স্মৃতির অতলে ডুবে থাকা
এক টুকরো ভালোবাসা -২
শাপলা বড়ুয়া
বাইরের পাকঘর থেকে যতদূর চোখ যেতো ততদূরই ছিলো ঘন গাছ-গাছালির সারি। আর এই গাছের সারিগুলো একে অপরের সাথে মিশে একরকম ঝাড় জঙ্গলের রূপ পেয়েছিলো যেনো। আর তাই কি শীত, কি বর্ষায় বাইরের পাকঘরে তেমন একটা উনুনও চড়তো না। ভেতরের পাকঘরেই চলতো রান্নার আয়োজন। তবে শীতের সময়ে আগুন পোহানোর জন্য বাইরের পাকঘরের দু’মুখো মাটির চুলায় কদাচিৎ ধরানো হতো উনুন। আর এই উনুন পোহানো নিয়ে ছোটদের মধ্যে চলতো তুমুল প্রতিযোগীতা। যে আগে আসতো তার-ই উনুনের ধারে বসার সুযোগ ঘটতো। এমনই খুনসুটি আর হট্টোগোলের ছন্দপতন ঘটিয়ে পাকঘরের পেছনে ঘন গাছগাছালির ফাঁক গলে বিকট স্বরে ডাক ছাড়তে ছাড়তে চলে যেত কোন পাতি শিয়াল, কখনো বা মোআফ।
খাল পাড় ঘেঁষে ঝুঁকে থাকা কেওড়া ফল, লাল হলদে বরই, পুকুর পড়ের ঐ ঝুমকো জবা আর আধপাকা বেত ফলের থোকায় থোকায় একটু একটু করে জমিয়ে রেখেছিলাম আমি আমার শৈশবের সবটুকু ভালোবাসা! তাই ইট পাথরের এই নগর ফুঁড়ে ছুটে চলা রেলগাড়িকে আমার এই ভালোবাসার বাহক করে নিয়েছিলাম মনে মনে।
সেজন্যই বুঝি বহু দশক পেরিয়ে আজও ফিরে যাই সেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী লাল গাই বাছুরটার কাছে, ঝরে পরা বরইয়ের ওপর যার সাথে ছিলো আমার আধিপত্য বজায় রাখার লড়াই। যে লড়াইয়ে বরাবর হেরে গিয়েও আবার নতুন উদ্যমে এগিয়ে গেছি আমি। ভালোলাগা আর ভালোবাসার লড়াই বুঝি এমনই হয়, যেখানে না থাকে হেরে যাওয়ার কষ্ট, না থাকে কোন লজ্জা! কখনো বা নিজের অজান্তেই ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছি মায়া জড়ানো সেই মানুষগুলোকে।
যাদের বুকে মুখ ঠেকে উষ্ণতা নেয়া যায় অবলীলায়! তেমনি গাঁও গ্রামের অখণ্ড সরলতার প্রতীক নিয়ে আমাদেরও নিবিড় বন্ধনে আগলে রেখেছিলেন আমার সরল ও সাদাসিধে দিদিমা। লম্বা ছিপছিপে গড়ন। সবসময় ধবধবে সাদা থান কাপড় কোনভাবে জবুথবু হয়ে জড়ানো থাকতো তার শরীরে। অন্য কোন রঙের শাড়ি আমি কখনোই পড়তে দেখিনি তাকে।
কত শত ছেলেমি আব্দার মুখ বুজে সইয়ে গেছেন, কখনো বিরক্ত হতে দেখিনি তাকে। সকল মা-দিদিমা’রা বুঝি এমনই হয়। তাই সব বন্ধনকে দূরে ঠেলে যখন কংক্রিটের এই নগরীর দিকে পা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতাম, এক গলা ঘোমাটা দিয়ে ছুটে আসতেন দিদিমাও। চোখের নোনা জলে দিদিমা’র সঙ্গে সঙ্গে ভেসে যেতাম আমিও। দৈতাকার বাঁশঝাড়কে পেছন ফেলে আমাদের অবয়ব আবছা না হওয়া পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন আমার মায়া জড়ানো দিদিমা।
