ভয়েতে ভূতের দেখা
সিদ্ধেশ্বর হাটুই,
ভূতকে ভয় করেনা এমন মানুষ বর্তমান যুগেও খুব কম । বিশেষ করে পাড়া গ্রামের মানুষের মধ্যে এখনো ডাইন, ভূতের ভয় অনেকের মনের মধ্যে বিরাজমান।স্থান কাল ভেদে ভয় পাওয়ার পরিমাণটা নির্ভর করে।
সুশান্ত তখন এম.এ পাস করে চাকরির পরিক্ষায় বসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাঁকুড়া জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে তার বাড়ি। সেখানে সঠিকভাবে পড়াশোনা করা যাচ্ছিল না বলে তার বাবা তাকে মেদনীপুর শহরে গিয়ে ভালো কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে বলে। সুশান্ত মনে মনে সেদিনই ঠিক করে ফেলে সে মেদনীপুরেই যাবে, কিন্তু একা যেতে মন চায়না, তাই তার সহপাঠী এক বন্ধু প্রকাশকে এ বিষয়ে প্রস্তাব দেয়। তার বন্ধু প্রকাশও এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।
পরের দিন সুশান্ত এবং প্রকাশ মেদনীপুরে থাকা খাওয়ার জন্য যে সমস্ত সামগ্রী প্রয়োজন সেগুলো যতটা সম্ভব নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ল মেদনীপুরের উদ্দেশ্যে।
মেদনীপুর পৌঁছানোর পর তারা যে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হবে সেখানে নিকটবর্তী একটি ক্লাবের একটি ফাঁকা ছোট্ট ঘরে ভাড়া নিল। ক্লাব থেকে তাদের ভাড়া বাড়িটা ছিল বিচ্ছিন্ন ও একটু দূরে। ভাড়াবাড়ির একপাশে ছিল একটি পাগলা গারদ আর একপাশে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মর্গ, ভাড়াবাড়ির পিছনের জানালা খুললে মর্গের পড়ে থাকা ছি্ন্ন ভিন্ন দেহ গুলো দেখা যেত।
সুশান্ত ও প্রকাশ সেখানে কোচিংএ ভর্তি হল, তারা ক্লাবের পাশে থাকা একটি হোটেলে খাওয়া দাওয়া করত। পড়াশোনায় তারা দুজনেই ভালো, তাই পড়াশোনায় কনোরকম খামতি হোক তারা সেটা চাইত না । ঘুমানোর সময়টুকু বাদদিয়ে বাকিসময় তারা পড়াশোনার মধ্যে থাকার চেষ্টা করত।
এভাবে মাস দুই যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন দুপুর বেলা এক বয়স্কা মহিলা তাদের ভাড়া বাড়ির দরজার সামনে এসে অতর্কিতে পড়ে যায়,
মুখদিয়ে গল্ গল্ করে রক্ত বেরিয়ে আসে, তখন সুশান্ত ও প্রকাশ ছুটে এসে মহিলাকে হাতে ধরে তুলে মুখে জল দিয়ে প্রতিবেশীদের ডাকে। পরে প্রতিবেশীরা মহিলার বাড়িতে খবর দিলে তার বাড়ির লোক তাকে নিয়ে যায়। সেদিনই ঐ অসুস্থ মহিলাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পর ক্লাবের পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধা সুশান্ত ও প্রকাশকে ডেকে বলল –“বুঝলি বাবারা এ স্থানটা ভালো নয়, এখানে পূর্বে কবরস্থান ছিল, এখানে এখন বাড়ি হয়েছে। কিন্তু বাবা এখানে শান্তি নেই মাঝে মাঝেই অঘটন ঘটেই থাকে। তোমরা কেন এখানে থাক।” এই বলে বৃদ্ধা চলে গেলেন।
সেদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত তখন এগারোটা বাজে, খাওয়া সেরে সুশান্ত এবং প্রকাশ পড়তে বসেছে। ক্লাবের সদস্যরা বাড়ি চলে গেছে। বাইরে ঘন অন্ধকার, হঠাৎ ভাড়াবাড়ির উপরে ধুপধাপ আওয়াজ। প্রকাশ তখন সুশান্তকে বলে –‘এটা কী হচ্ছে!’ দুজনে ভয়ে জড়, দুজনের কপাল ঘামে ভিজে যাচ্ছে। সুশান্ত তখন ধিরে ধিরে দরজাখুলে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে দু -জন পাগল পাগলাগারদের প্রাচিরে্র পাশের আমগাছের উপর উঠে আম ছুড়ছে ভাড়াবাড়ির উপর। সমস্ত ঘটনাটা সুশান্ত প্রকাশকে বলার পর প্রকাশ বাইরে বেরিয়ে এল। সেদিন রাত্রে আর বই পড়া হল না, দুজনে ভয়ে ভয়ে কনোক্রমে ঘুমিয়ে পড়ল।
দুদিন পর প্রকাশ বাড়ি চলে এল, কিছু পরিমাণ মুড়ি আর কিছু জিনিসপত্র আনার জন্য।আর সুশান্তকে বলে এল সে যেন ভালোভাবে থাকে। দুদিন পর সে ফিরে আসবে।
এদিকে প্রকাশ বাড়ি যাওয়ার পর সুশান্ত একা। দুদিন পূর্বের সেই রাত্রের কথা ভেবে মনে মনে ভয়ের সঞ্চার হতে লাগল।দিনটা কনোক্রমে পার হয়ে রাতের অন্ধকার নামতেই ভয়ের মাত্রা যেন বাড়তে থাকল। যতক্ষন ক্লাবের লোকজন ছিল ততক্ষন মনে একটু সাহস থাকলেও যখন ক্লাবের সবাই বাড়ি চলে গেল তখন সুশান্তর মনে ভয়ের পারদ একটু একটু করে ঊর্ধ্বমুখী হতে লাগল। রাত যখন এগারোটা বাজে তখন বাইরে অন্ধকার শুন-শান পরিবেশ, ভয়ে বাড়ির বাইরে সুশান্ত আর বেরোলো না। সমস্ত কাজকর্ম বাড়ির ভেতরেই সেরে ফেলল। সে রাতে বই না পড়ে একটা গামছা মুখে ঢাকা নিয়ে শুয়ে পড়ল।কিন্তু ঘুম আসছিল না, মাঝরাতে যখন ঘুমটা একটু লাগছিল তখন তার মনে হল কে যেন তাকে ডাকছে মর্গের দিকের জানালা থেকে।
সুশান্ত বিছানা থেকে না উঠে একটু নড়ে চড়ে শুয়ে গামছাটাকে শক্ত কর চোখে বেঁধে ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু তাতেও কনো সুরাহা হল না। মিনিট কয়েক পর বাড়ির উপরে ধুপধাপ শব্দ আর ঝম ঝম আওয়াজ হতে শুরু হল, তখন সুশান্ত কী করবে আর ভেবে পাচ্ছিল না। বাইরে বেরিয়ে দেখার মতো আজ তার সাহস হলনা। ভয়ে ভয়ে তার বুকটা যেন পাষাণ হয়ে এল, শেষ পর্যন্ত সুশান্ত জ্ঞান হারিয়ে বিছানাতে পড়ে রইল। জ্ঞান যখন ফিরে পেল তখন সকাল। দরজা খুলে প্রকাশকে ফোন করল, বলল—
“দেখ ভাই আমার পক্ষে এখানে থাকা আর সম্ভব না। আমি আজ বাড়ি চলে যাচ্ছি, তুইও আর আসবিনা। এখানে থাকলে শেষ হয়ে যাবি।”
প্রকাশ বলল-“ আমি আর কী বলব বল! যা ভালো বুঝবি কর, কিন্তু কী এমন ঘটল যে বাড়ি চলে আসছিস?”
সুশান্ত বলল-“বাড়ি গিয়ে সমস্ত কিছু বলব, কনোরকম বেঁচে গেছি, নাহলে গত রাতেই মারা যেতাম। ঠিক আছে আমি বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিই।”এই বলে ফোনটা রেখে দিল।
সুশান্ত সেদিন বেদনাকান্ত মনে বাড়ি ফিরে এল। চাকরির জন্য প্রস্তুতি আর নেওয়া হল না।
গ্রাম+পোঃ-সুখাডালী, থানা-সারেঙ্গা, জেলা-বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত