি থেকে বেলা বিস্কুটের প্যাকটটি দিদিমার হাতে ধরিয়ে দিতেন দাদু। আমিও পড়ি মরি করে দিদিমা’র পিছ পিছ ছুটতাম। আর এক মূহুর্তের জন্যও পিছু ছাড়তেই চাইতাম না। দিদিমার হাত থেকে যখন দৈতাকৃতির বেলা বিস্কুটটি হাতের তেলোয় এসে পড়তো আমার শিশু মনের উচ্ছ্বাস মূহুর্তের মধ্যেই ফেটে পড়তে চাইতো যেনো। আর গোল গোল রংচটা হলুদ রংঙের টিনের বাটিতে ধোঁয়া ওঠা চা’য়ে চুবানো সেই বেলা বিস্কিটের স্বাদ অন্য এক সুখানুভূতি এনে দিতো আমার শিশু মনে!

এই শীতে ঝুপ করেই যেনো সন্ধ্যা নামতো কর্ণফুলীর ধারের সেই বাড়িটিতে। ছোট মাসিদের হাতে হাতে ঘুরতো হ্যারিকেনের সান্ধ্যবাতি। ঘুটঘুটে অন্ধকারে টিমটিমে সেই হ্যারিকেনের আলোর রহস্যভেদ করে দুই-একটি জোনাক পোকা উঠোনজুড়ে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে, কোন এক গাছের ফাঁকে ঢুকেই আবার হারিয়ে যেতো। তবে এই আলো আঁধারিতেও উঠোনের মুখের সেই লাল মরিচ জবা গাছটি তার লাল আভা ছড়িয়ে দিয়ে আগুন্তুকদের স্বাগত জানাতে মোটেও কুণ্ঠা করতো না। আর মেঠো রাস্তার ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঁশঝাড়টিকে বরাবরই রহস্যজনক মনে হতো আমার! কতবার যে উঁকিঝুঁকি দিয়ে এর ভেতরটা দেখার চেষ্টা করেছি তার ইয়ত্তা নেই! মনে হতো এই বাঁশঝাড়েরই কোনো এক ঝুপড়ি থেকেই হয়তো ঝুপ করেই শীত নেমে আসে আবার রোদ্দুরের সাথে একরকম বোঝাপড়া করেই আবার কোন এক ঝাড়ে গিয়ে লুকিয়ে পরে! ছোট মাসি ভয় ধরিয়ে দেয়ার জন্য বলতো, ‘এই বাঁশঝাড়ের ঐদিকে ঘুরঘুর করছিস কেন রে? ওর ভেতরে গেছিস তো আর ঐখান থেকে ফিরে আসতে পারবি না, বুঝলি। এই নিয়ে কতজন হারিয়ে গেলো, আজঅব্দি ওদের চেহারা পর্যন্ত দেখতে পেলাম না আমরা।’
তবে আমার রহস্যময় বাঁশঝাড়টিকে থোরাই পাত্তা দিতো না এদিক-ওদিকের ভিটেমাটের বাসন্দিরা। কী অবলীলায় দৈতাকৃতির বাঁশঝাড়টিকে পাশ কাটিয়ে, বাড়ির পথ ধরে চলে যাওয়া রাস্তাটিতে এখানকার বাসিন্দারা যাওয়া-আসা করতো যখন তখন !

কখনোবা রাতের ধ্যানমগ্ন নিরবতা ভেঙে মাঝেমধ্যে সাম্পানের মৃদু মন্দ আওয়াজও শোনা যেতো। সরব হয়ে উঠতো পাশের ভিটের লোকজনেরা। কিছুক্ষণ পরেই আগুন্তুককে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েই কেঁ কোঁ আওয়াজ তুলতে তুলতে সাম্পানটি কোথাও হারিয়ে যেতো আর এদিক থেকে ছোট মামা গলা উঁচিয়ে ওপারের পড়শীর কাছে জানতে চাইতো, কেউ আবার আসলো কিনা। তৎক্ষনাৎ ও-প্রান্ত থেকে সোৎসাহে উত্তর আসতো, শহর থেকে নতুন অতিথি এসেছে বেড়াতে। আর এভাবেই একে অপরের সঙ্গে এমনই খবর দেয়া-নেয়ার সম্পর্ক ছিলো এই জনপদের বাসিন্দাদের। তাই বলে ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নাম না জানা খালটি সবসময় সাম্পানের চলাচলের রাস্তা ছিলো না মোটেও। শুধুমাত্র খালের আশেপাশের বাসিন্দারাই কালেভদ্রে এই খালটি ব্যবহার করতো,যা কিনা কর্ণফুলীর সঙ্গে মিশে গেছে।
(চলবে)

শাপলা বড়ুয়া

শাপলা বড়ুয়া

Leave a Reply