দখিন ঘরের পেছনে টাল দিয়ে থাকা খড়ি কাঠগুলো ছিলো আমার ভালোলাগার অন্য আরেকটি জগৎ। দুপুরের ভাত-ঘুমের সময়টুকুতে যখন সবাই গড়াগড়ি যেতো তখন আলাদা এই জগতের সাথে চলতো আমার নানান ভাববিনিময়ের পালা! মোরগঝুঁটি, ঝুমকো জবা, মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠবাদাম, কাউ ফল, কেওড়া, পাতি ও গন্ধ লেবু গাছেদের দঙ্গল নিয়ে ছিলো এক অদ্ভুত জগৎ! এর মধ্যে হয়তো হালকা বাতাসে ঝুপঝাপ করে ঝরে পড়তো দু’য়েকটি লাল হলদে কাউ ফল।
আর কাউ ফলের এই ঝরে পড়ার শব্দ সবার আগে পৌঁছে যেতো ছোট মাসির কানে। ঠিকই সময়মতো হাজির হয়ে যেত ও! আর বিছিয়ে থাকা শুকনো পাতার দঙ্গলকে সরিয়ে লুকিয়ে থাকা কাউ ফলগুলোকে কুড়িয়ে এনে ভারি করে তুলতো ওর জামার কোঁচা। কোঁচা থেকে এক একটি টক-মিষ্টি স্বাদের কাউ ফলের স্বাদ নিতে নিতে নানান রাজ্যের গল্প জুড়িয়ে বসতো ও। এর মধ্যে হয়তো জোর বাতাসে মানুষের বিষ্ঠার মতো বুনো গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে গন্ধভাদালি জানান দিতো তার উপস্থিতি!
ছোট মাসির সাথে আমার বয়সের দূরত্বটা খুব বেশী ছিলো না। তাই যখন তখন আমার ওপর সে খবরদারিটা যেমন চালাতো তেমনি একরকম বন্ধুত্বের সম্পর্কও ছিলো ওর সাথে। তবে খবরদারির মাত্রাটা যখনই বেড়ে যেতো তখনই মনে মনে আড়ি হয়ে যেতো। অমনি কথা বলা বন্ধ, বেশ ক’দিন ধরেই ভাববাচ্যে চলতো ভাববিনিময়ের পালা! এতে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছিলো হয়তো। এমনি কোন একদিন একা একা ঘুরতে ঘুরতে গোয়াল ঘরের ঠিক পেছনে অদ্ভুত এক সুড়ঙ্গের দেখা পেয়ে গেলাম।
সেই সুড়ঙ্গ আবার নানান সব লতানো গাছ দিয়ে ঢাকা ছিলো! মাঝে মাঝে পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে উঁকি দিতো কাঁকরোলের মতো দেখতে ছোট ছোট ফল। এ যেন অন্য আরেকটি জগৎ। সুড়ঙ্গের ঠিক পেছনেই ছিলো বিস্তৃত ধান ক্ষেত! ক্ষেতের ওপর যখন এক ঝাপটা বাতাস এসে খেলে যেত নরম ধানি শীষের ওপর, তখন এক মনোরম সৌন্দর্য সৃষ্টি হতো ধান ক্ষেতজুড়ে।
এর মধ্যে হয়তো ক্ষেতের আল ধরে নিজেদের মধ্যে কথা কইতে কইতে চলে যেত দু’য়েকজন গ্রামবাসী। ঠিক তখনি গোয়াল ঘরের ওদিক থেকে তীক্ষ্ণ ধ্বনি ভেসে এলো যেনো। আর কেউ নয়, ছোট মাসির মুখ দিয়েই বেরিয়ে আসছিলো এমন আওয়াজ। খানিক পরেই কাঁশি দেয়ার ভঙ্গিতে গলাটাকে পরিষ্কার করে নিয়ে জানান দিলো, ‘কে জানি আজ সেই সকাল থেকে কোথায় কোথায় ঘোরাঘুরি করছে, সে যেন আর দেরি না করে স্নানটা সেরে নেয়। তাছাড়া তার মা তাকে খোঁজাখুঁজি করছে সেই কখন থেকে! আমার কথা বিশ্বাস না হলে ঘরে এসে, সে যেন দেখে যায়। আমার কথা কি শুনতে পেলো সে?’
গোয়াল ঘরের বেড়ার ফাঁক গলে দেখা গেলো, ছোট মাসি গলা উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করছে আমাকে!
শাপলা বড়ুয়া