মমতাময়ী সারদাদিদি
সিদ্ধেশ্বর হাটুই
আস্তাকোন্দা গ্রামের সারদাদিদির আপন বলতে আর কেউ ছিলনা। স্বামী বিয়ের তিন মাস পর কর্কট রোগে মারা যান। সারদাদিদি স্বামীহারা সন্তানহীনা নারী। তার শ্বশুরবাড়ির কুলেরও আর কেউ বেঁচে নেই, পাড়ার লোকেই তার বেশি আপন। পাড়ার লোকেদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল বাড়ির লোকের মতই। তার বাপের বাড়ির লোকেরা মাঝেমধ্যে আসত সারদা দিদিকে দেখতে। অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক থাক বা না থাক তার বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক অটুট ছিল। বর্তমানে সারদাদিদি একেবারে বৃদ্ধা না হলেও তার বয়স এখন চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর হবে।
পাড়ার বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা তার বাড়ির সামনে খেলা করত, তা দেখে সারদাদিদি খুব আনন্দ পেত। তাদের খেলার জন্য যদি কনো খেলনার প্রয়োজন হত, সারদাদিদি তাদের এনে দিত। বাড়ির পাশে তার ছোট্ট বাগানে যদি ফল ধরত সেগুলিও পাড়ার বাচ্চাদের এনে খাওয়াত। এভাবেই পাড়ার বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ব্যস্ত থেকে, আর নিজের থাকা অল্প পরিমান জমিনে চাষ করে দিনগুলি বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল।কখনো অসুস্থ হলে পাড়ার লোকেরাই তার পাশে থাকত। পাড়ার সকলের সঙ্গে চলার আনন্দে সে একাকীত্বের কথা একেবারে ভুলে গিয়েছিল।সারদাদিদি ছিল একজন সত্যনিষ্ঠাপরায়ণা সৎ নারী। গ্রীষ্মকালে প্রত্যেক বছরের ন্যায় এবছরও দুপুর বেলায় পাড়ার ছেলেমেয়েদের বাড়িতে ডেকে এনে গল্পের আসর বসাত, রাজা রানী ,বাঘ শেয়ালের গল্প শোনাত। আবার কখনো কখনো নিজের অজান্তে নিজের জীবনের করুন কাহিনীগুলি শুনিয়ে ফেলত। বাচ্চারা সারদাদিদির জীবনের কষ্টের কথাগুলি শুনে তাকে আরো বেশি কাছে টেনে নিত।
কি জানি কি এমন ঘটল হঠাৎ সারদাদিদি একদিন মনেমনে প্রচণ্ড কষ্ট অনুভব করল। প্রাকদুপুরে সেদিন প্রতিবেশীর বাড়ির এক বৌ তার বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে বারান্দাতে বসে বসে চোখে কাজল পরিয়ে কপালে টিপ লাগিয়ে, পাওডার দিয়ে বেশ ভালো করে সাজিয়ে গালে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে গুনগুন করে ঘুম পাড়ানী গান-‘সোনা ঘুমোলো পাড়া জুড়ালো` গাইতে গাইতে ঘুম পাড়াচ্ছিল। সেটা দেখে সারদা দিদির মনে হয়েছিল-আমার ছেলেমেয়ে না থাকলেও পাড়ার ছেলে মেয়েরাতো আছেই, কিন্তু আমিতো তাদের এভাবে আদর করতে পারিনা! মনে মনে সেদিন সারদাদিদি অনুভব করেছিল সন্তানহীনা নারীর একাকীত্ববোধ কতটা হতেপারে ।
পরের দিন সকালে সারদাদিদি পাড়ার লোককে কিছু না বলেই বাপের বাড়ি চলে যায়। প্রতিবেশিনীর বাচ্চাকে আদর করতে দেখে তার মনের মধ্যে যে ব্যথার সৃষ্টি হয়েছিল, কিছুটা হলেও সেই ব্যথা লাঘবের জন্য তার একমাত্র ভাইয়ের সাতবছরের একমাত্র মেয়ে টুকুনকে কিছুদিনের জন্য তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখতে চায়, এই অনুরোধ সারদাদিদি তার ভাইকে করে বসল। অবশ্য তার ভাই এবং তার ভাইয়ের বৌ সারদাদিদির একথা শুনে ভাবছিল তারা এই কিছুদিন টুকুনকে ছাড়া কিভাবে কাটাবে! পরে অবশ্য সারদাদিদির মনের অবস্থা ভেবে তার ভাই টুকুনকে ছাড়তে রাজি হয়। সারদাদিদি সেদিনটা বাপের বাড়িতে থেকে পরেরদিন সকালে বাস ধরে টুকুনকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
