কোয়ারেন্টাইন
সিদ্ধেশ্বর হাটুই,
গ্রামের ছেলে শিবু বাড়ির অর্থাভাব দূর করার চেষ্টায় আর বাড়ির লোকের আহার জোগানের জন্য রাজস্থানে একটি বেসরকারি কারখানাতে কাজ করতে গিয়েছিল এক বছর পূর্বে। কর্মস্থল বাড়ি থেকে অনেক দূরে, হওয়ায় যাতায়াত খরচ যাতে কমহয় তার জন্য কাজে যাওয়ার পর থেকে আর বাড়ি ফিরে আসেনি। লকডাউনের পূর্বে চিন্তাভাবনা ছিল বাড়ি ফেরার, তারপর হঠাৎ লকডাউন বাস ট্রেন বন্ধ, বাড়ি ফেরার ইচ্ছা তখন প্রবল হলেও উপায় ছিল না। প্রত্যেকদিন নিয়মকরে তার মা ও স্ত্রী কে শিবু ফোন করত।
এভাবে আরো কয়েক মাস কেটে গেছে। একদিন সকালে শিবু ফোন করে তার মাকে বলে—“মা আমার আর এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। খাবারও ঠিকমতো খেতে পাই না,মনের মধ্যে সবসময় যেন একটা পাপ বোধ হয়।”
এই কথা শোনার পর মায়ের মন বিচলিত হয়ে উঠে শিবুকে বলল-“বাবা তুই খবরনে ট্রেন চলছে দু-একটা, কনোরকমে বাড়ি ফিরে আয়।” এই বলে সেদিন ফোনে কথাবলা তখনকার মতো শেষ হল।
সন্ধ্যাবেলায় মা যখন সন্ধ্যাপ্রদীপ হাতে নিয় সন্ধ্যা দেখায় তখন শিবুর ফোন আসে, সন্ধ্যাপ্রদীপটা তুলসী মঞ্চে নামিয়ে ছুটে গিয়ে ফোনটা ধরে একটা সুসংবাদ পেল, শিবু বলল-“মা আগামিকাল একটা ট্রেন ছাড়বে, একদিনপর বড়ি যাচ্ছি।”
শিবুর মা এ সংবাদ শুনে আনন্দে দিশাহারা, ফোনটা রেখে সন্ধ্যাপ্রদীপ হাতে তুলে ভগবানের সমীপে প্রার্থনা করল যেন তার সন্তান ভালোভাবে বাড়ি ফিরে আসে।
পরেরদিন সকাল থেকে শিবুর মা ও তার স্ত্রী বারংবার ফোন করে খবর নেয় শিবু এখন কোথায় আসছে। অনেক দূরের রাস্তা ফিরতে একদিন তো লাগবেই। অপেক্ষা আর অপেক্ষায় কেটে গেল সারাটাদিন। কনোরকমে রাত্রি গেল কেটে। উঠল নতুন সূর্য, সেদিন সূর্যের ঝলমলে আলোটাও যেন নতুন লাগছিল শিবুর মায়ের চোখে। অনেক অপেক্ষার অবসান- দুপুর গড়াতেই শিবু এসে পৌঁছাল গ্রামে।শিবু পৌঁছানোর আগে থেকেই বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষারত তার মা।
কিন্তু বাড়ি আসা হলনা, দাঁড়িয়ে রইল বাস স্ট্যান্ডে। গ্রামের লোকেরা ততক্ষনে ঠিককরে ফেলেছে তারা শিবুকে গ্রামে থাকতে দেবেনা করোনার ভয়ে। হেনকালে গ্রামের কয়েকজন লোক ও দু-জন পুলিশ এসে শিবুকে গ্রামের ভেতর একটা স্কুলে নিয়ে যায়, সেখানে চোদ্দ দিন থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। কিছুক্ষন পর যখন পুলিশ চলে যায় তখন স্কুলের পাশাপাশি থাকা বাড়ির একদল মহিলা এসে দূর থেকে বলে –“শিবু তুমি এখানে থাকতে পারবে না অন্যত্র চলে যাও নাহলে আমরা কিন্তু তোমার গায়ে গরম জল ছুড়তে বাধ্য হব।”
এইসব কথা শিবুর বুকে প্রচন্ড আঘাত করল, সে মনে মনে ভাবল এরা সবাই আমার পরিচিত হয়েও এরকম কথা বলতে পারল। শিবু তার মাকে ফোন করে সমস্ত ঘটনা বলল আর বলল –“মা এখানে আমাকে ওরা থাকতে দেবেনা তুমি গ্রামের লোকের সঙ্গে কথাবলে আমার থাকার একটা ব্যবস্থা কর।”
তৎক্ষনাৎ শিবুর মা গ্রামের লোকের সঙ্গে কথা বলে একটা ফাঁকা জায়গায় ঝুপড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। থাকা খাওয়ার জন্য যে সমস্ত জিনিস প্রয়োজন সেগুলোর ব্যবস্থাও করেছে। তার পর শিবুকে সেই বাড়িতে আসতে বলে। শিবু বিষন্ন মনে স্কুল থেকে ঝুপড়িতে চলে আসে।
কত দুর্যোগ-উপেক্ষা করে তার চোদ্দ দিন কেটেছে। একদিন ঝড়ে ঝুপড়ির পাশে থাকা প্রকাণ্ড একটা চল্লাগাছ ভেঙে ঝুপড়ির পাশে পড়েছিল, ভাগ্য ভাল ঝুপড়িতে পড়েনি। নাহলে বাড়ি এসেও শিবুর আর বাড়ি ফেরা হতনা। এই চোদ্দ দিন শিবুর মা ও তার স্ত্রীর রাত্রে চোখে ঘুম আসতনা। এভাবে কনোক্রমে দিনগুলি কেটেছে শিবু ও তার পরিবারের।শতকষ্টে থেকেও শিবু ঐ ঝুপড়িতে চোদ্দ দিন থেকে বাড়ি ফিরল।
বেশিদিন নয় তার কিছুদিন পর আনলকপর্বে গ্রামের কত পরিযায়ী শ্রমিক বাড়ি ফিরল, তাদের জন্য করোনা ঠেকানোর কনো আইন-কানুন লাগু হল না। দিব্যি নিজের নিজের বাড়িতে থাকল, চারিদিকে ঘুরে আনন্দ করল। তখন আর গ্রামের কনো মানুষ, কনো পুলিশ কিচ্ছু বলল না। আইন কি সবার জন্য ভিন্ন, আজ একরকম আবার পরের দিন আরএকরকম। এটা কি ধরনের বিচার। এইসমস্ত ঘটনাগুলো দেখে সেদিন শিবু অনেক কষ্ট অনুভব করেছিল ।
গ্রাম+পোঃ-সুখাডালী, থানা-সারেঙ্গা, জেলা-বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত