SIDDHESWAR HATUI

দুঃখের সংসার সিদ্ধেশ্বর হাটুই

দুঃখের সংসার
সিদ্ধেশ্বর হাটুই

সংসারে সুখ দুঃখ সর্বদা বিরাজমান। কিন্তু ভরত বাবুর সংসারের চিত্রটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। ভরত বাবু দারিদ্রতার সঙ্গে সর্বদা লড়াই জারি রেখে সংসারে টিকে থাকা একজন মানুষ। পেশায় তিনি ছিলেন রাখাল। জমি-জমা মোটেও ছিলনা তার। পাড়া প্রতিবেশীদের গোরু চরানোর কাজ করার বিনিময়ে টাকা নিতেন, ঐ টাকায় সংসার চালাতেন। ভরত বাবুর সংসার কিন্তু খুব বড় না হলেও , তার স্ত্রী এবং দুই ছেলে বর্তমান। ছেলেরা তখন ছোটো।

অভাবের সংসার হলেও ভরত বাবু তার দুই ছেলেকে পড়াশোনা শেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। তার বড় ছেলের নাম ছিল অয়ন, ছোটো ছেলের নাম সায়ন। রাখালের কর্ম করতে যাওয়ার পূর্বে ভরতবাবু ছেলেদের স্কুলে পাঠানোর কাজটা সেরেই যেতেন। ছোট ছেলে সোজা সরল স্বভাবের ছিল , সে প্রতিদিন স্কুলে চলে যেত, কিন্তু বড় ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যেতে বেশ ক্লেশ পেতে হত । অয়ন স্কুলে যেতে চাইতনা। যদি তার বাবা হাত ধরে স্কুলে পৌঁছে দেবার চেষ্টা করত তাহলে অয়ন তার বাবার হাতে কামড় দিয়ে ছুটে দিত। আর তার পাত্তা পাওয়া যেতনা। বেলা শেষে বাড়ি ফিরত। প্রায়ই এরকম ঘটনা ঘটত। লেখাপড়ায় তার মন ছিল না, দুরন্তপনাই ছিল তার স্বভাব।

বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে , ভরত বাবুর ছেলেরা তখন সাবালকের দোরগোড়ায়। ভরতবাবু তখনোও রাখালের কাজ করে সংসার চালান। ভাগ্যের কি বিড়ম্বনা ভরতবাবু সেদিন গ্রামের পাশের একটি ফাঁকা মাঠে গোরু চরাচ্ছিলেন, এদিকে তখন তার গোরুর পালে একটি ষাঁড় এসে একটি গোরুর সাথে যুদ্ধ লাগে, তা দেখে ভরত বাবু হাতে একটি ছোট্ট লাঠি নিয়ে তৎক্ষণাৎ বাধা দিতে যান। বাধা দিতে গেলেও ভরতবাবু ষাঁড়কে বাধা দিতে পারেননি। ষাঁড়টি হঠাৎ ভরতবাবুর পেটে শিং দিয়ে সজোরে আঘাত করে। আর সেখনেই ভরতবাবু জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মাঠের পাশাপাশি থাকা দু-একজন মানুষ ছুটে এসে ভরত বাবুকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে যান হাসপাতালে। ডাক্তার বাবুরা আপ্রাণ চেষ্টা করেও ভরতবাবুর জীবন সেদিন বাঁচাতে পারলেননা। ভরতবাবু মারা গেলেন।

এদিকে তখন পরিবারের সকলে এই সংবাদ শুনে কন্নায় ভেঙে পড়েছে। পরে ভরতবাবুর ছেলেরা গ্রামের কিছু মানুষকে সঙ্গে করে হাসপাতালে গিয়ে ভরতবাবুর মৃতদেহ বাড়ি নিয়ে আসে এবং দাহ করে।

পরের দিন থেকেই শুরু হয়ে গেল সংসারে অশান্তি, বাবার শ্রাদ্ধশান্তি করার জন্য কোথায় টাকা পাবে সেটা তার মায়ের কাঁধেই চাপিয়ে দিল দুই ছেলে। যাইহোক কনোক্রমে ভরতবাবুর স্ত্রী টাকা জোগাড় করে শ্রাদ্ধের কাজটা সম্পূর্ণ করল । তার কয়েক দিনের মধ্যেই দুই ছেলে আয়ন ও সায়নের মধ্যে বাড়ির জায়গার কে কোনখানটা নেবে সেই নিয়ে বিবাদের সৃষ্টি হয়। পরক্ষণে তা হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়। গ্রামের মানুষ এ সমস্ত দেখে তাদের বাড়িতে গিয়ে বিচার করে দুই ভাইকে বাড়ির জায়গা সমান ভাগে ভাগ করে দেন। ফলে আয়ন বাড়ির একদিকে থাকে, আর অন্যদিকে থাকে সায়ন। বাড়িটির মাঝখানে একটি মোটা দেওয়াল দেওয়া হয়। তার পর থেকে সকলেই পৃথকভাবে বসবাস করে , দুই ভাই পৃথকভাবে কাজ করে আর রোজগার করা শুরু করে । তাদের মা একমাস করে তাদের বাড়িতে থাকবে, যখন যার দিকে থাকবে তখন তার হয়ে কাজ করবে এই চুক্তি হয় দুই ভাইয়ের মধ্যে। সেভাবেই চলত দুই ভাইয়ের সংসার।

এভাবে একটি বছর যাবার পর বড় ছেলে আয়ন একটি গরিব পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করে আনে। মেয়েটা ছিল সুশ্রী এবং চরিত্র ছিল খুব ভালো, গ্রামের মানুষের সঙ্গে আচার-ব্যবহার এমন ভাবে করত যে, সকলেই তাকে ভালো বলতো। এদিকে তখন আয়ন রাজমিস্ত্রির কাজ শিখে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে শুরু করেছে। রাজমিস্ত্রির কাজে হাতও ছিল বেশ ভালো। তাই লোকবেশি করে কাজে ডাকত তাকে। অন্য দিকে ছোট ছেলে সায়ন তখন গাড়ির ড্রাইভারী শিখেছে, লোকের গাড়ি চালায় । দু ভাই-ই এখন রোজগার করে।

কিছুদিন পার হতেই ছোট ছেলে সায়নও বিয়ে করে নেয়। মেয়েটা দেখতে সেকরম না হলেও স্বভাবের দিক থেকে বড় বৌ এর চেয়ে কম যায়না। ভালোই চলছিল দুই ভাইয়ের সংসার। মা কাজ করে তাদের পাশে সম্বল হয়ে থাকত। বিনিময়ে তিনবেলা পেটে অন্ন জুটত। কিছুদিন যেতে না যেতেই বড় ছেলে আয়ন মদ খেতে শুরু করল , আর যেদিন থেকে মদ খাওয়া শুরু সেদিন থেকে সংসারের সকলেই বেশি করে অভাবের আর অশান্তির মুখ দেখল। বারংবার আয়নের স্ত্রী বারন করলেও সে কথা শোনার প্রয়োজন মনে করেনি। বরং আরো বেশি করে মদ খেতে লাগল, আর বাড়িতে এসে তার স্ত্রী এবং মা কে ব্যাপক প্রহার করা শুরু করে। এর জন্য কিছুদিন পর তার মা বাড়ি ছেড়ে রান্নার কাজে ভিনরাজ্যে চলে যায়।

তারপর বছর পাঁচ পার হয়ে গেল। তখন আয়নের সংসারের সঙ্গে সায়নের সংসারের কনো সম্পর্ক নেই। মা আর ফিরে আসেননি। এদিকে সায়নের তখন একটি মেয়ে আর তার স্ত্রীকে নিয়ে ভালোই সংসার চলছে। তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কনো ঝামেলাও সেরকম হয়না। অন্যদিকে আয়নের বৌ অভাগিনী অব্যক্ত যন্ত্রনায় ছটপট করছে। এই কয়ের বছরের সংসারে তখন সে দুই মেয়ে এক সন্তানের মা। মেয়রা বড়, ছেলেটি ছোট। এদিকে বাড়িতে টাকা দিচ্ছেনা আয়ন। কিভাবে চলবে সংসার সেটা একমাত্র এই অভাগিনীই জানত। নিজে লোকের বাড়িতে কাজ করে ছেলে মেয়েদের খাওয়াত। তা সত্ত্বেও স্বামীর ভালোবাসা সে কনোদিন পায়নি। স্বামী যতদিন মদ খাওয়া শুরু করেছে ততদিন সংসারে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। স্বামীর হাতে মার খেয়ে খেয়ে তার সমস্ত শরীরে কলো দাগ হয়ে গেছে।

আয়নের স্ত্রী চাইলে এই সংসার ত্যাগ করতে পারতো। কিন্তু ছেলে-মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সে ঐ কাজটা করতে পারেনি। বরং বারংবার গ্রামের মানুষকে ডেকে সমস্ত ব্যাপারগুলো বলেছে সমাধানের আশায়। না, কনোকিছুতেই কাজ হয়না। শেষ পর্যন্ত থানাতে গিয়ে অভিযোগ করে, পরে আবার সে ভেবেছে যাই হোক ও তো আমার স্বামী, এই ভেবে আবার পিছিয়ে এসেছে। স্বামীকে থানা থেকে ফিরিয়ে এনেছে।

কিন্তু আয়ন একদিন প্রচণ্ড মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে বৌ এর সঙ্গে ঝগড়া লাগে। শেষপর্যন্ত আয়ন বাড়ির দরজা লাগিয়ে তার স্ত্রীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেশলাই কাঠি দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়।মেয়েরাও ছেলেটা তখন বাড়ির বাইরে ছিল। ফাঁকা ঘরে সেদিন আয়নের স্ত্রী চিৎকার করতে করতে পুড়ে মারা গেল।পরে পাড়ার সমস্ত মানুষ বেরিয়ে এসে দেখল এক বিস্ময়কর কান্ড, সঙ্গে সঙ্গে থানায় খবর দেওয়া হয়। পুলিশ এসে মৃতদেহ সহ আয়নকে ধরে নিয়ে গেল। অনাথ হয়ে পড়ল আয়নের ছেলে-মেয়েরা।

ঐ অনাথ শিশুরা বহু কষ্টে নিজেদের শ্রমের প্রতিদানে দু বেলা দু মুঠো খেয়ে ধিরে ধিরে বড় হয়ে গেল। দীর্ঘ সাত বছর জেল খেটে আয়ন যখন বাড়ি ফিরল তখন ছেলে- মেয়ে বড় হয়ে গেছে। কিন্তু তখনও আয়নের স্বভাবগত কনো পরিবর্তন হয়নি। বরং হিংস্রতার পরিমাণ আরো প্রকট হয়ে গেছে। জেল থেকে বাড়ি ফিরে আয়ন আর কাজ করতে যেতনা, মেয়েদের ও ছেলেকে কাজ করতে বলত। আর মেয়েরা যদি আয়নের পছন্দ মতো খাবার আর মদ না এনে দিত ,তাহলে সব্বাইকে মার দিত। শেষ পর্যন্ত একদিন আয়ন মদ খেয়ে তার মেয়েদের শ্লীলতাহানি করে বসল। তখন মেয়েরা আর সহ্য করতে না পেরে থানায় গিয়ে বাবার নামে কেস ফাইল করে। ফলে পুলিশ আয়নকে ধরে নিয়ে যায়। এবং তার বারো বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।

অনাথ দুই মেয়ে এক ছেলে লোকের বাড়িতে কাজ করে খায়। কিছুদিন পর মেজো মেয়েটি অবশ্য একটি ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করে চলে যায়। কিন্তু বড় মেয়ের টান ভাইয়ের দিকে । সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগে ভাইকে বাঁচার উপযুক্ত ব্যবস্থা না করে দিয়ে সে বিয়ে করবেনা।

কিন্তু ঐ ছেলেটা বড় হয়ে কি করবে বা কেমন হবে সেটা বলা তো আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়। হয়তো অনেক ভালো মনের মানুষ হয়ে উঠবে, যদি গ্রামের মানুষ সাহায্য করে,। অন্যথায় সমাজকে , এই সমাজের মানুষকে সে ঘৃণার চোখে দেখবে।

Leave a Reply