পাড়ার অন্যান্য বাচ্চাদের মায়ের মতো করে সারদাদিদি তার ভাইঝি টুকুনকে যত্ন করে স্নান করায়, খাওয়ায়-বইপড়ায়, নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলায়, ঘুম পাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়ায়। তখন যেন সারদাদিদি টুকুনের মা হয়ে উঠেছিল। এভাবে প্রায় একমাস কেটে যায়। তখন একদিন সারদাদিদি মনে মনে ঠিক করল এবার টুকুনকে সে তার বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছে দেবে। মনে মনে ভাবল আমার কষ্ট হবে ঠিকই, কিন্তু টুকুনকে ছাড়া তার মা-বাবার কী অবস্থা।
পরেরদিন সকালে টুকুনকে নতুন ফ্রক, মোজা-জুতা, গলায় মালা, মাথায় হেয়ারবেল্ট, হাতে নানা রঙের চুড়ি পরিয়ে, পায়ে টকটকে লাল আলতা লাগিয়ে দিয়ে নিজের মনের মতো করে সাজিয়ে হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে সারদাদিদি বেরিয়ে পড়ল টুকুনকে তার বাড়িতে পৌঁছে দেবার জন্য। বাস ধরতে তারা গ্রাম থেকে কিছুটা দুরে হেঁটে গেল নেতাজি মোড়ের বাসস্ট্যাণ্ডে। সেখানে গিয়ে তারা বাসস্ট্যাণ্ড থেকে একশ মিটার দূরে একটি দোকানের সামনে গিয়ে দুজনে বসে বসে গল্প করছিল। হঠাৎ রাস্তার উপর রেষারেষি করে আসা দুটি ট্রেকারের মধ্যে একি ট্রেকার নিয়ন্ত্রন হারিয়ে তাদের দিকে ধেয়ে আসে।
বসে থাকা অবস্থায় সারদাদিদি নিজের জীবন বাঁচানোর দায়ে সরে যেতে সক্ষম হলেও টুকুনকে তুলে সরানোর মতো সময় পেল না। সঙ্গে সঙ্গে টুকুনের মাথার উপর দিয়ে ট্রেকারের চাকা গড়িয়ে গেল। একটা পটকার মতো আওয়াজ হল, আর সেখানেই টুকুনের জীবন শেষ। চারপাশের লোকজন ছুটে আসে, ড্রাইভারকে ধরে মারধর করে। পরক্ষনে পুলিশ এসে ড্রাইভারকে ধরে নিয়ে যায় এবং টুকুনের নিথর দেহটাকে তুলে নিয়ে যায়।
ততক্ষনে সারদাদিদি টুকুনের লাশ দেখে স্তম্ভিত, তখন তার মনে হচ্ছিল তার মাথায় কেউ যেন পাথর দিয়ে আঘাত করল। বুকটা যেন পাষাণ হয়ে আসছিল। মিনিট কয়েকের মধ্যে সারদাদিদি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। জ্ঞান যখন ফিরে পেল তখন সে হাসপাতালে , সারাক্ষন মনে পড়ছিল টুকুনের মুখটা, থেতলে যাওয়া মাথাটা, আর মনে পড়ছিল আনন্দময় সেই দিনগুলোর কথা। মনে হচ্ছিল সেই কাজল পরা চোখ, নতুন জামার সাজে টুকুনকে কত সুন্দরই না লাগছিল। এই সমস্ত ঘটনা গুলো যেন চোখের সামনে বার বার ভেসে আসছিল। সারদাদিদি বারবার ভাবছিল তার ভাইকে সে কী উত্তর দেবে। টুকুনে তার কাছে পৌছে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে। কিন্তু এ কী অঘটন ঘটে গেল! সারদাদিদি উপরওয়ালাকে তাচ্ছিল্য করে নিজের ভাগ্যের এহেন শোচনীয় পরাজয়কে মেনে নিতে না পেরে হার্টফেল করে হাসপাতালেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল। সারদাদিদি সেদিন মরেও শান্তি পেল না। জীবনের কি কঠিন পরিণতি, পরের দিন তার ভাই এসে সারদাদিদি ও টুকুনের মরদেহ দাহ করল।
সেই সমস্ত কথা আজও পাড়ার সকলে গল্পের আসরে বারবার বলে, আর সবার চোখদিয় টপ টপ করে জল পড়ে। কেউ কেউ বলে ভালোই হয়েছে সারদাদিদি মরে গেছে। নাহলে ও সারাটা জীবন মরে মরে বাঁচত। টুকুনের মৃত্যুকে ও কখনো মেনে নিতে পারত না। পাগল হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরত। তার থেকে ভাল সারদাদিদি মরেও বেঁচে গেছে।